কোহলির সেঞ্চুরি : আফগানদের ওপর ঝাল মিটাল ভারত

আগের সংবাদ

ভারতের সাত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ঢাকায় আমন্ত্রণ : উত্তর-পূর্বের সঙ্গে সংযোগে গুরুত্ব

পরের সংবাদ

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-মর্যাদা কোথায়?

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ৩ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা গঠন বা অভিষেকের খবরটি ৭ সেপ্টেম্বর আলোচিত খবর হিসেবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পরিবেশিত হয়েছে। এরই মাঝে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির জরুরি সভাও গত সোমবার ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নিয়ে আরো খবরাখবর পত্র-পত্রিকায় আসছে। ৪ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কমিটিগুলোর স্বীকৃতি বা অভিষেক উপলক্ষে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বিশেষত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. ওবায়দুল কাদেরকে প্রধান অতিথি করে ৩ সেপ্টেম্বর একটি সম্মেলেন করেছে। সম্মেলনে অন্যান্য অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া। ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে আল-নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য তাদের সহযোগিতা ও আশীর্বাদ দিয়েছেন।
শাখা কমিটি হয়েছে জানলাম কিন্তু একটি বিস্ময় প্রকাশ না করে পারছি না। আমাদের কালে ও পরবর্তীকালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিকে একটি জেলা কমিটির পূর্ণ মর্যাদা দেয়া হতো। এখন দেখছি ১০৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে ছাত্রলীগের একটি ইউনিট গঠন করা হয়েছে। উচ্চাসীনরা মুখে মুখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সমান মর্যাদা দিলেও বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অতিরিক্ত সচিবের পদে নামিয়ে আনা হয়েছে। অথচ শিক্ষা কমিশন অনুসারে তাদের পদমর্যাদা কমপক্ষে সচিবের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে কয়েকজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেকশন গ্রেড প্রফেসর যোগ দেয়ায় নিয়ন্ত্রক সচিবরা তাদের সে চোখে দেখতেন। এখন সরকারি অনুষ্ঠানাদিতে তাদের সন্তানরা তাদের সামনের সিটগুলোতে বসতে পারছেন; কেননা তারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য বলছেন, ‘এক বছরে অনেক কিছু দেখলাম। উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম। এখন সব মানুষই আমাকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের সমমর্যাদার মনে করে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড প্রফেসরের পদ থেকে এসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে এখন আমি হতাশাগ্রস্ত। অনেকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ যখন বোর্ড সদস্যরা দিয়ে থাকেন, তখন তাদের পদমর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কী আছে? ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষদের নিয়োগে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ তিনজনের নাম প্রস্তাব করার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি যৌথভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সিভিলিয়ানদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের পদমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই হয়তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদমর্যাদার।’ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে উপাচার্যদের পদমর্যাদা সচিবদের পদমর্যাদার সমান আছে। উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদমর্যাদা ছিল অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিবের সমকক্ষ। সরকারি-বেসরকারি কোনো ফারাক ছিল না। আরো বহুভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদমর্যাদা নিম্নগামী, দায়ী অনেকে। শেষ বাণটি ছুড়ল কতিপয় শিক্ষার্থী তাদের আপন স্বার্থে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রফেসর আমন্ত্রিত হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবলমাত্র নির্বাচিত উপাচার্যরা আমন্ত্রিত হয় এবং তাদের বসতে দেয়া হয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পেছনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বিশেষ বিবেচনায় প্রথম সারিতে বসতে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যরাও প্রথম সারিতে বসেন। তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান কেন আমন্ত্রিত হবেন না এবং প্রথম সারিতে বসতে পারবেন না? তারা কেন বিমানবন্দরসহ অন্যত্র ভিআইপি মর্যাদা পাবেন না? এ মর্যাদার অবনতির কারণেই হয়তো অধিক পরিমাণ বেতন-ভাতাদি দিয়েও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদে প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ মানুষ শুধু টাকার জন্যই কাজ করে না। বর্তমান অবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদার হওয়াতে উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদমর্যাদা হলো যথাক্রমে যুগ্মসচিব ও উপসচিব। এই হিসেবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকরা হলেন সরকারি কলেজের অধ্যাপকদের সমান অর্থাৎ ডেপুটি সেক্রেটারি। তদুপরি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের কতিপয় ধারা লঙ্ঘনের কারণে উদ্যোক্তা হতে শুরু করে রেজিস্ট্রার, হিসাব পরিচালক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের ৫ বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা বা উভয় দণ্ড প্রদানের বিধান আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৪৯ ধারায় ‘অপরাধ, আমলযোগ্যতা ও দণ্ড’ শিরোনামে বলা হয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তি ধারা ৩(২), ৩(৩), ৬(৯), ৬(১০), ১২, ১৩(২), ৩৫(১), ৩৯, ৪৪(৫), ৪৪(৬) ও ৪৪(৭), ৪৫(২), ৪৬(২), ৪৬(৩), ৪৬(৬) বা ৪৭-এর বিধান লঙ্ঘন করিলে উক্ত লঙ্ঘন এই আইনের অধীন একটি অপরাধ বলে গণ্য হইবে এবং তজ্জন্য তিনি অনূর্ধ্ব ৫ বছর কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ এক্ষণে উল্লিখিত ধারাগুলো স্মরণও উল্লেখযোগ্য। আইনের ৪৯ ধারায় উল্লিখিত ৩ ধারার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনা’ করার বিধান এবং ৩(২) উপ-ধারায় ‘বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও ডিগ্রি প্রদানে অনিয়ম ও জালিয়াতির’ জন্য শাস্তির বিধান আছে। উদ্যোক্তা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের জন্য শাস্তির বিধান আইনের ৬ ধারায় ‘সাময়িক অনুমতির শর্তাবলি’ শিরোনামে গ্রন্থিত হয়েছে।
উপধারা ৬(৯) ও ৬(১০) এর ব্যত্যয় ঘটালে শাস্তি বা জরিমানার ব্যবস্থা আছে। ধারা ১২ হচ্ছে ‘সনদপত্রের শর্তপূরণে ব্যর্থতার ফলাফল’; ধারা ১৩ হচ্ছে ‘অনুমোদিত ক্যাম্পাস’ যার (২) উপধারার ব্যত্যয়ে একই আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। তেমনিভাবে ধারা ৩৫(১) ‘শিক্ষা কার্যক্রম ইত্যাদি’তে অর্পিত দায়িত্ব এবং ধারা ৩৯টিতে ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের কোর্স পরিচালনা বা ক্যাম্পাস স্থাপন’, ৪৪-এ ধারায় ‘সাধারণ তহবিল সম্পর্কিত বিধান’ এবং ৪৫ ধারায় ‘হিসাবরক্ষণ ও নিরীক্ষা’, উপধারা ৪৬-এ ‘পরিদর্শন’ যাতে বিভিন্ন বেআইনি কাজের ও অনিয়মের পরিদর্শনসহ রিপোর্ট প্রকাশ ও তদভিত্তিক শাস্তির কথা আছে এবং ধারা ৪৭-তে আছে এই আইন কার্যকর হইবার পূর্বে সাময়িক অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রযোজ্য সব বিধান। চিন্তা ও অনুসন্ধান করে দেখতে হবে এ ধারার কারণেও কি উপাচার্য, উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে কাক্সিক্ষত সংখ্যা ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে? তারা অপরাধ না করেও কতিপয় টেকনিক্যাল ট্র্যাপে পড়ে গিয়ে এসব জরিমানা ও জেলের সম্মুখীন হতে পারেন। এসব ক্রমেই সবার নজরে আসার পর অনেকেই উপযুক্ত অবস্থানে পা ফেলতে রাজি হচ্ছে না, এমনকি ভবিষ্যতে উদ্যোক্তার অভাবও সৃষ্টি হবে।
ইউজিসি প্রসঙ্গে কিছু কথা জমা আছে। ইউজিসির প্রশাসন কাঠামোতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব নেই, যদিও তার শীর্ষ প্রকাশিত পদে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ডিন ও অধ্যাপকদের অবস্থান রয়েছে। ইউজিসির কমবেশ ডজন দেড়েক ব্যাপারে অর্থাৎ ডিগ্রির সমতা বিধান, ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন ও কোলাবরেশন, ইউজিসি ফেলোশিপ, কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, গবেষণা স্কলারশিপ, ইউজিসি প্রফেসরশিপ, একাডেমিক গবেষণা মঞ্জুরি, ইউজিসি পিএইচডি ফেলোশিপ, গবেষণা, শিক্ষাসহায়ক পদকে ইউজিসির মেধাবৃত্তি, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বৃত্তি, বেগম রোকেয়া চেয়ার, প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ইউজিসি স্বর্ণপদক, পোস্ট ডক্টরেল ফেলোশিপ ও পুস্তক প্রকাশনা জাতীয় কর্মকাণ্ডে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রবেশাধিকার নেই বা নামমাত্র প্রবেশাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এমতাবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ উপাচার্য, ৭৫ উপ-উপাচার্য ও ৪২টি কোষাধ্যক্ষ পদ শূন্য থাকা তেমন কোনো অবহেলাজনিত বা বিস্ময়কর ঘটনা নয় বলে ধারণা করাটা কি অসঙ্গত হবে?

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়