বাম গণতান্ত্রিক জোটের হুঁশিয়ারি : দমন-পীড়ন করে গদি রক্ষা করা যাবে না

আগের সংবাদ

চার কারণে ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয়

পরের সংবাদ

জঙ্গল সলিমপুরে ফের সংঘর্ষ, এখনো বেপরোয়া সন্ত্রাসী-ভূমিদস্যুরা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রীতম দাশ, চট্টগ্রাম অফিস : কিছুদিন আগেও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় ৩ হাজার ১০০ একর সরকারি জায়গা। যেখানে সরকারি পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছিল বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য। বছরের পর বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে ভূমিদস্যু সন্ত্রাসরীরা প্রায় ৪০০ একর পাহাড় ন্যাড়া করে গড়ে তুলেছিল এই সা¤্রাজ্য। পাহাড়বেষ্টিত সলিমপুরে গত দশ বছরে শতাধিক একর পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয় প্রায় হাজার হাজার বাড়িঘর। বিভিন্ন সমিতি ও ব্যক্তির নামে এসব পাহাড় কাটা হয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসার আড়ালে সরকারি পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি থেকে শুরু করে মাদক, খুনসহ এমন কোনো অপরাধ নেই এখানে হয়নি।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে অপরাধীরা আস্তানা গাড়ত এখানে। ছিন্নমূলের নামে সেখানে দখল করা হয় পাহাড়ি দুর্গম সরকারি এই খাসজমি। স্থানীয়রা ছাড়া বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারত না। এ রাজ্যে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রবেশও অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছিল। সন্ত্রাসীদের সেই অভয়ারণ্য জঙ্গল সলিমপুরে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। সেখানে স্পোর্টস ভিলেজ থেকে শুরু করে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালসহ কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নানা কৌশলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ভূমিদস্যু সন্ত্রাসীরা। সেখানে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের অভিযানে বাধা দেয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের প্রবেশ ঠেকাতে রাস্তা কেটে নালা সৃষ্টি করা, স্থানীয় বাসিন্দাদের উসকে দিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করা, আন্দোলনের নামে ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রশাসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেখানকার বাসিন্দারা সরে যেতে চাইলেও পড়তে হচ্ছে সন্ত্রাসীদের বাধার মুখে।
জঙ্গল সলিমপুরে অভিযানে অংশ হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেলে পর্যন্ত নগরীর বায়েজিদ লিংক রোডের ফুটপাত ও কেজিডিসিএলর গ্যাস পাইপলাইনের ওপর ও দুইপাশে অবস্থিত শতাধিক অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করেছে সিডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও কেজিডিসিএল। যৌথ এই অভিযানে ৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সিএমপি, আনসার সদস্যরা নিয়োজিত ছিলেন। এই অভিযানের সময় স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এর পাইপলাইনের ওপর ও দুইপাশে স্থাপিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।
গতকাল জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় ?অভিযানে যাওয়া প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করেছে স্থানীয়রা, পুলিশের সঙ্গে জড়ায় সংঘর্ষে। ঘটনাস্থলে কমপক্ষে দুজন পুলিশ সদস্যকে মাথায় ও হাতে আঘাত নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় সলিমপুর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে। এছাড়া কয়েকজন বাসিন্দাকে আহত অবস্থায় সেখান থেকে বের করে আনতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে মো. আলী রাজা হাসান সাগর (২৪) নামের একজন রাবার বুলেটে গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি হয়েছেন বলে পাঁচলাইশ থানা সূত্রে জানা গেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরের বাসিন্দাদের পাহাড় ছাড়তে কয়েক দফা তাগাদা দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। লাল পতাকা টাঙিয়ে হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়। মাইকিং করে সতর্ক করা হয় তাদের। অনেকেই আলীনগর ছাড়লেও, বেশির ভাগই পড়ছেন সন্ত্রাসীদের বাধার মুখে। গতকাল বৃহস্পতিবার জঙ্গল সলিমপুরের পাহাড়ে বসবাসরতদের অন্যত্র চলে যেতে সহযোগিতা করেছে জেলা প্রশাসন। সন্ত্রাসীদের বাধার মুখে যারা সলিমপুর ছেড়ে যেতে পারেনি তাদের সরে যেতে প্রশাসন আগামীকাল শনিবার পর্যন্ত সহযোগিতা করবে। এরপর কেউ অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করলে আগের চেয়েও বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। জানা গেছে, দুর্গম জঙ্গল সলিমপুরের আলীনগর পাহাড়ে ৩ হাজার ১০০ একর খাস জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়ে সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করেছিল কয়েকটি গ্রুপ। এর মধ্যে বেশিরভাগ জায়গাই দখল করে রেখেছে আলীনগরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ইয়াছিন বাহিনী। দখল করা জায়গায় পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করে তা শত শত মানুষের কাছে বিক্রির মাধ্যমে এই বাহিনী কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছে। ইয়াছিনকে জেলে থাকায় পলাতক রয়েছে তার বাহিনীও। যখন সরকারি নির্দেশনা মেনে জঙ্গল সলিমপুরের মানুষ অবৈধ বসতি ছাড়তে শুরু করে ঠিক তখনই হাজির ইয়াছিন বাহিনী। জঙ্গল সলিমপুর ছাড়তে বাধা দিচ্ছে তারা।
মোহাম্মদ ইসমাইল নামে সোনকার এক বাসিন্দা বলেন, রিকশা চালিয়ে টাকা জমিয়ে সলিমপুরে জায়গা নিয়ে বাড়ি করেছিলাম। প্রশাসনের নির্দেশে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসক আমাদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন। সেই আশ্বাস নিয়ে যখন সলিমপুর ছাড়তে যাচ্ছি। তখনই এলাকার কিছু যুবক এসেছে হুমকি দিয়ে গেছে যাতে সলিমপুর না ছাড়ি।
জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গল সলিমপুরের অবস্থান। এখানে পাঁচটি মৌজায় খাস জমির পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ একর। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। পাহাড়বেষ্টিত সলিমপুরে গত দশ বছরে শতাধিক একর পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় হাজার হাজার বাড়িঘর। বিভিন্ন সমিতি ও ব্যক্তির নামে এসব পাহাড় কাটা হয়েছে। প্রভাবশালী মহল এসব পাহাড় কেটে ৩০০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে লাখ লাখ টাকায় জমির মালিকানা বিক্রি করছে। ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সরকারি খাস জমিতে গড়ে তোলা হয় অপরাধের সাম্রাজ্য।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখলে থাকা ৭০০ একর জায়গা উদ্ধার করেছে। পাশাপাশি পাহাড়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নসহ নানা কার্যক্রম শুরু করে জেলা প্রশাসন। সলিমপুর ও আলীনগরের প্রবেশমুখে বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি ও চেকপোস্ট।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জঙ্গল সলিমপুরে বেশকিছু ভূমিদস্যু চক্র এখনো সক্রিয়। সরকার আলীনগরের অবৈধ বাসিন্দাদের উচ্ছেদের কাজ শুরু করায় দীর্ঘদিনের রাজত্ব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ইয়াছিন বাহিনী নানা কৌশল নিচ্ছে। আমরাও এসব বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। নিয়মিত আমাদের পুলিশের কয়েকটি টিম অবস্থান করছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, জঙ্গল সলিমপুরের বিশাল এ পাহাড়ি এলাকায় এ সময় মানুষের বসতি ছিল না। ২০০০ সালের পর বিভিন্ন স্থান থেকে অপরাধীরা এখানে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করে। প্রশাসনের অগোচরে মুষ্টিমেয় লোক পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলে। ভেতরে ভেতরে প্রায় ৪০০ একর পাহাড় কেটে ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। জঙ্গল সলিমপুর দেশের অভ্যন্তরে আরেক সা¤্রাজ্য। তিনি বলেন, সরকার আলীনগরের পরিবেশ প্রতিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে পরিবেশবান্ধব মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে ২ শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ ও ৪ শতাধিক অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তারপর আমরা অবৈধ বাসিন্দাদের এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দিলে তারা চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। অর্ধ শতাধিক বাসিন্দা বসতি গুটিয়ে নিয়ে এলাকা ত্যাগও করেন। কিন্তু এরপরই সক্রিয় হয়ে ওঠে আলীনগরের চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা। তাদের রাজত্ব ও দখল হাতছাড়া হলে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় তারা নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। একাধিক বার মহাসড়ক অবরোধ করে তারা। তিনি বলেন, আলীনগরে প্রবেশের সব পথ কেটে খাল তৈরি করে সন্ত্রাসীরা।
এখন তারা নতুন পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেছে। তারা এখন সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। তাদের এলাকা ছেড়ে যেতে দিচ্ছে না বলে অনেকেই আমাদের দফতরে এসে অভিযোগ করেছেন। তারা এলাকা ছাড়ার জন্য আমাদের সহযোগিতা চাইছেন। আমরা বৃহস্পতিবার থেকে আগামী তিন দিন ‘সেফ করিডর প্রোগ্রাম’ চালু করেছি। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকবেন। তাদের সহায়তায় তারা জঙ্গল সলিমপুর ছাড়বেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়