খন্দকার মোশাররফ : বিএনপিকে নির্যাতন করে দমিয়ে রাখা যাবে না

আগের সংবাদ

দুই সংকটে তৈরি পোশাক খাত : সংকট কাটলে ৮ বছরে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের আশা

পরের সংবাদ

দাগ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বালতির পানিতে মিতু পাঞ্জাবিটা ভিজিয়ে রেখেছে। গুঁড়ো সাবানের জাদু টোনা চলছে। দাগ তোলার দারুণ ম্যাজিক এই গুঁড়ো সাবান। গৃহিণীদের ঘষাঘষির দিন শেষ হয়েছে। এখন বাজারে হরেক রকমের গুঁড়ো সাবান পাওয়া যায়। হরেক নামের। চকচকে ঝকঝকে দারুণ মোড়কে। কাপড় বা ফ্লোর থেকে দাগ তোলার জন্য এই গুঁড়ো সাবান কাজ করে দুর্দান্ত। গুঁড়ো সাবানের ফেনা পাঞ্জাবি থেকে দাগটা তোলার জন্য কাজ চলছে। সঙ্গে মিতুর মুখও চলছে। তার মুখের গতি গুঁড়ো সাবানের কাজ করার চেয়ে বেশি বৈ কম না। ভাসুরের ছোট ছেলের রাতিনের গালে চার আঙুলের দাগ বসে গেছে। রাতিনের চৌদ্দ গোষ্ঠীকে মিতু উদ্ধার করছে। তার মুখের ভাষা হিব্রু টাইপ। গালাগালি করার সময় মিতুর চোখ ও মুখ বীভৎস রকমের দেখায়!
রতনপুরের বড়বাড়ির মেয়ে সে। খুব নামডাক তাদের। রতনপুর গ্রামের এই যুগের জমিদার বললেও ভুল হবে না। অথচ সেই বাড়ির মেয়ে বিয়ে করল হিজলতলী গ্রামের চালচুলোহীন ওসমানকে। হিজলতলী গ্রামের ভাটি অংশে ওসমানদের বাড়ি। ওসমানরা দুই ভাই দুই বোন। ওসমানের বড় ভাই মজিদ। মজিদ লেখাপড়া বেশি দূর পর্যন্ত করতে পারেনি। অভাবের আগুনে পুড়ে পুড়ে বড় হওয়া মজিদ এখনো সংসারের ঘানি টানছে। সেই শৈশব থেকেই যার শুরু। মজিদের বয়স যখন আট বছর তখন তার বাবা বজ্রপাতে মারা যায়। স্বামীর শোকে তার মাও চলে যায় তারাদের দেশে। তখন দশ বছর বয়সের ছোট্ট মজিদের কাঁধে সংসারের জোয়াল। চারজনের ভার বহন করে ছুটতে থাকে সে। বাড়ি বাড়ি গাওয়াল করে। এই গ্রাম থেকে অই গ্রাম। মাথায় ঝাঁকি নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করে রকমারি জিনিসপত্র। এভাবেই চলে তার টানাটানির সুখের সংসার!
মিতু একমনে পাঞ্জাবিটা ঘষে যাচ্ছে। দাগটা তাকে তুলতেই হবে। বাপের বাড়ির উপহার বলে কথা। ঢাকা থেকে কিনেছিল মিতুর বাপ। বেশ দামি পাঞ্জাবি। অথচ রাতিন সেই পাঞ্জাবিতে দাগ লাগিয়েছে। কঠিন দাগ। কারচুপি কাজ করা সাদা পাঞ্জাবিতে দাগটা যেন ভ্যাঙচি কেটে হাসছে! যতবার মিতুর চোখ পড়ছে পাঞ্জাবির দাগের দিকে ততটাই সে তেলেবেগুনে তেতে ওঠছে। ছ্যাৎছ্যাৎ করে ওঠে তার মন। রাতিনকে বকেই যাচ্ছে মিতু। সঙ্গে ফ্রি গালাগালি শুনছে রাতিনের বাপ মা। ‘ইমুন পোলা কি মাইনসের ঘরে হয়! বজ্জাত একটা পোলা। তর বাপ জন্মে ইমুন একটা পাঞ্জাবি কিনতে পারবি? তর চাষা বাপও একজন্মে কিন্না দিতে পারতো না।’
কথাগুলো বুলেটের মতো বিঁধছে মজিদের বুকে। কত দিন না খেয়ে গাওয়াল করেছে সে। ভাইবোনের মুখে খাবার তুলে দিতে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটেছে। পায়ে ফোসকা পড়েছে। রাতে ব্যথায় কাতরেছে। ঈদে চান্দে নিজে নতুন কাপড় না কিনে ছোট ছোট ভাইবোনদের জন্য নতুন জামা কিনে দিয়েছে। রাতিনের হাউমাউ কান্না মজিদের বুককে রক্তাক্ত করেছে। অথচ এই ছোট ভাইকে পড়ানোর জন্য গাওয়াল শেষে আবার মানুষের জমিতে চাষবাস করতো। ডাবল খেটেখুটে ভাইবোনদেরকে পড়াশোনা করিয়েছে। পাড়াপড়শি সবাই তখন মজিদকে নিজের কিছু পুঁজি জমানোর কথা বলতো। তখন তাদের মুখের ওপর মজিদ বলে দিত, ‘ওরাই আমার টাকার ব্যাংক হবে। সম্মানের ব্যাংক হবে। গর্বের ব্যাংক হবে।’ তারপর নিরাশ হয়ে সেই পাড়াপড়শি আর কখনো বলত না।
মিতুর পাঞ্জাবি ধোয়া শেষ। বকতে বকতে কলেরপাড় থেকে সে আসছে। পাঞ্জাবিটা উঠানের বাঁশের ওপর মেলে দেয় সে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে পাশের বাড়ির রহমতের মা। আশির বেশি হবে বয়স। সে মিতুকে বলল- কী করলি লো! পাঞ্জাবিত ত আর দাগ নাই। উইঠ্যা গেছেগা! তয় তুই যা কইছোত মজিদের মনের ভিত্তে কঠিন দাগ লাগাইছোত। এহন এই দাগ তুলবি কী দিয়া? ইমুন গুঁড়া সাবান আছেনি?
ঘরের খিড়কি দিয়ে আসমানের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে মজিদ। ঈশানকোণে আজ মেঘ জমেছে। দ্রুত কালো হচ্ছে মেঘের রঙ। যেকোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে….

:: মাধবপুর, হবিগঞ্জ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়