বাম গণতান্ত্রিক জোটের হুঁশিয়ারি : দমন-পীড়ন করে গদি রক্ষা করা যাবে না

আগের সংবাদ

চার কারণে ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয়

পরের সংবাদ

হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ : পিবিআই প্রধানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন বাবুল আক্তারের

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম অফিস : ‘স্বীকারোক্তি আদায়ে’ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করেছেন স্ত্রী হত্যার ঘটনায় বাদী থেকে আসামি হওয়া সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে আদেশের জন্য আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারণ করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বেগম জেবুননেছার আদালতে মামলার আবেদন করা হয়।
মামলার আবেদনে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা হলেন- পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার, পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার মো. নাজমুল হাসান, মেট্রোর পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা, পিবিআই’র সাবেক পরিদর্শক বর্তমানে খুলশী থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা ও বর্তমানে সহকারী পুলিশ কমিশনার (পাহাড়তলী জোন) একেএম মহিউদ্দিন সেলিম এবং পিবিআই’র জেলা পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবির। নির্যাতনে এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫ (১) এবং ৫ (২) ধারায় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণের আবেদন করেছেন বাদী বাবুল আক্তার।
অভিযোগে ঘটনার সময় উল্লেখ করেছেন ২০২১ সালের ১০ মে সকাল পৌনে ১০টা থেকে ১৭ মে বেলা ১টা পর্যন্ত পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো অফিস। স্ত্রী হত্যার ঘটনায় মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য বাবুল আক্তারের ওপর নির্যাতন করা হয় উল্লেখ করে অভিযোগ করা হয়। বাবুল আক্তার এখন কারাবন্দি থাকায় মামলার আবেদনে স্বাক্ষর করতে পারেননি। তার পক্ষে আইনজীবী গোলাম মওলা আবেদনটি আদালতে দাখিল করেন। মামলার আবেদনে স্বাক্ষর এবং ২০০ ধারায় জবানবন্দি নেয়ার জন্য বাবুলকে আদালতে হাজিরেরও আবেদন করেছেন আইনজীবী।
মামলার আবেদনে বলা হয়েছে, স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুলের দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা তাকে হোয়াটস অ্যাপে কল দিয়ে বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশের কথা বলে পিবিআই অফিসে আসার জন্য বলেন। ১০ মে তিনি চট্টগ্রামে পৌঁছে পিবিআই অফিসে সন্তোষের কক্ষে যান। সেখানে সাতজনকে আসামি করে একটি খসড়া অভিযোগপত্র তাকে দেখান সন্তোষ। পরে তাকে এসপি নাঈমা সুলতানার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জেলার এসপি নাজমুল হাসানসহ ১০-১৫ জন অফিসার ছিলেন। নাজমুল বাবুলকে বলেন, ‘তোমাকে আমার অফিসে যেতে হবে। বনজ স্যারের নির্দেশ।’
সন্তোষ ও মহিউদ্দিন সেলিম বাবুলকে জোরপূর্বক দুইতলা থেকে নিচে নামিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে মেট্রো অফিস থেকে খুলশীতে পিবিআইয়ের জেলা অফিসে নিয়ে যান। সেখানে তাকে একটি কক্ষে রাখা হয়। বাবুল মোবাইল বের করে তার ভাই সাহাবুল হকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এসপি নাজমুল মোবাইল কেড়ে নেন। বাবুল জানতে চান তাকে কেন সেখানে নেওয়া হয়েছে। তখন নাজমুল বলেন, ‘এবার তোরে মজা দেখাব। কোনো বাপ এবার তোরে বাঁচাতে পারবে না।’ এরপর এনায়েত কবীর কিছুক্ষণ গালিগালাজ করেন। মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘বনজ স্যার চাইলে বাঘে মহিষে একঘাটে পানি খায়। আপনি কোনোভাবে বাঁচতে পারবেন না। আপনাকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতেই হবে। না দিলে আরো বড় বিপদে পড়বেন। আপনার পরিবারের সদস্যদের ডিস্টার্ব করব।’ তখন বাবুল কান্না করতে থাকেন।
আবেদনে আরো অভিযোগ করা হয়েছে, ৫৩ ঘণ্টা পিবিআই অফিসে আটকে রেখে সাদা কাগজে ও বিভিন্ন বইয়ের পাতায় বাংলা ও ইংরেজিতে নাজমুল ও নাঈমার বলা বিভিন্ন কথা সন্তোষ কুমার চাকমা বাবুলকে লিখতে বাধ্য করেন। ১০ মে সন্ধ্যায় সন্তোষ আবার বাবুলের কক্ষে ঢুকে বলেন, ‘আপনার মামলা শেষ। আপনার বিরুদ্ধে এখন নতুন মামলা হবে। বনজ স্যার আপনার শ্বশুরের বাসায় পিবিআইয়ের গাড়ি পাঠিয়েছে। আপনার শ্বশুর আসলে তাকে দিয়ে আপনার বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেয়া হবে। আপনি যদি এখন বলেন, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেবেন, তাহলে আপনাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে না। না দিলে জবানবন্দি কীভাবে নিতে হয় আমাদের জানা আছে।’ এরপর নাঈমা, নাজমুল ও একেএম মহিউদ্দিন সেলিম গিয়ে তাকে আবার ভয়ভীতি দেখান।
বাবুলের অভিযোগ, ১০ মে থেকে ১২ মে বেলা ১টা পর্যন্ত তাকে একটি কক্ষে আটকে রেখে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নানা প্রলোভনও দেখানো হয়। বেলা ১২টার দিকে তাকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা ছাড়া কেউ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে না। অথচ পিবিআই টিম গঠন করে জিজ্ঞাসাবাদের নামে বাবুলের সঙ্গে নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করে। বাবুলকে চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরিয়ে রাখা হতো। কয়েক ঘণ্টা পর পর এক রুম থেকে আরেক রুমে নিয়ে যাওয়া হতো। অফিসারদের কথোপকথনে বাবুল জানতে পারেন, তাকে কীভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে সেটা ঢাকায় বসে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করছেন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কেউ তার মাথার বাম পাশে, কেউ ডান পাশে ধাক্কা দিত, কেউ এসে পেছন থেকে চেয়ারে লাথি মারত এবং অশ্লীল গালিগালাজ করতো বলে বাবুলের অভিযোগ।
আবেদনে আরো বলা হয়, ১৫ মে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় পিবিআই’র এক অফিসারের মাধ্যমে বাবুল জানতে পারেন তাকে যেসব অফিসাররা শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, তাদের দক্ষিণাঞ্চলের দূরবর্তী জেলায় বদলি করে দেয়া হয়েছে। এরপর তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে দুর্বল হয়ে তিনি চেয়ার থেকে পড়ে গেলে তাকে উঠিয়ে চেয়ারের দুই হাতলে হাতকড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এ সময় পিবিআই অফিসারদের তিনি বলতে শোনেন, ‘বনজ স্যারের নির্দেশ- শরীরে দাগ পড়ে এমন নির্যাতন ছাড়া, সব নির্যাতন করা যাবে।’
বাবুল মামলার আবেদনে অভিযোগ করেছেন, পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের প্ররোচনায় ও নির্দেশে বাকি পুলিশ কর্মকর্তারা ১০ মে সকাল ১০টা থেকে ১২ মে দুপুর ১টা পর্যন্ত তাকে অন্যায়ভাবে আটকে রেখে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ভয়ভীতি দেখায়, লাঞ্ছিত করে এবং নির্যাতন করে। তিনি পুলিশ নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থার বাইরে অন্য কোনো সংস্থা দিয়ে অভিযোগের তদন্ত দাবি করেছেন আবেদনে।
বাবুল আক্তারের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, ‘স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় বাবুল আক্তারকে রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তার ওপর নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ গ্রহণ করে আদালত আদেশের জন্য আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর দিন নির্ধারণ করেছেন।’

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মিতুকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিতে ওই সময় ঢাকায় ছিলেন বাবুল আক্তার। হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন বাবুল। আদালতের আদেশে পরে মিতু হত্যা মামলা যায় পিবিআই’র হাতে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় গত ১১ মে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রাম পিবিআই কার্যালয়ে ডেকে নেয়া হয়। এর পরদিন ১২ মে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মিতু হত্যার সঙ্গে তার স্বামী বাবুল আক্তারের ‘সম্পৃক্ততার প্রমাণ’ পেয়েছেন তারা। সেদিনই চট্টগ্রামে আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন পিবিআই’র পরিদর্শক মামলার তৎকালীন আইও সন্তোষ কুমার চাকমা। এরপর ওইদিনই পাঁচলাইশ থানায় মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন একটি হত্যা মামলা করেন।
পিবিআই হেফাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে ১২ মে মোশাররফের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর আদালতে গ্রেপ্তার ভোলাইয়া, বাবুলের ঘনিষ্ঠ সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং আসামি মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের দেয়া জবানবন্দিতে বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য আরো জোরাল হয়। তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এসব জবানবন্দির এক পর্যায়ে নিজের মামলায় পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেন বাবুল আক্তার।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর শুনানি শেষে আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ফলে মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলাটির পাশাপাশি করা বাবুল আক্তারের মামলাটিও সক্রিয় হয়ে যায়। দুই মামলার সমান্তরাল তদন্তভার এসে পড়ে পিবিআইয়ের ওপর।
ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারকে তার নিজের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মঞ্জুর করে বাবুলকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়