কাগজ প্রতিবেদক : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে ইভিএম ব্যবহার না করতে ইসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৩৯ নাগরিক। গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তাদের এই অবস্থান তুলে ধরা হয়।
বিবৃতিতে তারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এটি রাজনৈতিক বিতর্ককে আরো উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরো প্রকট করে তুলবে। আমরা আবারো একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ব- যা জাতি হিসেবে আমাদের চরম সংকটের দিকে ধাবিত করবে।
তারা মনে করেন, কমিশনের সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতার একটি কারণ হলো, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল যন্ত্র। এতে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে নির্বাচন কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং এটি পুনঃগণনা বা নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। প্রসঙ্গত, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সে দেশের ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতিও করা যায়। বায়োমেট্রিকভিত্তিক ইভিএম অনেক ভোটারকেই শনাক্ত করতে পারে না, ফলে ইসি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের তাদের আঙুলের ছাপ দিয়ে যন্ত্রটি খুলে দেয়ার তথা ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দিয়ে থাকে। যে কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমের ফলাফল নিয়েও কারসাজি করা যায়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, ইভিএম ব্যবহার করার কারণে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এ ছাড়া স¤প্রতি কমিশনের ডাকা সংলাপে যে ২২টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছে তার মধ্যে ১৪টি দল এটি নিয়ে তাদের সংশয় ও সন্দেহের কথা স্পষ্টভাবেই বলেছে। এর মধ্যে ৯টি দল সরাসরি ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আওয়ামী লীগসহ ৪টি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ যে ৯টি দল ইসির সংলাপ বর্জন করেছে, তারাও ইভিএমের বিপক্ষে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেও সংলাপের সময়ে বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না। তাই ইভিএমের ওপর অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের এ অবিশ্বাস আমাদের আগামী নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করার পথে একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা থেকে যায়।
তৃতীয়ত, একাদশ নির্বাচনের আগে ইভিএম কিনতে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার (৪৫০ মিলিয়ন ডলার) মতো ব্যয় হয়েছে। ১৫০টি ইভিএমে নির্বাচন করতে হলে নতুন মেশিন কেনায় অন্তত অর্ধ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এ ধরনের বিপুল ব্যয় কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখার অনুরোধ জানান তারা।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই এখন ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে। প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর ১৭৮টির মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৩টি দেশ তাদের সব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন- ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলি খান, বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক পারভীন হাসান, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিক, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলম, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, প্রকৌশলী বিডি রহমতুল্লাহ, অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাবির অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সাংবাদিক কামাল আহমেদ, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, নারীপক্ষের সদস্য শিরিন হক, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, তথ্য প্রযুক্তিবিদ সাইফুর রহমান, আর্টিকেল ১৯-এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী, মোনাশ ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ ও সিনিয়র সফটওয়্যার সল্যুশন আর্কিটেক্ট ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।