বাম গণতান্ত্রিক জোটের হুঁশিয়ারি : দমন-পীড়ন করে গদি রক্ষা করা যাবে না

আগের সংবাদ

চার কারণে ভ্যাট আদায়ে বিপর্যয়

পরের সংবাদ

কাল রাতে ভাই এসেছিল

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অক্টোবরের শেষ সপ্তায় এক ঝিরিঝিরি বাতাস দেয়া বিকালে একটি মাঝারি কালো রঙের ট্রাভেল ব্যাগ আর এক ছড়ি সাগর কলা নিয়ে ভাই আমার ফ্ল্যাটে তশরিফ আনেন। আমি তখন ডেঙ্গু মশার ভয়ে দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে ভাতঘুমে কাদা হয়ে আছি। দু’দুবার কলিংবেলের শব্দে পড়িমড়ি করে উঠে দরজা খুলে ভাইকে দেখে আমি থ। প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো চাকরি নিয়ে ঢাকা এসেছি, ভাই নানান কাজে আগে অনেকবার আসলেও কখনো এমুখো হয়নি। আসার আগে একটি ফোন দিতে পারতো, তাও করেনি। আমার তাজ্জব হওয়াটা তাই অস্বাভাবিক কিছু না। সেটা আঁচ করেই ভাই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘এই কাছেই একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম তোর সাথে দেখা করে যাই।’
আমি শশব্যস্ত ভাইয়ের হাত থেকে কলার ছড়িটা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখি, ভাইয়ের পাশে বসতে বসতে বলি, ‘ভাবি, বাচ্চারা সবাই ভালো তো? তোমার শরীর কেমন?’
ভাই কোলের ওপর ট্রাভেল ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে বললো, ‘আর বলিস না, তোর ভাবির রক্তে হিমোগেøাবিনের সমস্যা, ইংজেকশান নিতে হচ্ছে।’
ভাবির সাথে কোনোকালেই আমার খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না। তাই এ কথায় বিচলিত না হয়ে বললাম, ‘আসতে অনেক ধকল গেছে নিশ্চয়? মুখ-হাত ধুয়ে আস, আমি চা নাশতার ব্যবস্থা করি।’
ভাই কোলে রাখা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। খানিকটা অপ্রস্তুত ও ইতস্তত ভাব নিয়ে বললো, ‘আমাকে কোন ঘরে থাকতে দিবি বল, মাত্রতো একটা রাত, কাল খুব ভোরেই ট্রেন ধরতে হবে।’
ভাইয়ের এই অতিমাত্রার ব্যাগ সচেতনতা আমার নজর এড়ায় না। কী আছে ব্যাগটার মধ্যে? আমি হেসে বলি, ‘আমারতো দুটি ঘরই ভাই, এই বসার ঘরটা, আর ওই বেড রুম, তুমি যেটাতে খুশি থাকতে পারো।’
ভাই হাসতে হাসতে বেড রুমে এসে ব্যাগটা খাটের নিচে ঢুকিয়ে রাখলো। হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো, ‘এত হাবিজাবি কী জমা করেছিস খাটের তলায়? ব্যাগটা রাখলাম ওখানে।’
ভাইয়ের আচরণে আমার কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছে। ব্যাগ নিয়ে ভাইয়ের এই অস্বাভাবিক লুকোচুরির অর্থ কী? কিন্তু আমি সেটা ভাইকে বুঝতে দিই না। রান্নাঘরে ঢুকে ভাইয়ের জন্য ডিম-পাউরুটি আর চা করতে থাকি। দিনা আমাকে পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর এই ক’বছরে টিকে থাকার স্বার্থে রান্নাবান্নায় বেশ পটু হয়ে উঠেছি। দিনার সাথে আমার অল্প দিনের সংসার, তার মানে আমার উপর থেকে বিশ্বাস আর আস্থা হারাতে ওর বেশিদিন লাগেনি। ওর সাথে বিয়ের এক মাসের মধ্যেই আমার স্কুলের চাকরিটা চলে যায়। ইংলিশ মিডিয়ামের বেতমিজ ছেলেমেয়েগুলোকে নাকি আমি শাসনে রাখতে পারি না। বাংলার শিক্ষক বিধায় কোচিং বাণিজ্য করে যে অস্তিত্ব রক্ষা হবে সে সম্ভাবনাও খুব কম। দিনা অবশ্য এ দিক থেকে আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে। বিয়ের পরপরই একটি বেসরকারি ব্যাংকে ওর কপাল খুলে গেল। ব্যাপারটা দাঁড়ালো এমন যে আমি ওর জন্য পয়মন্ত আর ও আমার জন্য অপয়া। একজন অলস আর অপদার্থ মানুষের যে ভাবনা হয়, আমিও গোপন পুলকে ভেবে নিলাম, যাহোক বৌয়ের টাকায় কিছুদিন বেকার গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানো যাবে। গ্রামে জমি বিক্রি বাবদ ব্যাংকে কিছু টাকা সঞ্চিত ছিল, সেদিক থেকেও মনে একরকম বল পাচ্ছিলাম। তবে দিনার কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় তা গোপন রাখলাম। ডিম ভাজার শুরুতে হাতে-মুখে তেলের ছিটা পড়ায় দিনাবিষয়ক ভাবনায় আপাত ছেদ পড়ে। ভাইও ততক্ষণে মুখ-হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছে। জগ থেকে গøাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘তা ভালোই করেছিস আর বিয়েশাদি না করে, তোর যে রকম উড়নচণ্ডি স্বভাব, এখন একা একাতো বেশ ভালোই আছিস দেখছি।’
আমার মনটা ঈষৎ খারাপ হলো, ভাই কী ভেবে কথাটা বলল বুঝতে পারলাম বলে। পরিবার না থাকলে আমার পৈতৃক সম্পত্তির ভাগটা ভাই আর তার ছেলেমেয়েরা পাবে, ভাই হয়তো সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা বিষয়ক কিছু বলতেই অপ্রত্যাশিতভাবে অসময়ে এসেছে, আমার অবচেতনায় কে যেন ফিসফিসালো। ভাইকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমি শব্দ করে হাসি, ‘হ্যাঁ ভাই, তোমাদের দোয়ায় ভালোই আছি বলতে পার।’ আমি আপেল কাটার জন্য বড় ছুরিটা কিচেনে আঁতিপাঁতি করে খুঁজি, কিন্তু কোথাও পাই না। এই মাত্র দুদিন আগে আগোরা থেকে কিনেছি, কোথায় যে রাখলাম? ভাই ততক্ষণে ডিমের বাঁধনে পাউরুটি বাঁধতে শুরু করেছে, ‘কী এত করছিস, বসতো কথা আছে তোর সাথে।’
ছুরি খোঁজা বাদ রেখে আমি চেয়ার টেনে ভাইয়ের মুখোমুখি বসি, ‘হ্যাঁ ভাই, শুনছি, বল।’
ডিম-পাউরুটি শেষ করে ভাই এবার আস্তে আপেলে কামড় বসিয়ে বলে, ‘কথাটা তোকে আগেও একবার বলেছি, তুই আগ্রহ দেখাসনি। ভাবলাম এতদিনে তোর মন পাল্টেছে হয়তো।’
শুকনো মুখে বসে থাকতে কেমন লাগছিল বলে আমিও হাতে একটা আপেল নিয়ে বসি। কিন্তু আমার সামনের পাটির দাঁতগুলো বাঁধাই করা বলে কামড় বসাতে ভয় পাই। ছুরিটা যে কোথায় রেখেছি? নিজের ওপর বিরক্তি নিয়ে অগত্যা আপেলটা শক্ত হাতে চেপে বসে থাকি।
ভাই খচ খচ শব্দে আপেল চিবোয়, ‘মা তোর আর আমার নামে যে জমিটা লিখে দিয়ে গেছে, আমি সেটার কথা বলছিলাম।’
আপেলের টুকরোগুলো দাঁতে দাঁতে ভালোমতো পিষে নিতে ভাই একটু দম নেয়।
আমি হাতের আপেলটা একবার টেবিলে রেখে আবার সেটাকে গড়িয়ে দিয়ে দু’হাতে লুফে নিই।
‘হ্যাঁ ভাই, জমিটার আমার অংশে আমি একটা লাইব্রেরি আর গ্রামের গরিব বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল দেব বলে ঠিক করে রেখেছি।’
ভাই এবার আমাকে জোরে একটা ধমক দিল যে রকম ছেলেবেলায় অঙ্ক আর ইংরেজিতে ফেল করলে দিত।
‘পাগলামি থামা, লাইব্রেরি দিবি, আজকাল আর বই পড়ে কেউ? বাচ্চারাতো মুখে বুলি ফুটার আগেই মোবাইল টিপে বেড়ায়।’
ভাইয়ের ধমকে আড়ষ্ট হয়ে একটু আশ্রয় পেতে আমি আপেলটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরি।
ভাই এবার মুখে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে ঝুঁকে পড়ে আমার একটা হাত চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘জমিটা আমি বিক্রি করে দিয়েছি।’
আপেলটার ওপর আমার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। কী বলব বুঝতে না পেরে ভাইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।
আপেলে শেষ কামড় বসিয়ে ভাই এবার আড়চোখে আমাকে পরখ করে। আমার প্রতিরোধ বা প্রতিবাদের সম্ভাবনাকে অংকুরে বিনাশ করার জন্য কানের কাছে মুখ নামিয়ে আগের চেয়েও আস্তে যেন কারো কোনো গোপন কথা ফাঁস করার মতো করে বলে, ‘তোর জন্য কিছু টাকা সাথে করে নিয়ে এসেছি।’
ঘটনাচক্রে দিনার ফেসবুক প্রোফাইলে অনধিকার চর্চা করে যেদিন ওর জীবনে ‘দিবস-রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’ গোছের একজনকে আবিষ্কার করি, সেদিনও একটু চমকালেও আমার তেমন কিছু বড় ধরনের ভাবান্তর হয়নি। আজো আমাকে না জানিয়ে ভাইয়ের জমি বিক্রি করে দেয়ার খবরে আমার কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত তা সঠিক বুঝে উঠতে না পেরে ঝুঁকি নিয়ে আমার বাঁধাই করা দাঁতে আপেলে সজোরে একটি কামড় বসাই।
এবার আমার হাতের আহত আপেলের খচ শব্দে ভাই কিচেনের সিঙ্কে হাত ধুতে যায়। কুলকুচি করে আমার গায়ে হাতের আলতো স্পর্শ বুলিয়ে ‘এদিকে আয়’ বলে যে ঘরের খাটের নিচে ব্যাগটা রেখেছিল সে ঘরে ঢুকে। পেছন পেছন আমিও যাই।
ভাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘরের পর্দা ভালোমতো টেনে দিয়ে সন্তর্পণে ব্যাগটা বের করে আনে। চেন খুলে একতাড়া নোট ছড়িয়ে দেয় বিছানায়।
এতগুলো টাকা এক সাথে দেখে প্রথমতো যে চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল তা হচ্ছে বর্তমানে যে চাকরিটা করছি তা ছেড়ে দেয়া যাবে। বিগত কয়েকদিন ধরে দেরিতে অফিস যাওয়া নিয়ে বসের ধাতানি খেতে আর ভালো লাগছে না। আমি ভুলে গেলাম যে জমি আমারো নামে আমার সম্মতি ছাড়া ভাই তা বিক্রি করতে পারে না, আমি বুঝেও বুঝলাম না যে জমিটা কত দামে বিক্রি হলো ভাই কখনো সে সত্য কথা আমাকে বলবে না। কারণ এখন আমার টাকার দরকার, যেহেতু চাকরিটা আমাকে ছাড়তে হবে। আমি টাকাগুলো গোছাতে গোছাতে বললাম, ‘এখানে কত আছে ভাই’?
ভাই বিছানায় বসে আমার ওপর সতর্ক নজর রাখে, ‘এক লাখ আছে, বাকিটা তোর একটা সই পেলেই দেব।’
ভেতরের খুশিকে গোপন করে টাকাগুলো তুলে আমি বিছানার নিচে রেখে দিই। আমার এই অসম্ভব শান্ত প্রতিক্রিয়ায় ভাই কি একটু ভড়কে গেল? আমার সামনের পাটির মাড়িতে একটু একটু ব্যথা করে, অর্ধভুক্ত আপেলের খোঁজে আমি ডাইনিং টেবিলের দিকে যাই। ভাই কাশতে কাশতে আমার পেছন পেছন আসে। নার্ভাস হয়ে গেলে ভাই অকারণেই কাশে, এটা আমি ছোটবেলা থেকে জানি। ভাইয়ের কাশি থামানোর জন্য অভয় দিয়ে শান্তস্বরে বলি, ‘তুমি ড্রইংরুমে বসে টিভিতে নিউজ দেখো ভাই, আমি ভাত চাপিয়ে আসছি।’
প্রকৃত প্রস্তাবে আমার নিয়মিত ভাত রান্নার শুরু দিনার সাথে থাকার সময় থেকেই। ও চাকরি শুরুর পর চলে যেত সাতসকালে আর ফিরতো সেই সন্ধ্যার অনেক পর। চাকরি হারানো বেকার স্বামী হিসেবে তাই বুয়াকে ফাইফরমাশ করা থেকে শুরু করে ঘর সামলানো, রান্নাবাড়ার দায়িত্ব সবই আমার ঘাড়েই বর্তালো। এতে করে বৌয়ের টাকায় গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানোর সেই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা একটু হোঁচট খেল। আর খুব অল্পদিনে ওর জীবনের ‘দিবস রজনী আমি যেন কার’-এর সাথে আমার প্রতি ওর আচরণ পরিবর্তনের যোগসূত্র আবিষ্কার করতে শুরু করি। আমরা যখন একই স্কুলে চাকরি করতাম, পরস্পরের প্রতি দুর্বল ছিলাম এবং যে নীরব প্রেমের পরিণতি সেই পরিণয়, ব্যাংকার দিনার সাথে এর বেশ ভালো রকমের তফাত টের পেতে শুরু করলাম। দিন যায় আর আমার বেকারত্বকে কটাক্ষ করে ওর নানারকম মন্তব্যের সাথে আমার পরিচয় হয়। কিছুদিন ওর শব্দ চয়নে কিছুটা রাখঢাক আর ভদ্রতার বালাই ছিল, ক্রমান্বয়ে তা তিরোহিত হয়। ‘অকর্মার ধাড়ি’, ‘অপদার্থ’ থেকে শুরু করে ‘বসে বসে গেলা’, ‘কিচ্ছু হবে না তোমাকে দিয়ে’ এভাবে শব্দের চাঁচাছোলা প্রয়োগের দীক্ষা নিতে শুরু করি। ‘আমার হাসব্যান্ড স্কুল টিচার হবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি’ এভাবে ব্যাংকার দিনা ওর স্বপ্ন ভঙ্গের ফিরিস্তি দিতে শুরু করে এবং আমার সাথে একঘরে ঘুমানোটাও বাদ দেয়। আমি মুখ বুজে সব সয়ে গেলাম, শুধু প্রমাদ গুনতাম কখন ওর মুখ থেকে আমাকে চিরতরে পরিত্যাগের ঘোষণাটা পাই। চুলায় ভাত আর আলু সিদ্ধ চাপিয়ে আমি ভাইয়ের পাশে এসে বসি। টিভির সুন্দরী সংবাদ পাঠিকা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছিল সম্পত্তি নিয়ে কলহে ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই খুন। চোরা চাহনিতে ভাইকে কেমন চমকে উঠতে দেখলাম। খুক? খুক কেশে উঠে ভাই বললো, ‘আলু ভর্তা করলে ঝাল একটু বেশি দিস। আর তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বো কিন্তু, কাল অনেক ভোরে ট্রেন ধরতে হবে।’
রান্নাঘরে ভাতের ফেন উপচে পড়ার শব্দে আমি ছুটে যাই। আলু ভর্তা যে বানাবো, পেঁয়াজ কুচি করবো কীভাবে, ছুরিটাতো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। চকচকে নিখুঁত ছুরিটার কী যে হলো, আমি আরেক দফা খুঁজে দেখি, না পেয়ে অগত্যা বঁটি দিয়ে পেঁয়াজ মরিচ কুচি করি। বুয়াই বঁটি দিয়ে মাছ-মাংস কাটে, আমি এ যাবৎ কখনো এ বঁটি ধরিনি। ভাই ক্রমাগত টিভি রিমোটের বাটন চেপে চলেছে, হঠাৎ করে গান ভেসে আসে, ‘দিবস-রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি…’, পরক্ষণেই বিজ্ঞাপনের চটুল জিংগেলে সে সুর হারিয়ে যায়। আমি ভাত-ডাল-আলু ভর্তায় টেবিল সাজাতে সাজাতে হাসি, দিনার দিবস-রজনী এখন কেমন কাটছে কে জানে?
আলু-ভর্তা, ডাল আর দুদিনের বাসি বুয়ার হাতের রুই মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে ভাই আমার খাটে শুয়ে পড়ে।
আমি থালা-বাসন গুছিয়ে এসে ভাইয়ের ঘরে ডিম লাইট জ্বালিয়ে সোফায় আধশোয়া হই। ভাইয়ের ঘুমের সমস্যা হবে ভেবে ড্রইংরুমের বাতিটাও নিভিয়ে দিই। জানালা দিয়ে স্ট্রিট লাইট উঁকি-ঝুঁকি দেয়, আলো-আঁধারিতে বসে বসে শুনি ছাদে বাঁধা বাড়িওয়ালার কুকুরটা অবিরত ডাকছে। নাইট গার্ডের তীক্ষè হুইশেলের শব্দে মনে পড়লো সে রাতে দিনা অনেক রাত অবধি অফিস থেকে বাসায় ফেরেনি, আর বারবার ফোন করলেও রিসিভ করছে না বলে মন খারাপ করে এমনিই সোফায় আধশোয়া হয়ে ছিলাম। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠে, দিনার নিরুত্তাপ স্বর, ‘তুমি ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ো। আমি আর তোমার কাছে ফিরছি না। গুড বাই’, বলে আমার উত্তরের কোনো অপেক্ষা না করেই লাইনটা কেটে দিল।

ভাইয়ের ঘর থেকে কেমন একটা খস খস শব্দ আসে। আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে উঁকি দিই, খাটের ওপর উবু হয়ে বসে কী ভাবছে ভাই? কিছু একটা হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক রাখছে, পরক্ষণেই হাতে তুলে নিচ্ছে। ডিম বাতির আবছা আলোয় কিছু ঠাহর করতে পারি না। আচমকা ফ্যানের বাতাসে জানালার পর্দাটা উড়ে যেতেই ঘরে আসা অনাহুত স্ট্রিট লাইটের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠে আগোরা থেকে কেনা আমার সেই সাধের ছুরিটা। আমি চিরকালের ভীতু মানুষ, মুহূর্তে গলা শুকিয়ে যায়, ছুরিটা কীভাবে এলো বিছানায়? তবে কি গতকাল আপেল কাটতে নিয়ে মনের ভুলে ফেলে এসেছি? ভাই-বা কী করছে ছুরিটা নিয়ে…, নাকি আমার অজান্তে ভাই নিজেই কোনো এক সময় কিচেন থেকেৃ। আমি টলমল পায়ে সোফায় এসে বসি। কুকুরটা অবিরাম ডাকছে, দূর থেকে আবারো ভেসে আসা নাইট গার্ডের হুইসেলের শব্দ কেমন অপার্থিব লাগে। ভাই দুবার খুক খুক করে কাশলো, অনেক দিনের পুরনো খাট কেমন ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে নড়ে উঠল, ভাই কি নেমে আসছে? সোফায় টান টান হয়ে বসে থেকে আমি রাত পোহানোর অপেক্ষা করি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়