গাজীপুরে সালনা রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট উদ্বোধন

আগের সংবাদ

ব্যবসায়ীদের দাবি : দাম বাড়িয়েও পোষাচ্ছে না

পরের সংবাদ

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ফের বিপাকে

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : রাজধানীর কমলাপুরে সুমাইয়া ও তার বান্ধবী আরিসা মিলে ‘সুমাইয়া বুটিক’ নামে ২০১৮ সালে একটি বুটিক হাউস চালু করেন। ভিন্ন ধাঁচের ও নজরকাড়া ডিজাইনের পোশাক তৈরি করায় অল্প সময়েই বেশ জনপ্রিয়তা পান তারা। তবে ২০২০ সালে মহামারি করোনার ধাক্কায় পুঁজি হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়েন তারা। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়ে ওঠে। প্রণোদনার ঘোষণায় আবার কিছুটা আশার আলো দেখলেও ঋণ নিতে গিয়ে ব্যাংকে নানা জটিলতায় পড়তে হয় তাদের।
২ বছরের সংগ্রাম শেষে গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করেন ব্যবসা। প্রথম কয়েক মাস ভালোই কাটে। কিন্তু ইউক্রেণ-রাশিয়া যুদ্ধের দামামায় আবারো ধাক্কা খায় প্রতিষ্ঠানটি। এ সময় নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিসহ সাধারণ মানুষের জীবনাযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে মানুষ পোশাক কিনছে না বললেই চলে।
এমন পরিস্থিতিতে সুমাইয়া বুটিকটি এখন প্রায় ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে। বুটিক হাউসে ভালো সময়ে দিনে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকারও বেশি পণ্য বিক্রি হয়েছে, এখন দিনে ৫ হাজার টাকাও বিক্রি হয় না। সুমাইয়া ও আরিশা জানান, মাস শেষে কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া, কারখানা ভাড়া, ব্যাংক ঋণের সুদ, পরিবারের ব্যয়-সবকিছু মেটাতে হয় এই ব্যবসা থেকেই। কিন্তু গত তিন মাস দোকান ভাড়া ও ব্যাংক ঋণের সুদই শোধ করতে পারছি না ঠিকমতো। তাই ব্যবসাটিকে গুটিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চিন্তা করছি।
খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় মানুষের আয়ের সিংহভাগই চলে যায় খাদ্য কিনতে। এরপর আনুযাঙ্গিক প্রয়োজনীয় বিষয় তো রয়েছেই। ফলে খুব প্রয়োজন না হলে সাধারণ মানুষ নতুন কাপড় কিনতে আসেন খুবই কম। জানা গেছে- বিক্রি কমায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা টিকেয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার ঋণ পেতেও নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে তাদের। ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণের মাত্রা কম হওয়ায় নাখোশ বাংলাদেশ ব্যাংকও। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর কাছে ব্যাখ্যাও তলব করেছে।
দেখা গেছে, বড় শিল্প খাতের কার্যক্রম ঠিক রাখতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে বরাদ্দ করা প্রণোদনার ঋণ শতভাগ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। অথচ সিএমএসএমই খাতে বরাদ্দকৃত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৬৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকার প্রণোদনার আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। আর সিএএসএমই খাতে দুই দফায় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৭৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৭৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৬ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। অথচ বড় ঋণের লক্ষ্যমাত্রার পুরোটা অর্থাৎ ২৯ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বিতরণ করলেও ছোট ঋণের ২০ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) অবদান ২৫ শতাংশ। অথচ গত করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে এই খাতটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বলা হয়, করোনায় এ খাতে ৩৭ শতাংশ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এ খাতের ব্যবসায়ীদের বিক্রি ৯৪ শতাংশ কমে যায়। ৩৩ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। জরিপে বলা হয়, মহামারিতে দেশের ৮৩ শতাংশ ক্ষুদ্র শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২১ শতাংশ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন এবং ১৬ শতাংশ বিকল্প উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। মাত্র ৩ শতাংশের ব্যবসা আগের মতো চালু আছে। আয়-রোজগার না থাকায় ৬০ শতাংশ ছোট উদ্যোক্তা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয় জরিপ প্রতিবেদনে। এভাবে অনেক ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা হারিয়ে যাচ্ছেন। দেশের আর্থ-সামাজিক সংকটের কারণে এখন আবার চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।
এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সাধারণত আমরা দেখি ছোটদের ঋণ বিতরণ টার্গেটের থেকে সবসময়ই কম হয়ে থাকে। কারণ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সুপারভিশন করতে হয়, এমন নানা কারণে ব্যাংকগুলোর ছোটদের ঋণ দেয়ার ব্যাপারে কিছুটা অনীহা থাকে।
তিনি আরো বলেন, ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে কিছু কনফিডেন্সও দরকার। সে ক্ষেত্রে ছোট উদ্যোক্তাদের ফরমালিটি পূরণে নানা বাধ্যবাধকতার কারণে ছোট উদ্যোক্তারা অনেকটা কম ঋণ পায়। এ জন্য বিভিন্ন দেশে এবং আমাদের দেশের কিছু ব্যাংক (বিকাশ-নগদ) অথবা অন্য প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের ট্রানজেকশনের ওপর ভিত্তি করে তারা ঋণ দিচ্ছে। এসব ইনোভেটিভ উদ্যোগকে আরো উৎসাহ দেয়া দরকার। বিশেষ করে নতুন অর্থবছরের জন্য সিএমএসএমই খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রণোদনা প্যাকেজের প্রথম পর্যায়ের সফল ঋণ বিতরণের পর এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের বিতরণ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে দ্বিতীয় মেয়াদে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্পে প্রণোদনা ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে এ খাতের উদ্যোক্তারা বিদায়ী অর্থবছরের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ পেয়েছেন ১৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৭ দশমিক ৫২ শতাংশ।
প্রণোদনা প্যাকেজ ছাড়াও ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমেও ঋণ বিতরন আশানুরূপ হয়নি। এ খাত থেকে কটেজ, মাইক্রো, স্মল (সিএমএস) খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম থেকে (সিজিএস) দুই হাজার কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। তবে বিগত অর্থবছর শেষে এ স্কিমের আওতায় মাত্র ১২১ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬ শতাংশ। এ বিষয়েও ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনবে বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত সরকার মোট ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সব মিলিয়ে এসব প্যাকেজের অর্থের পরিমাণ এক লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। পরে ‘রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল’ বা ইডিএফে আরো ৫০ কোটি ডলার যুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি প্রণোদনা প্যাকেজ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। এর আর্থিক মূল্য এক লাখ ৬৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় মেয়াদে ১০টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ তিন হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছর শেষে বিতরণ করা হয়েছে ৬৯ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার রিফাইন্যান্স স্কিম গঠনের ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ঋণ সুবিধা দিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়