মাদক দিয়ে ফাঁসানো পুলিশসহ তিনজন কারাগারে

আগের সংবাদ

বাণিজ্যিক জাগরণের সম্ভাবনা > উত্তর-পূর্বের দুয়ার খুলছে : কানেক্টিভিটিতে গুরুত্ব বাংলাদেশ ও ভারতের

পরের সংবাদ

দুই সংকটে তৈরি পোশাক খাত : সংকট কাটলে ৮ বছরে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের আশা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : করোনাকালের সংকট মোকাবিলা করে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল দেশের তৈরি পোশাক খাত। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পেক্ষাপটে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার কারণে ফের বেকায়দায় পড়েছে এ খাত। সংশ্লিষ্টদের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ-আমেরিকায় ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি ও জ¦ালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। জ¦ালানি ও বিদ্যুতের সংকটের পাশাপাশি পরিবহন ভাড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে গেছে। এ কারণে দুদিক দিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতে বিপদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথমত, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের পোশাক তৈরিতে খরচ বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, ক্রেতাদের চাহিদা কমেছে। এ অবস্থায় বাড়তি খরচ নিয়ে অসন্তুষ্ট হলে বিদেশি ক্রেতারা অন্য দেশের দিকে ঝুঁকতে পারে।
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। দেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, চলমান এ যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেনে রপ্তানি কমেছে; পাশাপাশি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। সেখানে জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের বাইরে অন্য পণ্য বিক্রি কমে গেছে। পণ্যের মজুত জমছে। সে কারণে বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে আগামী মাসগুলোয় রপ্তানি কমবে বলে আশঙ্কা করছেন পোশাক মালিকরা। এদিকে বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি দেশেও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে ভুগছে শিল্পকারখানা। এ কারণে সহসাই পোশাক খাতের সংকট কাটছে না বলে মনে করছেন তারা।
জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে একদিকে বেড়েছে কাঁচামাল আমদানির খরচ, অন্যদিকে ডিপোর সার্ভিস চার্জ ও কারখানা থেকে পণ্য ডিপোতে নিতে পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে পোশাক উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু ক্রেতাদের কাছে বাড়তি দাম না পাওয়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে- এমনটা দাবি উদ্যোক্তাদের। চলমান

সংকটে আগামী তিন মাসে পোশাক রপ্তানি আরো কমবে বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্ডার কমেছে। ফলে সামনের দিকে পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাবে। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে জন্য মালিকদের পোশাকের দাম না কমানোর আহ্বান জানান তিনি। ফারুক হাসান বলেন, শিল্প খাত থেকে রপ্তানি হয়েছে ৪২ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে, জুলাই-আগস্টে প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল। কিন্তু দুই মাসে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ক্রয়াদেশ ক্রমশ কমছে। আমাদের অন্যতম রপ্তানিবাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ও মন্দার কারণে আগামী মৌসুমের জন্য কার্যাদেশ প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমে এসেছে। তিনি আরো বলেন, খুচরা বিক্রেতারা ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতিতে বিশ্ববাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সংগ্রাম করছে। অনেক ব্র্যান্ডের খুচরা বিক্রি কমেছে- যা তাদের অবিক্রিত মজুত বাড়িয়েছে। এসব বিবেচনায় আগামী মাসগুলোয় আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হতে পারে। ফারুক হাসান বলেন, আমাদের ৮২ শতাংশ পণ্যই ৫টি আইটেমের। আমরা এখনো ৭৪ শতাংশ কটনভিত্তিক পণ্য রপ্তানি করি। কিন্তু বহির্বিশ্বে নন-কটনের বাজার অনেক বড়। আমরা এখন নন-কটনের বাজার ধরার চেষ্টা করছি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ এখন আর চিপ লেবারের (সস্তা শ্রমিক) মার্কেট নয়, বাংলাদেশ এখন কমপিটিটিভ (প্রতিযোগিতামূলক) লেবারের মার্কেট। আমাদের মার্কেটও কপ্লায়েন্সভিত্তিক। এগুলো ভাবমূর্তির বিষয়।
সা¤প্রতিক সময়ে একদিন করে কারখানা বন্ধ রাখা ও জ্বালানি তেলের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। এ কারণে বর্তমানে দু’ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রথমত, পরিবহন খরচ ও বেসরকারি ডিপোর ৩৫ শতাংশ চার্জ বেড়ে গেলেও বিদেশি ক্রেতারা আগের দরেই পণ্য কিনছেন। দ্বিতীয়ত, সপ্তাহে একদিন করে কারখানা বন্ধ রাখা ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। ফলে যথাসময়ে ক্রেতাদের পণ্য পাঠাতে সমস্যা হচ্ছে।
তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ হারে চার্জ বাড়িয়েছিল অফডক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো এসোসিয়েশনের (বিকডা)। এবার প্রতি আমদানি ডকুমেন্টে দুই হাজার টাকা করে বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এসোসিয়েশন (বাফা)। আগে প্রতিটি আমদানি ডকুমেন্টের জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা চার্জ থাকলেও এখন তা এক লাফে ৫ হাজার ৫০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, চলমান সংকটে আসন্ন স্প্রিং সিজনের অর্ডার কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এখন ভবিষ্যতে যদি এ অর্ডারগুলো ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে আমাদের খরচগুলো অর্থাৎ লজিস্টিকস সাপোর্টের ব্যয়গুলো কমিয়ে আনতে হবে।
বিশ্বমন্দার কারণে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে টিকে থাকতে নানাভাবে লড়াই করতে হচ্ছে বাংলাদেশের উৎপাদকদের। এর মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার বাড়তি চার্জ ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজিএমইএ নেতারা। এ বিষয়ে বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে যে পণ্য রপ্তানি করতে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার ডলার খরচ হয়; আমাদের এখানে একই পণ্য রপ্তানিতে খরচ হয় ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার ডলার। তার মধ্যে নতুনভাবে চার্জ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের ক্ষতি হবে। যে কারণে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাব।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ডিজেলে জেনারেটর চালিয়ে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে আছেন উদ্যোক্তারা। দীর্ঘদিনের জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়ার পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়েছে; তাই কাঁচামাল আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে ডিপো মালিকরাও সার্ভিস চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছেন। চলতি অর্থবছর ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর বড় অংশই আসবে পোশাক খাত থেকে। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা মুশকিল হয়ে পড়বে। পাশাপাশি কারখানাগুলোতে উৎপাদন ও আয় কমে গেলে কারখানা ব্যয় পরিচালনা করা মুশকিল হয়ে পড়বে। এতে শ্রমিক অসন্তোষসহ নানামুখী চাপ তৈরি হবে।
সংকট কাটলে ৮ বছরে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের আশা : গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে এবং সরকারের নীতি সহায়তা পেলে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও একটি ভালো অবস্থানে থাকবে দেশের তৈরি পোশাক খাত; এমনটিই ভাবছেন তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা। শুধু তাই নয়, আগামী ৮ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে এই খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনটি ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার। সংগঠনটির ধারণা, ২০৩০ সালে পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬০ লাখে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেন, বর্তমানে আমরা যেসব পোশাক রপ্তানি করি, তার সঙ্গে বেশি মূল্য সংযোজিত হয় এমন পোশাক উৎপাদনের টার্গেট নিয়েছি। সেই সঙ্গে আমরা টেকনিক্যাল টেক্সটাইল রপ্তানিতেও জোর দিচ্ছি। আমরা আশা করছি, ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তিনি জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে ২০টি লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে টেকসই পোশাক শিল্প গড়তে একটি রোডম্যাপ তৈরির কাজ চলছে। তিনটি আলাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেই কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ১০ হাজার কোটি ডলারের লক্ষ্য অর্জনে আগামী ৮ বছরের মধ্যে বাড়তি ৫ হাজার ৭৮৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করতে হবে।
এর আগে ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বিজিএমইএ। ২০১৪ সালে এই লক্ষ্য ঘোষণার পর একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছিল সংগঠনটি। তবে শেষ পর্যন্ত করোনাসহ নানা কারণে লক্ষ্যমাত্রাটি অর্জিত হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়