বাম গণতান্ত্রিক জোটের হুঁশিয়ারি : দমন-পীড়ন করে গদি রক্ষা করা যাবে না

আগের সংবাদ

চার কারণে ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয়

পরের সংবাদ

জহুরুল ইসলাম : ‘জলের আগুনে জ্বলে’র পাঠোন্মোচন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হৃদয় পোড়ায়ে যদি হৃদয়টা সোনাফলা হয়। তবে বলা যেতে পারে, কবি জহুরুল ইসলাম তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। তিনি আপাদমস্তক একজন ধ্যানমগ্ন কবি। ‘জলের আগুনে জ¦লে’ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ নভেম্বর, ২০২১-এ বুনন প্রকাশন থেকে বের হয়েছে। এ কাব্যের প্রথম কবিতার নাম ফেরা। কবিতায় তিনি পাঠক হৃদয়ের কাছে আকুল অবেদন নিয়ে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে চান। আমরা কোথা থেকে আসি আর কোথায় ফিরে যাই। এ ফেরা কখনো মায়ের কোলে কখনো মাটির কোলে অথবা চিতায়। এ যেন চিরদিনের জন্য ফেরা, মানুষের মনের কাছে ফেরা। ফেরা শব্দটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কবির কাছেও তাই। কবিরা তো আলোর দিশারী। তারা জীবনের সত্যদ্রষ্টা। জীবনকে দেখে আলাদা সত্তায়। যা সবার থেকে ভিন্ন। কবি তার হৃদয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় ‘ফেরা’ কবিতাটি পাঠকের কাছে তুলে ধরেন। তিনি বলেন : হিমজমাট যন্ত্রণা রক্তের ভেতর খেলে যায়, মেঘের জলের থেকে তাপ এসে নামে, যন্ত্রণার আগুন জ¦লে ওঠে হৃদয়ের ভাঁজে ভাঁজে; এতসব যন্ত্রণা থেকে কবি ফিরে যেতে চান। ফিরে যেতে চান কুসুমের কোমল হৃদয়ের কোলে। যেখানে সুখ এসে খেলা করে প্রজাপতির সঙ্গে, বসন্ত শরীরে। এমন জায়গায় কবি নিজেকে বাঁধতে চান। কবিতায় তিনি বলেন : যন্ত্রণার অপর নাম পাথর, বরফ জমাট তাপ বা আগুন- কঙ্কাল আবার কখনো রক্তের ভেতর কষ্টের দহন। এ কষ্ট-যন্ত্রণা-কাতরক্লিষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে কবি পুষ্প চন্দনের কোমল হৃদয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চান। কবিতায় বলে ওঠেন-
‘এ জলে আগুন জ¦লে
পথে ঘাটে
পাষাণ পাথরে
কুসুমের কোমল হৃদয়ে।’

কবি তার আরাধ্য দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছেন হৃদয়ের সবকিছু নিংড়ে দিয়ে। তিনি ‘চিরকাল ঘুমায় এবার’ কবিতায় পাঠকের কাছে নিবেদন রাখেন : যে পথে স্বপ্ন ভেঙে যায়, পথের কিনারে ঝলমলে রোদ্রের ভেতর অন্ধকার ভাসে, পথের ধারে ছেঁড়া ফুল হাতছানি দেয় অথবা বাইরে কান্নার ঢেউ ভেসে আসে, সে পথ আমার নয়। কবি তার কবিতায় কাব্যদেবীর কাছে প্রার্থনা করেছেন, এসব যেন আমি দু’চোখ মেলে না দেখি। এতসব আধার, ছেঁড়াফুল, কান্নার ঢেউ যেন জীবন নদীর বাঁকে কিংবা পথ চলতে কবি এসব না দেখে চিরকাল ঘুমাতে চেয়েছেন। তিনি মিনতি করেছেন-
‘তরাসে বাতাসে
বুক তার হিম হয়ে আসে।
আঁখি দুটি তার
চিরকাল ঘুমায় এবার।’

উত্তরের হাওয়ায় বেদনার সুর হৃদয়কে ব্যথিত করে। এ আভাস মানুষের অন্তর থেকে অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। রমণীর কোমল স্পর্শেও এ হাওয়া বেদনায় মথিত করে। সবুজ পাতার বুকে মূর্ছনার সেতার বেজে ওঠে। পাখির কল্লোল থেমে যায়। বধূয়ার বুক কেঁপে ওঠে। মৃত্যুর উল্লাস জেগে ওঠে। সুখের সীমানা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই কবি তার মনের সব সুর ঢেলে দিয়ে ‘উত্তরের হাওয়া’ কবিতায় আহাজারি করেন-
‘বহুদূর দেশে যেই পাখি
রেখেছিল ভালোবাসা তার-বুকের পালকে ঢাকি-
সেও আজ যাযাবর,
ফেলে দিয়ে সব তার সাধের সংসার বাড়িঘর।

তবুও মানুষ তার মৃত্যুর উল্লাসে
দেহের স্বাদ মিটায় তার।’

মানুষের জীবন বৈচিত্র্যময়। আজীবন স্বপ্নের ঢেউয়ে ভেসে চলে। এখানে প্রাপ্তির ঢেউ থাকে, আনন্দের ঢেউ থাকে, কষ্টেরও ঢেউ থাকে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে পৃথিবীর জীবন পরিপূর্ণ। সবাই ঢেউয়ের তালে ভাসমান। কবির জীবনও ঢেউয়ের সমান বয়সি। ঢেউ গুণে চলে। ঢেউ কবিতায় কবি সুনামিকে কষ্টের সঙ্গে তুলনা করেন। কবি বলেন : প্রবল একটা যন্ত্রণার ঢেউ, পৃথিবীর পোড়া দেহের ঢেউ, সোনালি চাঁদ ডোবা ঢেউ, তীব্র জলোচ্ছ¡াসের ঢেউ; জীবনকে পোড়ায়। যা চিতার আগুনে পোড়া ভস্মের মতো। তারপরও কবি আশাবাদী। পরিশেষে কবি জহুরুল ইসলাম ‘ঢেউ’ কবিতায় আশার ভেলায় চড়ে বলে ওঠেন : মায়াবী রাতের কোলে যে ঢেউ জাগে, স্বপনের মাঠে যে ঢেউ জাগে, শিশিরের স্নেহে যে ঢেউ জাগে; সে ঢেউয়ের কোলে মাথা রেখে আদরে সোহাগে জীবন কাটাতে চান। কবি তাই চরণে চরণে ব্যক্ত করেন-
‘চাঁদের আগুনে পোড়া পৃথিবীর দেহ
লোনাজলে ভেসে যায়।
দোলনার মতো দোলে স্বপ্নের মাঠ-

জহুরুল ইসলাম সুখ কবিতায় বলেছেন, সুখের জায়গা- নিঝুম রাত্রির কোলে, অঘোর ঘুমের নেশায়, বাতাসের শরীরে আবার মাঠের ঘাসে, সবুজ শ্যামল পাড়ায়। সুখের নেশা কবির আজীবন নেশা। এ নেশায় কবি তার কবিতায় মনপদ্মে তুলে ধরেছেন, অসুখের কালো থাবায় সুখ নেই, সুখ আছে মনের আবেগে, প্রেমে, আদর-সোহাগে, মায়ের আঁচলে। কবি এ কবিতায় নিবেদন করেছেন-
‘সুখ উঠে এসো
এখানে এই মাঠের ঘাসে,
ওই দূর জনপদে আর
শ্যামল পাড়ার পাশে।’

সবার হৃদয়েই ঋতুচক্র বিরাজ করে। কখনো দুঃখ, কখনো আনন্দ আবার কখনো হাসি-কান্না একই সঙ্গে আসে। এ যেন ষড়ঋতুরই আসা-যাওয়া। কেউ বুঝতে পারে কেউ পারে না। কবি তার ‘বসন্তের মাঠ’ কবিতায় উল্লেখ করেন স্বপ্নগুলো বসন্তের মতো, গোপন জানালায় খেলা করে, ঘর বাঁধে, কখনো উড়ে যায়, কখনো বসে থাকে। এ যেন বসন্তের নিত্য আসা-যাওয়া। কবি তার হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন, বসন্ত মাদার ফুলের মতো টকটকে রঙিন, দিনরাত মুখরিত মাঠ, রেণুমাখা স্বপ্নের আহ্লাদ। অতঃপর এই বসন্তও যেন লজ্জাবতী, অনিষ্টের ভাঁজ হয়ে লুকিয়ে যাওয়া, ফের ফিরে আসে- আবার এই মাঠ। এই বসন্ত সবার কাছে কাক্সক্ষার, বাসনার ও কামনার। এ কাব্যে এ ধরনের আরো দুটি কবিতা রয়েছে : বসন্ত আগুন ও পূর্ণিমার চাঁদ। তাই এ কবিতায় উচ্চারিত হয়-
‘বসন্তবেলায় ভালোবাসি
এই সব মাঠ, ধ্বনি
রেণুমাখা স্বপ্নের আহ্লাদ।’

আমি বলি, নদী; জীবনের মতো। কখনো বেঁকে বেঁকে চলে। কখনো মরে যায়। আবার কখনো জোয়ারে ভরে ওঠে। নদীর জীবনেও বসন্ত আসে, শীত আসে, গ্রীষ্ম আসে, বর্ষা আসে। এগুলো কবিরা দেখতে পায়, বুঝতে পারে, কাব্য লেখে। কবি জহুরুলও ‘ডুবোনদীর ঢেউ’ কবিতায় নদীকে তুলে ধরেছেন, মায়াবী চোখের মতো, ডুবু ডুবু জলের মতো, জ্যামিতিক ঢেউয়ের মতো। চোখের জলের স্রোতে কাজলমাখা চোখ দুটো ধুয়ে যাওয়ার মতো। এ যেন ভাদ্র পূর্ণিমার রাত, এ যেন দখিনার মিহিন বাতাসের করুণ সুর, ঘ্রাণজল ঢেউ। এ কবিতায় কবি আপন মনে নদীর স্বপ্নজাল বুনে চলেন এভাবে-
‘এখন নদীর জোয়ারের
কাল-
এই ভাদ্র পূর্ণিমায় ফুলে উঠে নদী…।
জ্যামিতিক ঢেউ-আর উথাল-পাথাল।’

কত কবি জ্যোৎস্নামাখা চাঁদ নিয়ে কবিতা লেখেন, কত কবি চাঁদের সঙ্গে মিতালি করেন, কত সাধক এই চাঁদনি রাতকে নিয়ে সাধনা করেন আর কত প্রেমিক-প্রেমিকা চাঁদের সঙ্গে কথার ফুলঝুরিতে মেতে রাত্রি পার করেন তাদের প্রিয়জনের বুকে বুক রেখে; সে সব হিসাব নাইবা দিলেম। কবি জহুরুলও এর ব্যতিক্রম নয়। কবি তার কবিতায় হিমানী রাতকে নদীর জ্যামিতিক ঢেউয়ের সঙ্গে, সুনামির সতর্ক সংকেতের সঙ্গে আবার মাতাল করা ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি আরো বলেন, এ সবকিছু রাতের শিশিরসিক্ত শেফালি চাঁদ উন্মুখ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। তাই তিনি ‘রাতের হিমানী চাঁদ’ কবিতায় উদ্ধৃত করেন-
‘পৃথিবীর বিষণ্ন শরীরে উত্তাপ ঢেউয়ের ফেনা,
ঢেউয়ের স্বর।
ধরণীর বুকে চলে ক্রমাগত ঢেউয়ের আঘাত,
রাতের হিমানী চাঁদ চেয়ে চেয়ে দেখে…।’

এ কাব্যের শেষ কবিতার নাম ঝরা ফুল। পৃথিবীর সব কিছুই নশ্বর। সব কিছু ঝরে যায়। ফুল ঝরে যায়, পাতা ঝরে যায়, মানুষ ঝরে যায়, থাকে শুধু স্মৃতি। এ স্মৃতিও এক সময় বিস্মৃতি হয়ে যায়। ভরা নদীও এক সময় মরে যায়। বিবর্ণ বিকালের মতো সতেজ জীবন এক সময় বিলীন হয়ে যায়। ফলবান বৃক্ষ এক সময় ফলহীন বৃক্ষে পরিণত হয়। এইতো জীবন। কবি কবিতায় বলে ওঠেন, বিকেল এলে সকালের উজ্জ্বলতা হারায়, রঙিন দিনের স্মৃতি ভেসে ওঠে। এরপরও কবি আশাবাদী, স্বপ্ন দেখেন। বলে ওঠেন, রাতের মরণের পরই তো সম্ভাবনার সকাল। কবিতার পঙ্ক্তিতে তিনি সাজিয়ে রাখেন-
বিবর্ণ বিকেল এসে মুছে দেয় সব
উজ্জ্বলতা-
জমা হয় কিছু
রঙিন দিনের স্মৃতি।
রাতের মরণ হলে- আসে
সম্ভাবনার সকাল।
কবি জহুরুল ইসলামের ‘জলের আগুনে জ¦লে’ কাব্যের সব কবিতাই অক্ষরবৃত্তে লেখা। তিনি কবিতায় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি অলঙ্কার ব্যবহার করেছেন খুবই সচেতনভাবে। কাব্যটি পাঠ করলে আমরা কাব্যরস ও শিল্পের মাধুর্য খুঁজে পাই। তার কবিতার গড়ন, কবিতার ঢঙ, কবিতার শরীর ও শিল্পিত রূপসৌন্দর্য এ কাব্যে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- তিনি উপমা ও অলংকার হিসেবে ব্যবহার করেন; সাপের ফণার মতো, নৌকার দেহের ভাঁজে, চাঁদ চাদরের বিছানায়, বুক পকেটের ভাঁজ, দুঃখগুলো গলে পড়ে, দুঃখগুলো বুকের ভেতর, ঝাউবনের পেটের ভেতর, চোখের জলে ডুবে আছে নদী। এগুলো একজন দক্ষ শিল্পী না হলে সচেতনভাবে কবিতায় ব্যবহার করতে পারে না। এজন্য বলা যায় কবি জহুরুল ইসলাম একজন দক্ষ শিল্পী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়