বাম গণতান্ত্রিক জোটের হুঁশিয়ারি : দমন-পীড়ন করে গদি রক্ষা করা যাবে না

আগের সংবাদ

চার কারণে ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয়

পরের সংবাদ

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি বিশ্ব রাজনীতিতেও ভারত একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। তাছাড়া বিশ্বায়নের বিপুল বিস্তারের যুগে বাজার অর্থনীতির বিবেচনায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ১৩০ কোটি মানুষের একটি দেশ হিসেবে ভারত একটি অত্যন্ত বড় ‘বাজার’; তাই কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে ভারত পৃথিবীর মানচিত্রে একটি সমীহযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে ইতোমধ্যে। ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন এবং ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের মাত্রা কোন পর্যায়ে অবস্থান করে, তার নানান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। এসব বিষয় বিচেনায় নিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের মধ্যে বিশেষ করে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে একটা তুমুল আগ্রহ আছে। তাছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নানান অভিন্ন ইস্যু আছে (যেমন- ৪ হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত আছে, ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে এ রকম অনেক কিছু!) যার একটি স্থায়ী এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য দুটি প্রতিবেশী দেশ কী ধরনের অবস্থান নেয়, সেটাও মানুষের একটা বিশেষ আগ্রহের জায়গা। ঐতিহাসিকভাবেও বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ককে বাংলাদেশ সব সময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশ সব সময় ভারতকে একটা ঐতিহাসিক সম্পর্কের জায়গা থেকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক সব সময় একটা সৌহার্দপূর্ণ এবং বন্ধুভাবাপন্ন, সেহেতু আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তির হাতে ভারত বিরোধিতাও বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। আবার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধ-শিবিরে তীব্র ভারত বিরোধিতা আছে বলেই আওয়ামী লীগকে সতর্ক থাকতে হয়ে ভারতের সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে আলাপ-আলোচনা এবং সমঝোতা স্মারণ স্বাক্ষর করার বিষয়ে। কেননা ‘পান থেকে চুন খসলেই’ বিরুদ্ধ শিবির সমালোচনার ঝড় তোলে, আর ‘ভারতের কাছে বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’, কিংবা ‘ভারতের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বিলিয়ে দেয়া’ প্রভৃতি পুরনো কীর্তন বাজারজাত করে। তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সব সময়ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া সামনে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন। আমরা যতই রাখ-ঢাকের চেষ্টা করি না কেন, একটি বড় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে এবং প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের নানান রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। আর অর্থনৈতিক গুরুত্ব তো আছেই, কেননা যখনই কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের কোনো সফর হয়, সেখানে অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট থাকবে, এটা একবিংশ শতাব্দীর একটি অনিবার্য কূটনীতি। ফলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর অনেক দিক দিয়েই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে দুই দেশেই ইতোমধ্যে নানান আলোচনা, বিচার ও বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে এবং এ আলোচনা চলবে আরো কিছুদিন। আমি স্বাক্ষরিত সাতটি সমঝোতা স্মারক এবং ইতোমধ্যে করা যৌথ ঘোষণার আলোচনা দিয়ে এ নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করেছি। আমরা জানি দুই দেশের মধ্যে সাতটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যথা- (১) কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলনের জন্য সমঝোতা স্মারক, (২) বাংলাদেশ ও ভারতের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের মধ্যে সহযোগিতাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক, (৩) ভারতের ভোপালের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি ও বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, (৪) বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য সমঝোতা স্মারক, (৫) বাংলাদেশ ও ভারতের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, (৬) বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে ‘প্রসার ভারতী’র সমঝোতা স্মারক, (৭) স্পেস টেকনোলজি বা মহাকাশ প্রযুক্তি খাতে সমঝোতা স্মারক। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন স্মারকটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, কেননা এর দ্বারা বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের আসামের লোকজন উপকৃত হবে। অন্য স্মারকগুলো প্রধানত আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এবং রেল অপারেশনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি (ক্যাপাসিটি-বিল্ডিং) এবং জ্ঞান-শরিকের (নলেজ শেয়ারিং) কাজে সব ধরনের বিবেচনায় বাংলাদেশ উপকৃত হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ আগামী ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করছে। ফলে ৩ ও ৪ স্মারকের আওতায় রেলওয়ে কর্মকর্তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ বাংলাদেশের রেলওয়ের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। ২ ও ৭ স্মারকের আওতায় বাংলাদেশ নানাভাবে উপকৃত হবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্যাটেলাইটের যুগে প্রবেশ করেছে। এক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি ও জ্ঞান-শরিকের সুযোগ বাংলাদেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এসব স্মারকের বাইরেও দুটি বিষয়ে দুটি দেশ এক জায়গায় এসেছে; সেটা হচ্ছে জ¦ালানি ও নিত্যপণ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করা। আমরা জানি, বর্তমান বিশ্বে জ¦ালানি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য, যা যে কোনো অর্থনীতি এবং জীবনযাপনের জন্য একটি অনিবার্য উপাদান। ভারত বাংলাদেশকে জ¦ালানি সরবরাহের ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। আবার সংকটের সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহেরও আশ্বাস দিয়েছে ভারত। ভারতের নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে প্রয়োজনের সময় এবং সংকটের সময় বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের প্রতিশ্রæতি আমি মনে করি এ সফরের আরো একটি গুরুত্বপূণ অর্জন।
এসব স্বাক্ষরিত স্মারকের বাইরেও বাংলাদেশ ও ভারতের দেয়া যৌথ বিবৃতিতে আরো পাঁচটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে, যা সর্বোত বিচারে মোটাদাগে বাংলাদেশের পক্ষে গেছে। যেমন- (১) সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থল, নৌ, আকাশ ও সীমান্ত অঞ্চল, (২) নারী-শিশু পাচার, অস্ত্র, মাদক, ও জালমুদ্রা পাচার প্রতিরোধ একসঙ্গে কাজ করা, (৩) ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ত্রিপক্ষীয় মহাসড়কে বাংলাদেশকে যোগ দেয়ার আহ্বান, (৪) সীমান্তে মৃত্যুর হার শূন্যে নামিয়ে আনা এবং (৫) চাল, গম, আদা, পেঁয়াজ, ও রসুন প্রভৃতি নিত্যপণ্যের ব্যাপারে আগাম তথ্য আদান-প্রদান, যাতে হঠাৎ করে সংকটের মধ্যে পড়তে না হয়। এ যৌথ বিবৃতিতে এ রকম অনেক বিষয় এসেছে যেখানে বাংলাদেশ নানাভাবে লাভবান হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটা সফরেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। তাছাড়া পররাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্র কূটনীতি চলে স্বার্থের হিসাব-নিকাশে। প্রত্যেকটা রাষ্ট্র তার নিজের দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। এ রকম অবস্থায় নানা আলোচনা, ডায়ালগ এবং সমঝোতার মাধ্যমে কে কতটুকু আদায় করতে পারছে, সেটাই অর্জন। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে নানান অর্জনের হিসাব-নিকাশে সফল বলা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে একটা সুন্দর, সৌহার্দপূর্ণ এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাবাপন্ন একটা সম্পর্ক আছে এবং এ সম্পর্কের একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, সেটা নতুন করে সম্পৃদ্ধ ও মজবুত হয়েছে এ সফরের মধ্য দিয়ে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আওয়ামী লীগ বিরোধিতার নামে, ভারত বিরোধিতার যে চল বাংলাদেশে আছে সেটা কোনো কোনো সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ সফর দুদেশের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্কের জায়গাটিও নতুন করে মেরামত করেছে নিঃসন্দেহে।
তথাপি তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি আর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশে মানুষের একটা কৌতূহল ছিল, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট অবস্থান ভারত পরিষ্কার করেনি। কিন্তু এ বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে বিবেচনায় রাখার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের দীর্ঘ বছরের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে এবং মুক্তিযুদ্ধের কঠিন সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে আমরা ভারতের আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে চাই।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়