মা-বাবার অভিযোগ : মেয়ে ও জামাই বাড়ি দখল করতে মরিয়া

আগের সংবাদ

প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল : প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর

পরের সংবাদ

সংকটে পোশাক শিল্প

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট সারা বিশ্বের উৎপাদকের দেয়া শত শত কোটি ডলার মূল্যের পণ্য কেনার আদেশ বাতিল করেছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ওয়ালমার্টকে পণ্য সরবরাহকারী ওই সব কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্রে বছরের যেসব সময়ে সবচেয়ে বেশি পণ্য বিক্রি হয়, তার মধ্যে ‘ব্যাক টু স্কুল’ মৌসুম অন্যতম। গ্রীষ্মের লম্বা ছুটি কাটিয়ে এ সময়ে সব শিক্ষার্থী স্কুলে ফেরে। ফলে তাদের পোশাকসহ নতুন সব পণ্য কিনে দেন অভিভাবকরা। এজন্য অভিভাবকরা বিভিন্ন ধরনের মূল্যছাড় খোঁজেন। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর প্রত্যাশায় উৎপাদকদের কাছ থেকে পণ্য কেনার জন্য বাড়তি ক্রয়াদেশ দেন খুচরা বিক্রেতারা। তবে এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। মূল্যস্ফীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ভোক্তারা কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন। এতে লক্ষ্য অনুসারে নিয়মিত পণ্য বিক্রি করতে পারছে না দেশটির খুচরা বিক্রেতারা। ভোক্তা চাহিদা কমার সঙ্গে সমন্বয় করতে তাই উৎপাদকদের কাছ থেকে কম পরিমাণে পণ্য কিনছে এসব কোম্পানি। ওয়ালমার্ট জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে গত অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তাদের ইনভেনটরি পর্যায়ের ক্রয়াদেশ ২৬ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি বিক্রির চাহিদা। এতে তারা বিপাকে পড়েছে। একই ধরনের সংকটে পড়েছে ওয়ালমার্টের অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী কোম্পানি টার্গেট করপোরেশনও। তাদের অবস্থা ওয়ালমার্টের চেয়েও খারাপ। মূল্যস্ফীতির কারণে চলতি ত্রৈমাসিকে ভোক্তারা কেনাকাটা কমিয়ে দেয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে ওয়ালমার্টের এই পদক্ষেপে ইতোমধ্যে দুশ্চিন্তায় পড়েছে বিভিন্ন দেশের সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের বড় ক্রেতাদের একটি হলো ওয়ালমার্ট। তাই প্রতিষ্ঠানটি এ দেশেও কিছু ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে বলে জানা গেছে। ওয়ালমার্ট ঘোষণা দিয়েছে, ৩০ শতাংশ অর্ডার কমিয়ে দেবে। এতে চরম আতঙ্কে পড়েছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। তারা মনে করেন, আবারো গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে দেশের পোশাক শিল্প। একের পর এক ধাক্কায় চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। বৈশ্বিক সংকটের কারণে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পোশাক ক্রয়ের নতুন আদেশ দেয়া কমিয়ে দিচ্ছেন আশঙ্কাজনক হারে। বিগত কয়েক মাসে গড়ে ৩০-৩৫ শতাংশ রপ্তানি আদেশ কমে গেছে। বৈশ্বিক সংকটের কারণে শুধু ওয়ালমার্ট নয়, বিশ্বের অনেক দেশের নামিদামি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও এখন অর্ডার বাতিল করছে। এখন গড়ে ৩০-৩৫ শতাংশ অর্ডার কম আসছে গার্মেন্টস শিল্পে। যা দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ওয়ালমার্টের নতুন অর্ডার কমানোর প্রভাব বাংলাদেশে তো অবশ্যই পড়বে। বিশেষ করে আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বছরজুড়ে শুধু ওয়ালমার্টেরই কাজ করে থাকে। যদি ওয়ালমার্ট অর্ডার কমিয়ে দেয় তাহলে বহু কারখানা মহাসংকটে পড়বে। কারণ হুট করেই তো নতুন আরেকটি বায়ারের কাজ জোগাড় করা যাবে না। এই কারণে ওয়ালমার্টের অর্ডার কমে গেলে এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি দেয়াও সমস্যা হবে।
ওয়ালমার্টের অর্ডার বাতিল হওয়া মানে এক-দুই লাখ ডলার বাতিল হওয়া না, তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওয়ালমার্টের অর্ডার কমে যাওয়ার চাপ পোশাক শিল্প সামলাতে পারবে না। কারণ অনেক কারখানা আছে যারা শুধু ওয়ালমার্টেরই কাজ করে, ওয়ালমার্টের জন্য পোশাক তৈরি করে। এসব প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়ে যাবে। সুতরাং এই ধাক্কা সামলে ওঠা খুবই কঠিন হবে। এই পরিস্থিতি আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য খুবই খারাপ। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তৈরি পোশাক খাতের ওপর থেকে অতিনির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা। সব সময় রাজস্ব আহরণের দৃষ্টিকোণ থেকে রপ্তানি খাতকে দেখা হচ্ছে। এতে স্বল্পমেয়াদে সরকার রাজস্ব পেলেও দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। শুধু গার্মেন্টস খাতকে প্রাধান্য না দিয়ে পাশাপাশি অন্য খাতেও নজর দেয়া প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গতি বাড়াতে আঞ্চলিক বাণিজ্য বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে প্রায় সময়েই। অনেক বাধা-বিপত্তির কারণে মাঝেমধ্যে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য হোঁচট খাচ্ছে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে উপকৃত হবে বাংলাদেশ। বাণিজ্যের হাত ধরে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটতে পারে। রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে হয়তো নানা প্রতিকূলতা আছে, যা অতিক্রম করে সমৃদ্ধির ধারা বজায় রাখাটা নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রত্যাশা- সব প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। রপ্তানি আয় বাড়াতে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীর কোন দেশে কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা রয়েছে তা জানতে হবে। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভিন্ন দেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এজন্য আমাদের রপ্তানিকারকদের নিজস্ব উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য চালু রয়েছে তার বাইরে আরো নতুন দেশে বাজার খোঁজার চেষ্টা জোরালো করতে হবে। রপ্তানি বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাতে হলে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্প পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশের রপ্তানি খাত এখনো গুটিকয়েক পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কাজেই রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই। প্রচলিত পণ্যের বাইরে আরো কিছু পণ্যের রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে গøাস, ইলেকট্রনিক পণ্য, সিরামিকস, হালকা প্রকৌশল পণ্য, সিমেন্ট, আইটি পণ্য, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ছোট জাহাজ প্রভৃতি। শুধু পণ্য নয়, রপ্তানি গন্তব্যেও বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন।
দেশের রপ্তানি বাজার প্রধানত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সেখানে বাজার ধরে রাখা কঠিন। তাই নতুন রপ্তানি গন্তব্যের অন্বেষণ দরকার। জাপান, রাশিয়া, ব্রাজিল, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় রপ্তানি গন্তব্য হতে পারে। রপ্তানি বাড়াতে ওইসব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদারের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা বেশ সহায়ক হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণে উদ্যোক্তা বা বেসরকারি খাতের দুর্বলতাও চোখে পড়ার মতো। একটি নির্দিষ্ট খাত রপ্তানি বাজারে তখনই এগোতে পারে, যখন পণ্য ক্রেতারা পণ্যের অর্ডার দেয়ার জন্য অনেক বিক্রেতার খোঁজ পান। দুর্ভাগ্যজনক হলো বাংলাদেশের বেশিরভাগ উদীয়মান খাতই মাত্র এক বা একাধিক স্বল্পসংখ্যক বিক্রেতা উদ্যোক্তার ওপর নির্ভরশীল। একটি নির্দিষ্ট খাতের ন্যূনতম সংখ্যক বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার উপস্থিতি না থাকলে ক্রেতা অর্ডার দেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত থাকে। বেশিরভাগ খাত কিছু বৃহৎ উদ্যোক্তা বা গ্রুপ অব কোম্পানিজ নির্ভরশীল হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এসব খাতের বিকাশ শ্লথগতিতে হচ্ছে। এসব খাতে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক মানের পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও প্রদানের ক্ষমতা থাকা জরুরি। মোট কথা, প্রতিটি উদীয়মান খাতের ভ্যালু চেইনকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাঁচামাল উৎপাদন বা আমদানি মধ্যবর্তী পণ্য উৎপাদন এবং পূর্ণাঙ্গ পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের সক্ষমতা অর্জন জরুরি। উদীয়মান এসব খাতে স্বল্পতম সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা জরুরি।

রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়