ঢাকা কলেজ : ক্যান্টিনে খাওয়া নিয়ে দু’গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ১০

আগের সংবাদ

ভাঙা সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির মচ্ছব : সড়ক খনন নীতিমালা উপেক্ষিত > তিন মাসের কাজ বছরজুড়ে > সেবা সংস্থার কাজে সমন্বয় নেই

পরের সংবাদ

সততার সামাজিক মূল্যায়ন হচ্ছে কি?

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এ বছর সাধারণ মানুষের কিছু অসাধারণ সততার দৃষ্টান্ত সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কুড়িয়ে পাওয়া ২৫ লাখ টাকা মালিককে ফিরিয়ে দিয়ে সততার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন নাটোরের তরুণ ট্রাকচালক মো. বাবু। অথচ তার দিনে আয় ছিল মাত্র ৬০০ টাকা। মালিকের কাছে সেই টাকা পৌঁছে দিতে পেরে মো. বাবু এতটাই আনন্দিত ছিলেন, এর জন্য তিনি মালিকের কাছ থেকে ঘোষিত পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেন। এমন নির্লোভ মানুষদের সামাজিক স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত।
চলতি আগস্ট মাসের মাঝের দিকের আরেকটি ঘটনা সবাইকে অবাক করে দেয়। ঢাকার গুলশানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিকের আইফোন পেয়ে তা ফেরত দিয়েছেন রিকশাচালক আমিনুল ইসলাম। এত দামি আইফোন ফেরত দেয়ার মধ্য দিয়ে রিকশাচালক আমিনুল ইসলাম শুধু তার সততার প্রমাণই দেন নাই, আমাদের দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছেন। সে কারণে তাকে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। এরপরই ঢাকা মহানগর পুলিশও (ডিএমপি) তাকে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দেয়। সেজন্য মেয়র ও ডিএমপিকে ধন্যবাদ জানাই।
প্রশ্ন হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়েও রিকশাচালক আমিনুল ইসলাম কীভাবে নিজের সততা অক্ষুণ্ন রাখলেন? সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট মারটন তার ‘এনোমি’ তত্ত্বে বলেন, সমাজে আর্থিক সমৃদ্ধির উচ্চমানে পৌঁছার যে লক্ষ্য চালু আছে, তাতে বৈধ পদ্ধতিতে উন্নীত হতে না পারলে মানুষ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে অপরাধের আশ্রয় নেয়। এর মানে স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের আর্থিক লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সততার পথে চলতে চায় না বা পারে না। অথচ ট্রাকচালক বাবুর মতো রিকশাচালক আমিনুল ইসলাম রবার্ট মারটনের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দেন বাস্তব কর্মের মধ্য দিয়ে। আরো এক ধাপ এগিয়ে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছি, এখনো করি। তবু অন্যের সম্পদে কোনো লোভ করি না’। অন্যের সম্পদে লোভ নাই মানে এই নয় যে তিনি আর্থিক সমৃদ্ধি চান না। সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে সেই আগ্রহ ব্যক্ত করে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘রিকশা চালিয়ে খুব বেশি আয় করতে পারি না (দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা থাকে), তবে সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই’। এই কথার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট, আমিনুল ইসলাম শিক্ষার মধ্য দিয়ে সন্তানদের সমৃদ্ধি চান। কিন্তু সততাকে বাদ দিয়ে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে আমিনুল ইসলাম রাজি নন।
বাস্তবে আমরা দেখতে পাই, যাদের আর্থিক সচ্ছলতা অনেক তারাই অনেক বেশি মাত্রায় দুর্নীতি আর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এর প্রধান কারণ, অত্যাধুনিক ভোগবাদী এই সমাজে ভোগের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ভোগের সঙ্গে সন্তুষ্টির কোনো আন্তঃসম্পর্ক নেই। অথচ উচ্চমানের ভোগলিপ্সার কারণে বড় মাপের দুর্নীতি আর অর্থ লোপাট করে চলছে প্রভাবশালী উচ্চশিক্ষিতরা। শিক্ষাকে যখন ভোগলিপ্সা চরিতার্থ করার হাতিয়ার বানানো হয়েছে তখন শ্রমকে বানানো হয়েছে শুধু বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। শ্রম যাদের একমাত্র পুঁজি তাদের পক্ষে আর্থিক সাফল্য অর্জন করা সম্ভবপর হচ্ছে না, এমনকি তাদের পক্ষে অপরাধ করার সুযোগও কম থাকে। কিন্তু‘ অপরাধ দূর করা বা দমন করা যাদের দায়িত্ব তাদের পক্ষে অবৈধ পন্থায় বাড়তি আয় করার সুযোগ অনেক বেশি। তাদের প্রশ্রয় পেলে হয়তো বেকার, অল্প শিক্ষিত বা নিম্ন আয়ের মানুষেরা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু‘ অভাবের মধ্যে থেকে নিজের সততা ধরে রাখা যেখানে কঠিন, যেখানে কুড়িয়ে পাওয়া টাকা বা আইফোন লুফে নিলে ধরা পড়ার অবস্থাও ছিল না; সেখানে আমিনুল বা বাবুর মতো মানুষদের সম্মান-মর্যাদা এ যুগের অনেক উচ্চশিক্ষিতদের চাইতে অনেক বেশি। এটা এজন্য যে, বর্তমান সময়ে মানুষ এক কঠিন সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে চলছে। এই সমাজে সম্মানের মালিক তারা, যারা উচ্চডিগ্রি প্রাপ্ত, যাদের হাতে অঢেল সম্পদ, যাদের হাতে অনেক ক্ষমতা। প্রতিটি পরিবারের সন্তানদের এই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, উচ্চশিক্ষিত হয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হতে হবে; তা না হলে জীবনের কোনো অর্থ নেই। এমন ধারণার প্রসারে মানুষ সততা শব্দটা ভুলতে বসেছে। সততাকে বোকাদের চরিত্র জ্ঞান করা হয়। অথচ রিকশাচালক আমিনুল যখন বললেন ‘সৎ পথে যা আয় করি, তা দিয়েই সুখে আছি’। তখন আমরা বুঝতে পারি না, কে শিক্ষিত আর কে অশিক্ষিত। অনেক উচ্চশিক্ষিতের কথার মান এতটা দুর্বল যে, শিক্ষার সঙ্গে কথার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ কিছু অশিক্ষিতের কথার মধ্যে মিশে আছে সূক্ষ জ্ঞান। আমাদের সমাজের কোট-টাইধারী উচ্চাসনের মানুষেরা বলে, এই সমাজে চলতে হলে প্রচুর অর্থ-সম্পদ অর্জন করতেই হবে। অথচ আমিনুল বলেন, ‘আমার বাবা বলতেন- পরের সম্পদের লোভ যে করে, তার সর্বনাশ খোদা করেন। বাবার এই কথা ছোটবেলা থেকেই মেনে চলছি।’
এর মানে পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্বকে অনেক বড় করে দেখতে হবে। একটি পরিবারের মা-বাবার শিক্ষা ও আদর্শের প্রভাব স্কুল-কলেজের শিক্ষার চাইতে অনেক বেশি। যেখানে শিক্ষণ কার্যক্রমের শুরু সেটার ভিত যদি দুর্বল হয় তা থেকে ভালো ফল পাওয়া কঠিন। আমিনুলের বাবা সন্তানকে উপদেশ দিতেন পরের সম্পদে লোভ না করার জন্য, আমিনুলের স্ত্রী আইফোন মালিকের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাগিদ দেন। এ থেকে বোঝা যায়, নৈতিক আদর্শ আর উপদেশের চর্চা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই চর্চা শ্রেণি কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত নয়। উপরন্তু‘ মধ্যশ্রেণি আরো বেশি মাত্রায় ভোগধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। প্রকারান্তরে, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠ জীবনচর্চা এমনকি পারস্পরিক আলাপনেও স্থান পায় না।
এমনি করে ভোগবিলাসী জীবনের ডিস্কোরস আর সততার ডিস্কোরস আলাদারূপে অবস্থান করে। ভোগবিলাসী জীবনের তাগিদেই পণ্যের দামের সঙ্গে সঙ্গে অফিসাররা ঘুষের দর বাড়িয়ে দেয়। অথচ কিছুদিন আগে গত ১৮ আগস্ট ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় মহাসড়কে একটি ব্যাগে প্রায় ৫ লাখ টাকা কুড়িয়ে পাওয়ার পর সেই টাকার মালিকের খোঁজ পেতে শহরজুড়ে মাইকিং করেছে ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী সৌরভ। এর আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ গ্রামের এক কৃষক অর্ধলাখ টাকা হারিয়ে ফেললে সেই টাকা কুড়িয়ে পায় ইসমাইল হোসেন নামের আরেক কৃষক। সেই টাকা ফেরত দিতে মাইকিং করে কৃষক ইসমাইল, মালিকের সন্ধানও পায়। আধুনিক শিক্ষার আলো পায়নি যারা, তারা কী করে এতটা মানবিক হতে পারল? অথচ সমাজের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতার চর্চা এতটাই প্রবল যে, তাদের মধ্যে এই মানবিক গুণের দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তবে আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে অল্প কিছু আছে, যারা নিজেদের সততা বজায় রেখে চলছে। কিন্তু তাদের এই সততা ভোগবাদী সমাজে আলোচিত নয়, বরং উপেক্ষিত।
ঘুণে ধরা এই সমাজের পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষার মানের পরিবর্তন যেমন দরকার তেমনি দরকার সামাজিকীকরণের মানকে উন্নত করা। ধন-সম্পদ আর ভোগের স্তুতি বন্ধ করে মানুষের সততা ও মানবীয় গুণাবলির প্রশংসা করাকে চর্চার আওতায় আনতে হবে। বাবু, আমিনুল, সৌরভ, ইসমাইলের মতো উচ্চ মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের আদর্শের প্রচার বাড়াতে হবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে। আমিনুল ইসলামকে পুরস্কৃত করার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নসহ বাবু, সৌরভ, ইসমাইলদেরও পুরস্কৃত করতে হবে। মিডিয়ায় প্রচারণাসহ তাদের সততার কাহিনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এই ধরনের মানবিক কর্মে সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে। একইভাবে প্রতি বছর সৎ অফিসারদের তালিকা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করতে হবে। মিডিয়ায় তাদের সমাজের প্রাণশক্তি বলে প্রচার করতে হবে। ন্যায় ও সততাকে পরিণত করতে হবে আমাদের জাতীয় সম্পদ ও গর্বের বিষয়ে।

ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়