গাজীপুরের পানি বিষাক্ত : শিল্পায়নের মূল্য দিচ্ছে স্থানীয়রা

আগের সংবাদ

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : যথাসময়ে নির্বাচন হবে

পরের সংবাদ

মিতু হত্যা মামলা : বাবুলকে প্রধান আসামি করে অভিযোগপত্র

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম অফিস : স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুনের দায়ে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আদালতে জমা দেয়া দুই হাজার ৮৪ পৃষ্ঠার তথ্যপ্রমাণ সংবলিত নথিপত্রসহ অভিযোগপত্রে বাবুলসহ সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক চট্টগ্রাম আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় এ চার্জশিট জমা দেন। লাগেজভর্তি কেস ডকেটে ২ হাজার ৮৪ পৃষ্ঠার নথিপত্র রয়েছে। মূল অভিযোগপত্র নয় পৃষ্ঠার হলেও এর সঙ্গে দশ খণ্ডের নথি সংযুক্ত করা হয়।
অভিযোগপত্র হস্তান্তরের সময় সেখানে পিবিআই পুলিশ সুপার (মেট্রো) কাজী নাইমা হাসানও উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগপত্র জমা দিয়ে বের হওয়ার পর জানতে চাইলে পুলিশ সুপার নাইমা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিতু হত্যা মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আমরা অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি। মামলায় বাবুল আক্তারকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে মামলাটি তদন্ত করেছি। পিবিআই কখনো পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে তদন্ত করে না। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা মামলাটির তদন্তভার পেয়েছিলাম। আড়াই বছরের তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে সব রকমের তথ্যপ্রমাণ আমরা পেয়েছি তাদের আসামি করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ-সিএমপি’র অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মো. কামরুল হাসান বলেন, মিতু হত্যা মামলায় বাবুল আক্তারসহ ৭ জনকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছে পিবিআই। আমরা এখনো কেস ডকেট পুরোপুরি দেখতে পারিনি। অভিযোগপত্রে ২ হাজার ৮৪ পৃষ্ঠা রয়েছে। এটা অনেক বড় একটা কেস ডকেট। সেটি আমরা আইন অনুযায়ী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠাব। আগামীকাল আদালত চার্জশিট দেখবে। যেহেতু এটা হত্যা মামলা, আদালত সেটা সেশন জজ আদালতে পাঠাবেন। এরপর পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। আগামী ১০ অক্টোবর মামলাটির শুনানির তারিখ ধার্য রয়েছে।
অভিযোগপত্রে বাবুল আক্তার প্রধান আসামি করা হয়েছে, যিনি এই মামলার বাদী। অন্য ছয় আসামিরা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ওরফে হানিফুল হক ওরফে ভোলা, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া। অন্যদিকে মিতু হত্যার পর

মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া চারজনকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দিয়েছে পিবিআই। তারা হলেন- মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু, নুরুন্নবী, রাশেদ ও গুইন্যা। এদের মধ্যে সাইদুল ও গুইন্যার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর হত্যাকাণ্ডের পর নুরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।
গ্রেপ্তার ভোলা, ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে মিতু হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। মামলার আসামিদের মধ্যে মুসা ও কালু পলাতক বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মামলায় কারাগারে আছেন- বাবুল আক্তার, ওয়াসিম, শাহজাহান মিয়া ও আনোয়ার হোসেন। অন্য আসামি ভোলা জামিনে আছেন। হত্যার পর থেকেই ‘নিখোঁজ’ আছেন কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। তবে মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, মুসাকে ২০১৬ সালের ২২ জুন ‘প্রশাসনের লোকজন’ তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মিলছে না। মিতু হত্যা মামলায় মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অভিযোগপত্রে মোট ৯৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক এক নারীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এর জেরে বাবুল আক্তার স্ত্রীকে খুনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন লাখ টাকায় ‘খুনি’ ভাড়া করে স্ত্রীকে খুন করান। নিজেকে আড়ালে রাখতে প্রচার করেন- জঙ্গিরাই মিতুকে খুন করেছে। মিতুকে খুনের মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের ‘সোর্স’ মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। সঙ্গে ছিল আরো ছয়জন।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মিতুকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিতে ওই সময় ঢাকায় ছিলেন বাবুল আক্তার। হত্যাকাণ্ডে জঙ্গিরা জড়িত দাবি করে স্বামী বাবুল আকতার পরদিন ৬ জুন পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন। পাঁচলাইশ থানা পুলিশের পর নগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে। তারা প্রায় তিন বছর তদন্ত করেও অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হয়। পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালতের নির্দেশে মামলা তদন্তের ভার পায় পিবিআই।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় গত ১১ মে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রাম পিবিআই কার্যালয়ে ডেকে নেয়া হয়। এর পরদিন ১২ মে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মিতু হত্যার সঙ্গে তার স্বামী বাবুল আক্তারের ‘সম্পৃক্ততার প্রমাণ’ পেয়েছেন তারা। সেদিনই চট্টগ্রামে আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন পিবিআইর পরিদর্শক মামলার তৎকালীন আইও সন্তোষ কুমার চাকমা। এরপর ওইদিনই পাঁচলাইশ থানায় মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন একটি হত্যা মামলা করেন।
পিবিআই হেফাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে ১২ মে মোশাররফের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর আদালতে গ্রেপ্তার ভোলা, বাবুলের ঘনিষ্ঠ সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং আসামি মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের দেয়া জবানবন্দিতে বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য আরো জোরালো হয়। তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এসব জবানবন্দির এক পর্যায়ে নিজের মামলায় পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেন বাবুল আক্তার।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর শুনানি শেষে আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ফলে মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলাটির পাশাপাশি করা বাবুল আক্তারের মামলাটিও সক্রিয় হয়ে যায়। দুই মামলার সমান্তরাল তদন্তভার এসে পড়ে পিবিআইর ওপর। ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারকে তার নিজের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মঞ্জুর করে বাবুলকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি মোশাররফ হোসেনের করা মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। ৬ মার্চ সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে বাবুলের করা মামলার তদন্ত শেষ করতে বলে আদালত। প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন বাবুল আক্তার। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর মিতুর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় বাবুলের। এর জের ধরে বাবুল আক্তার পরিকল্পিতভাবে লোক ভাড়া করে মিতুকে খুন করেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থার ওই নারী কর্মীর কাছ থেকে একটি বই উপহার পেয়েছিলেন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। মিতু হত্যা মামলার আলামত হিসেবে সেই বই জব্দ করে পুলিশ। গত ৭ মার্চ তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ মার্চ বিকেলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় বাবুল আক্তারের হাতের লেখা পরীক্ষা করা জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে আদালত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) এ সংক্রান্ত পরীক্ষার নির্দেশ দেন। বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে গত ১৯ এপ্রিল আদালতে জমা দেয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপহার পাওয়া বইয়ের হাতের লেখার সঙ্গে বাবুল আক্তারের হাতের লেখার মিল পাওয়া যায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়