খন্দকার মোশাররফ : বিএনপিকে নির্যাতন করে দমিয়ে রাখা যাবে না

আগের সংবাদ

দুই সংকটে তৈরি পোশাক খাত : সংকট কাটলে ৮ বছরে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের আশা

পরের সংবাদ

চট্টগ্রামে সাম্প্র্রদায়িক সহিংসতা : ২০টির বেশি মামলা দায়ের, বিচার শুরু হয়নি একটিরও

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রীতম দাশ, চট্টগ্রাম অফিস : সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার সন্তোষজনক কোনো অগ্রগতিও নেই বললেই চলে। গত এক বছরে ২০টির বেশি মামলা হলেও একটিরও বিচার কাজ শুরু হয়নি। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পরপর তাৎক্ষণিকভাবে তোড়জোড় দেখা গেলেও যতই দিন গড়াতে থাকে ততই তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা, ভয়ভীতির কারণে সাক্ষীদের অনাগ্রহসহ নানা কারণে বছরের পর বছর এসব মামলার বিচার প্রক্রিয়া থমকে আছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলেছে। আবার অনেকক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা ও হয়রানির কারণে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় মামলাও করা হয় না।
পূজামণ্ডপে হামলা, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর দেশের সচেতন নাগরিকের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়, অতীতের হামলা-লুটপাটের বিচার না হওয়ায় বারবার এমন ঘটনা ঘটছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিচারের আশ্বাস দেয়া হলেও এসব মামলার ‘কচ্ছপ গতি’ দুঃখজনক। তারা বলেন, অপরাধীদের বিচার না হওয়ার দায় প্রশাসন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। গত বছর হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সময় থেকে দেশব্যাপী যেভাবে সাম্প্রতিক সহিংসতা ঘটেছে, তাতেও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
গত এক বছরে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা, মঠ-মন্দিরে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনার ২০টির বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু একটিরও বিচার কাজ শুরু হয়নি। আবার এসব হামলার শিকার অনেকে আতঙ্কে থাকে। ফের হামলার ভয়ে এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকে মামলা করতে চায় না।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নিতাই প্রসাদ

ঘোষ ভোরের কাগজকে বলেন, চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় চট্টগ্রামে ২০টির মতো মামলা হয়েছে। কিছু কিছু পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে চার্জশিট হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত একটিরও বিচার কাজ শুরু হয়নি। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে খুব শিগগিরই বিচার কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, হাটহাজারী, মহানগরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় গ্রেপ্তার কয়েকজনের জামিন হয়েছে। এখন জামিন বেশি হচ্ছে। জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা তদন্তে পুলিশ বেশ তৎপর রয়েছে। আগে এসব সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার বিচার হতো না। তবে এখন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে প্রশাসনের শক্ত মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রশাসন ভালোভাবে তদারকি করছে।
গত বছর ১৫ অক্টোবর জুমার নামাজের পর নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি মিছিল থেকে ঐতিহাসিক জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে হামলা হয়। ঘটনার পরদিন ৮৪ জনের নাম উল্লেখ আর অজ্ঞাতনামা ৫০০ ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। কুমিল্লায় কথিত কুরআন অবমাননার প্রতিবাদে নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় জেএম সেন পূজামণ্ডপে হামলা করা হয়েছিল। কোতোয়ালি থানা পুলিশ বাদী হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনা, পুলিশের ওপর হামলা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে এ মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরপর ৮৩ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, স্থিরচিত্র দেখে সরাসরি হামলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পুলিশ।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, প্রতিটি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা খুবই সুপরিকল্পিত এবং সংঘবদ্ধ। এসব ঘটনার বিচার হতে আমরা দেখি না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলেছে। হামলার শিকার মানুষ আতঙ্কে থাকে। অনেকে মামলা করতে চায় না। কারণ তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনা দুর্বল হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক মহলে আন্তরিকতার প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ দেশের বর্তমান রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পথে নেই। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক শক্তি সহিংসতা ঠেকানোর জন্য আন্তরিক নয়। তারা ফায়দা লুটতে চায়। কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকতে, কেউ ক্ষমতায় যেতে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে ঐক্য করে, আর কেউ তাদের সঙ্গে আপস করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়তে চাই। সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সচেতন হয়ে প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে হবে।
চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নিয়ে গত ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে ৫৬ জন হামলাসহ তৎপরবর্তী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের কার্যকলাপ তুলে ধরেন। এছাড়া নাম-পরিচয় সরাসরি প্রকাশে ভীত অনেকে লিখিতভাবেও ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ করেন। ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’ আয়োজিত গণশুনানিতে গণকমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে অংশ নেন আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের আহ্বায়ক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, গণকমিশনের সদস্য সচিব তুরিন আফরোজ, সমন্বয়কারী কাজী মুকুল, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানসহ আরো অনেকে। গণশুনানিতে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যগ্রহণে তাদের বক্তব্যে উঠে আসে, প্রশাসন ও পুলিশের প্রথমে গাফিলতি ছিল। ঘটনা প্রতিরোধে প্রথমদিকে রাজনীতিবিদদের অনুপস্থিতি ছিল।
গণশুনানিতে অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা-শাহমীরপুর সনাতনপাড়া দুর্গাপূজা কমিটির সভাপতি সজল দাশ জানান, কুমিল্লায় কথিত কুরআন অবমাননার ঘটনার পর অষ্টমীর রাতে তাদের পূজামণ্ডপে হামলা হয়। এ ঘটনায় তিনি মামলা দায়ের করেন। মামলা করার পর থেকে হামলাকারী ও তাদের প্রতিবেশী গ্রামবাসী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি দিতে থাকে। সজল রাজি না হলে তার বাড়িতে হামলা চালানো হয়। প্রাণনাশের আশঙ্কায় সজল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছেন।
চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অমিত হোড় শুনানিতে বলেন, ‘১১ অক্টোবর রাতে তাদের মণ্ডপে প্রতিমা নেয়ার সময় স্থানীয় ফলের আড়ত থেকে ফল ছুঁড়ে প্রতিমার হাত ভেঙে দেয়া হয়।’ চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য ও সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন নগরীর জে এম সেন হল পূজামণ্ডপে হামলার বিস্তারিত বিবরণ দেন। গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা অধিকাংশই হামলার সময় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গাফিলতির অভিযোগ করেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়