বাম গণতান্ত্রিক জোটের হুঁশিয়ারি : দমন-পীড়ন করে গদি রক্ষা করা যাবে না

আগের সংবাদ

চার কারণে ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয়

পরের সংবাদ

বিভূতিভূষণ : গ্রামীণ জীবনের অসামান্য

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতির মতো অসামান্য সব উপন্যাসের রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখির জীবন ছিল স্বল্প। মাত্র ২৮ বছর। এই লেখকের আয়ু ছিল মাত্র ৫৬ বছর। সনাতন গ্রামবাংলার জনজীবনের চিরায়ত ছবি তিনি এঁকেছেন নিপুণ, দক্ষ শিল্পকুশলতায়। গভীর মমতায়, শ্রমে তিনি এই কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। কথাশিল্পী হিসেবে আশ্চর্যরকম সফল তিনি। গ্রামীণ জীবনের শান্ত, সরল, স্নিগ্ধ ও বিশ্বস্ত ছবি ফুটে ওঠে তার নিরাসক্ত কথকতা ও বয়ানে, চুম্বকের মতো টেনে নেয় পাঠককে। যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। মারা যান ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর।
তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে ১৫টি উপন্যাস, সাতখানা কিশোর উপন্যাস, দু’শর বেশি ছোটগল্প। ১৫টি উপন্যাসের মধ্যে একটি ছিল অসমাপ্ত। শিশু-কিশোর উপন্যাসের মধ্যে তিনটি হলো বয়স্ক পাঠ্য উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ। এসবের বাইরে অন্যান্য বিষয়েও তিনি লিখে গেছেন। সেগুলোর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, ডায়েরি, প্রবন্ধ, অনুবাদ। ব্যাকরণ বইও তিনি লিখেছেন।
‘পথের পাঁচালী’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনন্য কীর্তি। বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায় এটির সফল চলচ্চিত্রায়ন করেন। ফলে এই উপন্যাসের খ্যাতির পরিধি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিভূতিভূষণ সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেন এই উপন্যাসটির মধ্য দিয়েই। এটিই তার প্রথম উপন্যাস, একই সঙ্গে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ’ও। ‘পথের পাঁচালী’’ প্রথমে ধারাবাহিকভাবে বের হয়েছিল মাসিকপত্র ‘বিচিত্রা’য়। এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল এতে। বই আকারে এটি ছাপা হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে। এ বই বেরুবার আগে সাময়িকপত্রে এই লেখকের কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে সামান্য পরিচিতি ছিল তখন।
সেই সময় এ বিশাল আয়তন উপন্যাসের প্রকাশক জোগাড় করার কাজটি সহজ ছিল না। ঝুঁকি নিয়ে এ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। তার নিজস্ব কোনো প্রকাশনা সংস্থা ছিল না। শুধু এ বইটা বের করার জন্যই তিনি ‘রঞ্জন প্রকাশালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পথের পাঁচালী’ বই হিসেবে বেরুবার আগেই বিচিত্রা পত্রিকায় এর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতে থাকে। সেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, বইটির দাম রাখা হবে তিন টাকা। বিজ্ঞাপন ছিল এরকম : ‘শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বাঙলা ভাষায় সম্পূর্ণ নূতন ধরনের উপন্যাস। শিশুমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্য ইতিপূর্বে আর কেহ এদেশে এরূপভাবে উদ্ঘাটিত করেন নাই; অন্য দেশেও কেহ করিয়াছেন কি না আমাদের জানা নাই। উপন্যাসখানি ‘বিচিত্রা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতেছে। ইতিমধ্যেই সাহিত্য-রসিক মহলে ইহার সম্বন্ধে বিস্তর আলোচনা হইয়াছে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’ এই ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি ভারতের বিভিন্ন ভাষা, ইংরেজি, ফরাসিসহ পাশ্চাত্যেও বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত অন্যান্য উপন্যাস হচ্ছে- দৃষ্টি-প্রদীপ, আদর্শ হিন্দু-হোটেল, দুই বাড়ী, বিপিনের সংসার, অনুবর্ত্তন, দেবযান, কেদার রাজা, অথৈ জল। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় দম্পতি, অশনি-সংকেত এবং অনশ্বর। এর মধ্যে অনশ্বর নামের উপন্যাসটি ছিল অসমাপ্ত। ছোটদের জন্য যে সাতটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি, সেগুলো হচ্ছে- চাঁদের পাহাড়, মরণের ডঙ্কা বাজে, মিসমীদের কবচ, ছোটদের পথের পাঁচালী, আম-আঁটির ভেঁপু, ছেলেদের আরণ্যক এবং হীরামানিক জ¦লে।
ভ্রমণ কাহিনীগুলো হচ্ছে- অভিযাত্রিক, বনে-পাহাড়ে, হে অরণ্য কথা কও। ছোটগল্প সংকলনগুলোর নাম- বিভূতিভূষণের ছোটগল্প, ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প, গল্প পঞ্চাশৎ, সুলোচনা, প্রেমের গল্প, অলৌকিক, বিভূতি-বিচিত্রা, বাক্সবদল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিশোর-সঞ্চয়ন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটদের ভালো ভালো গল্প এবং বিভূতি বীথিকা। ইছামতী উপন্যাসের জন্য তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারেও সম্মানিত করা হয় ১৯৫১ সালে (মরণোত্তর)। এটি পশ্চিবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার (লেখকের জন্মস্থান) পারমাদান বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের নাম লেখকের সম্মানার্থে রাখা হয়েছে ‘বিভূতিভূষণ বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম’।
যখন জঙ্গলমহালে কর্মরত ছিলেন, তখনই ভেবেছিলেন অরণ্যজীবনসংশ্লিষ্ট কাহিনী লেখার কথা। অনেকে মনে করেন, ‘আরণ্যক’ হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠ লেখা। ‘স্মৃতির রেখা’ নামের দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন
‘…এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো- একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি। এই বন, নির্জ্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ-হারানো অন্ধকার- এই নির্জ্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপড়ি বেঁধে থাকা। মাঝে মাঝে, যেমন আজ গভীর বনের নির্জ্জনতা ভেদ করে যে শুঁড়িপথটা ভিটে-টোলার বাথানের দিকে চলে গিয়েছে দেখা গেল, ঐ রকম শুঁড়িপথ এক বাথান থেকে আর এক বাথানে যাচ্ছে- পথ হারানো, রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া করে ঘোরা, এদেশের লোকের দারিদ্র্য, সরলতা, সন্ধ্যায় অন্ধকারে ভরা গভীর বন ঝাউবনের ছবি- এই সব।’
বিভূতিভূষণের পৈতৃক নিবাস ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বারাকপুরে। তার জন্ম মাতুলালয় মুরাতিপুর গ্রামে। শৈশব থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটেছে। ক্লাসে প্রায় সব সময়ই প্রথম স্থান অধিকার করতেন। প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করেন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে বি. এ. পাস করেন। তারপর ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, একই সঙ্গে দর্শন ও আইন বিভাগে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোনোটাই সমাপ্ত করা হয়নি আর। যখন ছাত্র ছিলেন, তখন ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের বছরখানেক বাদে স্ত্রী গৌরী মারা গেলেন নিউমোনিয়ায়। এর কিছুদিনের মধ্যেই ছোট বোন মণির মৃত্যু ঘটে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে। এই দুটি মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি মারাত্মক আঘাত পেলেন মনে। ধারণা করা হয়, তার পরলোকে বিশ্বাস, পরলোকতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা এবং চর্চার কারণ হচ্ছে ওই দুটি বিয়োগান্তক ঘটনা। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর দীর্ঘ ২২ বছর পরে আবার বিয়ে করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নানা ধরনের চাকরি করেছেন তিনি। তবে সময়ের হিসেবে শিক্ষকতাই করেছেন বেশি। হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। সেটাই তার প্রথম চাকরি। পদ : সহকারী প্রধান শিক্ষক। ‘গো রক্ষিণী সভা’র প্রচারক হিসেবেও চাকরি করেছেন। দেশে গো সম্পদ সুরক্ষা করার কাজটি যে কতটা দরকারি, সে বিষয়ে জনমত সৃষ্টি ছিল এই প্রচারকের লক্ষ্য। খুব বেশিদিন এই চাকরিতে থাকেননি। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ববঙ্গ, ত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের অনেকটা অঞ্চল ঘুরে বেড়ানো হয়ে যায়। তার পরের চাকরিও ভিন্নরকম। এবারে চাকরি নেন খেলাতচন্দ্র ঘোষ এস্টেটে। পাথুরিয়াঘাটার জমিদার ছিলেন এই খেলাতচন্দ্র। তার পৌত্র সিদ্ধেশ্বর ঘোষের আমল চলছিল তখন। বিভূতিভূষণ ওই বাড়িতে প্রবেশ করেন গৃহশিক্ষকের কাজ নিয়ে। এই জমিদারদের তালুক ছিল বিহারের ভাগলপুরে। সেখানকার জঙ্গল মহালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। পরে কলকাতার ধর্মতলায় খেলাতচন্দ্র ক্যালকাটা ইনস্টিটিউশন বিদ্যায়তনের শিক্ষকতা করেন। বিভিন্নভাবে এদের সঙ্গে বিভূতিভূষণ যুক্ত ছিলেন অনেক দিন পর্যন্ত, ১৯২৩ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘বিভূতিভূষণকে যেমন দেখেছি’ শিরোনামের লেখাটি মুদ্রিত হয়েছে বিভূতি রচনাবলী দ্বাদশ খণ্ডে। কলকাতার মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স থেকে এই রচনাবলি প্রকাশিত হয় ১৩৮৭ বঙ্গাব্দে। অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন,
‘এমন প্রকৃতি-পাগল সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে বিরল। প্রকৃতিকে চোখে দেখে ভালো লাগে না কার? কিন্তু তাকে ভালোবেসে তার গভীরে অবগাহন করা অন্য জিনিস। বিভূতিকে সেই জন্যে বছরে কয়েক মাস অরণ্যবাস করতে হতো। আর কয়েক মাস পল্লীর কোলে কাটাতে হতো। ইছামতী নদীর কূলে। তার জীবনের যুগল মেরু ছিল অরণ্য ও দক্ষিণায়ন। শহরে থাকলেও তিনি শহুরে ছিলেন না। কোনোদিন হতে চাননি। নাগরিক সভ্যতা তাকে বশ করতে পারেনি। তার পোশাকে-আশাকে নাগরিকতার লেশ ছিল না। বৈঠকখানায় তিনি বেমানান। চিড়িয়াখানায় যেমন চিড়িয়া।’
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অতীন্দ্রিয় জগৎ ও পরলোকতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। বিশ্বাস করতেন, মৃত্যু কেবল এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাওয়া, যা ইহলৌকিক জীবনেরই সম্প্রসারণ মাত্র। তার ব্যক্তিচরিত্র ও সৃষ্টিকর্মে মহাজাগতিক অনুভব ও বোধের বিচ্ছুরণ রয়েছে। মৃত্যুর আগে সাহিত্যিক বাণী রায়কে বলেছিলেন, ‘আমার বিষয়ে যখন লিখবেন তখন সবাইকে বলে দেবেন আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। সব ইচ্ছাই আমার পূর্ণ হয়েছে।… আমার কোনো আকাক্সক্ষাই অপূর্ণ নেই। আমি জীবনে তৃপ্ত হয়েছি।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়