ঢাকা কলেজ : ক্যান্টিনে খাওয়া নিয়ে দু’গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ১০

আগের সংবাদ

ভাঙা সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির মচ্ছব : সড়ক খনন নীতিমালা উপেক্ষিত > তিন মাসের কাজ বছরজুড়ে > সেবা সংস্থার কাজে সমন্বয় নেই

পরের সংবাদ

আন্তঃধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতি : সুফিবাদ ও সৈয়দ আহমদুল হক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

করোনা বিধ্বস্ত বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সম্প্রীতির চিন্তাচেতনায় নতুন এক পরিবর্তিত পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এটা ক্রমেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, অন্যান্য মহামারির মতো কোভিড-১৯ মানবসভ্যতায় সংকট উত্তরণে বোঝাপড়ার পাঠ নিয়ে এসেছে। আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ আর মেশিনের মধ্যে যোজনা-যুদ্ধের যে সূচনা হতে যাচ্ছে তার একটা আগাম আভাস করোনার বিশ্বব্যাপী পরিভ্রমণে মিলছে। ঘরে-বাইরে স্বার্থসন্ধ রাজনীতি, আর্থসামাজিক জীবন ধারণ ও যাপনে নানান টালমাটালে বেসামাল হয়ে উঠছে ব্যক্তি ও ব্যষ্টির জীবন। করোনার প্রাদুর্ভাব মূলত মানব-সম্পর্ক ও সামাজিক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে দূরত্ব রচনায়, মানুষকে আত্মরক্ষায় স্বেচ্ছা বন্দিত্ব বরণে এবং পরিবার, প্রতিবেশী বা সংঘবদ্ধতার পরিসরকে সঙ্কুচিত করছে। পারস্পরিক সহানুভূতি, সমানুভূতি প্রকাশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক দূরত্ব রচনার বিধি-বিধান আরোপের ফলে মানবিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও সহযোগিতার সোপান পাল্টিয়ে যাচ্ছে। উপলব্ধিতে এটাও আসছে যে, মহামারি করোনা এসেছে যেন যুগ যুগ ধরে মানবতার অবমাননা, বৈষম্য, লোভ, লালসা, মিথ্যাবাদিতা ও অহমিকার যে পাপাচার বিশ্বকে গ্রাস করছিল তার সমুদয় দূর করতে, গোটা বিশ্বময় একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিতেই। আত্মশুদ্ধি ও অনুশোচনার শিক্ষা নিয়ে শুধু দুহাতকে নয়, সবার বিবেককে বারবার ধৌত করার তাগিদ অনুভূত হচ্ছে।
ঠিক এ পরিস্থিতিতে সৃষ্টিকর্তা তথা পরমাত্মার সঙ্গে সম্মিলনের শর্তসাবুদে আগ্রহ-অনাগ্রহের উচাটন উৎপ্রেক্ষায়ও ঘটছে বিবর্তন। পান্থজনের সখার কাছে ক্লান্তিহরের আত্মিক যন্ত্রণা প্রশমনের আকুতি আহ্বান বাড়ছে। সুফিবাদ আত্মিক নির্বাণ লাভের সাধনায় সিদ্ধিলাভের পথ বাতলায়। ধর্ম আর কর্মের মধ্যে সংযোগ-সমন্বয় সুফি তত্ত্বের সারকথা। চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। যেমন ভাবনা তেমনই তার বাস্তবায়ন। মনের মধ্যে বাস করে এক কর্মবিধায়ক তার আবাস অবগাহনের সুতা গাঁথা আরেক সূত্রে। ভাববাদীরা যাকে বলে, আদিবাস তার আরশে মহল্লায়, সেখানে সে থাকে প্রভু নিরঞ্জনের নিরন্তর তত্ত্বাবধানে। মানুষ আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ লাভ করে। তার মধ্যে খোদায়ী সঙ্গলাভের অন্তর্নিহিত যে শক্তি তা স্বর্গজাত রুহের মর্তবা মর্ত্যজাত রুহের মধ্যে প্রতিফলন প্রয়াস প্রচেষ্টার দ্বারা বিকাশ লাভ করে। এর জন্য প্রয়োজন নিরন্তর সাধনার। ইহলৌকিক লোভ-লালসা দুনিয়াদারির দায়ভারে মর্ত্যজাত রুহ বা নফসের স্বচ্ছতায় অস্বচ্ছতার প্রলেপ পড়ে, ফলে সেখানে স্বর্গজাত রুহের গুণাগুণ যথাযথ প্রতিফলিত হয় না।
এই বিশাল বাংলায় সুফিবাদের সগৌরব উপস্থিতি দীর্ঘকালের। কখনো প্রকাশ্য, কখনো প্রচ্ছন্ন, কখনো প্রগলভতায়, কখনো প্রতীকে প্রত্যয়ে মরমি ভাবধারা বাউল কবির কণ্ঠে, সাঁইজীর আখড়ায়, সাধু-সন্ন্যাসীর স্বগতোক্তি সংলাপে আপাত শ্রæত বলে মনে হলেও সেই প্রাচীন উপনিষদকালেও তাদের ধ্যান ও দর্শনের মধ্যে সুফিতত্ত্বের যোগসূত্রের সন্ধান মিলবে। পারস্যের কবি মওলানা জালালউদ্দিন রুমির (১২০৭-১২৭৩) অমিয় বাণী বাংলার পথে-প্রান্তরে চারণ কবির কণ্ঠে শুধু নয়, নিভৃতচারী সাধক, কর্মবীর আর মুখরিত মানুষের মুখে মুখেও ফিরেছে। সুফি সাধনা মূলত মুক্তবুদ্ধি সনাতন ধর্মচর্চা- ধর্মের সঙ্গে কর্মের সংযোগ সমন্বয় সাধনের যে আদর্শ তা ধর্মীয় গোঁড়ামি রহিত ও মানবিক মূল্যবোধের আদর্শে উজ্জীবিত- মানুষের মনুষ্যত্বের উদ্বোধন আহ্বান- নিজেকে চেনার কোশেষ- এসবই সুফি সাধনার অন্তর্নিহিত বাণী। এ কারণে সুফি সাধকরা যুগে যুগে মুক্তবুদ্ধির মানুষ, সার্বিক সাংস্কৃতিক বিকাশ ও সম্প্রদায়গত ভেদ বুদ্ধি বিভাজন রহিত উদার উন্মুক্ত মনোভাব মনোভঙ্গির বিকাশকে প্রাধান্য দিয়েছে। সুফি সাধনা হলো নিজের আত্মাকে কলুষতামুক্ত করে এর স্বচ্ছ শার্শিতে স্বর্গজাত রুহের প্রতিফলন নিশ্চিত করে পরমাত্মার সঙ্গে সম্মিলন ও সাক্ষাৎ লাভের আকাক্সক্ষায় বিভোর হওয়া। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স.) বলেছেন, মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো এটি হলো কলব বা হৃদয়।’ কলবকে কলুষমুক্ত করে, স্বর্গজাত রুহের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগসূত্র বজায় রেখে পরমাত্মার মহব্বত বা এশক বা প্রেমলাভ করা সম্ভব।
বাংলার রুমি বলে খ্যাত সুফি সাধক সৈয়দ আহমদুল হক (১৯১৮-২০১১) সর্বোতভাবে উদার ধর্মবোধে বিশ্বাসী ও সামাজিক সম্প্রীতি তথা সাম্প্রদায়িকতা রহিত মূল্যবোধের প্রবক্তা ছিলেন। বাঙালির মরমি জগতের প্রাণপুরুষ সৈয়দ আহমদুল হক ধর্মকে শান্তির উৎস হিসেবে দেখেছেন, তুলে ধরেছেন। তার মতে, ‘যারা ধার্মিক তারা সত্যিকার অর্থে পরিপূর্ণ মানুষ। ধর্মের মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করলে মানুষ সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল হতে বাধ্য।’
ইসলামকে শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম, সামাজিক সম্প্রীতির আদর্শ হিসেবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করাই ছিল সৈয়দ আহমদুল হকের আজীবন সাধনার সার-নির্যাস। তিনি সবার মধ্যেই মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত দেখতে চেয়েছেন। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান- এ চারটি প্রধান ধর্মের অনুসারীসহ অপরাপর ধর্মাবলম্বীরা যেন তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে বাংলাদেশে শান্তিতে বসবাস করতে পারে সেজন্য তিনি চিন্তাচেতনার খোরাক জুগিয়েছেন, উপলব্ধির তবারক বিতরণ করেছেন। তার বক্তব্য, বাণী ও সাহিত্যকর্মেও এই সত্য, বোধ ও বিশ্বাস ফুটে উঠেছে।
সৈয়দ আহমদুল হক পবিত্র কুরআন, হাদিস, মসনবী শরিফ, অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ, মনীষীদের বাণী ও স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে সামাজিক সম্প্রীতি ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ধর্ম সম্পর্কে বলেন, ‘মুসলমানদের কাছে ইসলাম ধর্ম শ্রেষ্ঠ, হিন্দুদের কাছে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধরা বৌদ্ধ ধর্ম এবং খ্রিস্টানরা খ্রিস্টান ধর্ম পালন করবেন, কেউ কারো সঙ্গে বিতর্কে নামার কোনো প্রয়োজন নেই।’ তিনি তার রচনায় সব ধর্মের মূল বাণীগুলোর সমারোহ ঘটিয়েছেন এবং এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়গুলোর সমন্বয় সাধন করেছেন। শেষ কথায় তিনি বিশ্ব সভ্যতার সব ক্ষেত্রে ধর্মের অবদানকেই অপরিসীম উল্লেখ করে ধর্মের জয় আর অধর্মের ক্ষয় কামনা করেছেন।
মানুষের মর্র্যাদা প্রতিষ্ঠায় ঐক্য, সংহতি ও সম্প্রীতির স্বাপ্নিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবেই সৈয়দ আহমদুল হককে আমরা পাই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা মানুষের মধ্যে ঐক্য-সংহতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সৈয়দ আহমদুল হক পবিত্র কুরআনের বাণীর মর্ম অনুধাবন করে মুসলিম ঐক্য, সংহতি ও পারস্পরিক সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি ১৯ জুন ১৯৯১ তারিখে পবিত্র মক্কা নগরীতে অনুষ্ঠিত নিখিল বিশ্ব মুসলিম কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হয়ে মুসলিম ঐক্য-সম্প্রীতির ওপর এক ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। তার বক্তৃতায় পবিত্র কুরআন, হাদিস এবং মহাকবি ইকবাল ও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা উদ্ধৃত করেন।
মানুষের মধ্যে ফেরকা, জাতপাতগত মতপার্থক্য ভুলে ইসলাম ও মুসলিম প্রশ্নে সবার মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন সৈয়দ আহমদুল হক। তার মতে জাতি হিসেবে মুসলিমদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারেও ঐক্য-সংহতির কোনো বিকল্প নেই; এমনকি তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন ভবিষ্যৎ শান্তিময় দুনিয়া গড়তেও পারস্পরিক সম্প্রীতিকেই। ক্ষুদ্র স্বার্থ, মাজহাবি দ্ব›দ্ব আর ফতোয়ার বেড়াজালে সব মানুষের প্রত্যাশিত শান্তি-প্রীতি যেন নষ্ট করা না হয় সেজন্য সব গোষ্ঠীকে দায়িত্ব পালন করতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন- ‘আল্লাহ এক, নবী এক, কুরআন এক, ধর্ম এক, ইমান এক- সুতরাং মুসলমানরাও এক ও ঐক্যবদ্ধ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।’ তিনি মহাকবি ইকবালের সুরে বলেছেন, ‘রং ও রক্তের মূর্তিকে ভেঙে দাও এবং সমগ্র মুসলমানের জন্য একটি মিল্লাতে নিজেকে হারাও; যাতে কোনো তুরানি, কোনো ইরানি বা কোনো আফগানি বাকি না থাকে।’
সৈয়দ আহমদুল হক সুফিতত্ত্বের গবেষণার সঙ্গে তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় ঘটিয়েছেন। মানবসৃষ্টি ও এর সৃষ্টিতত্ত্ব কিংবা সৃষ্টি রহস্য নিয়ে বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাগুলো ও এসবের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে অমূলক ও ভ্রান্ত হিসেবে তিনি তুলে ধরেছেন, করেছেন সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত। তিনি রুমির আধ্যাত্মিক বিবর্তনবাদ সম্পর্কে বলেন, মওলানার আধ্যাত্মিক বিবর্তনবাদকে ডারউইনের জৈবিক মতবাদ মনে করে অনেকে ভ্রান্তিতে পতিত হন। মওলানা তার মসনবীতে একাধিক জায়গায় এবং দিওয়ানে শামস তাবরিযিতে আধ্যাত্মিক বিবর্তনের কথা বলেছেন। সেই আধ্যাত্মিক বিবর্তনবাদকে সৈয়দ আহমদুল হক বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে এ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দূর করেছেন। সুফিতাত্ত্বিক গবেষণা ও রচনাবলিতে তিনি বহু জায়গায় আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান মনস্কতার সদ্ব্যবহার করে তার সাহিত্যকর্মকে বিজ্ঞানসম্মত ও বিজ্ঞানমানে উন্নীত করেছেন।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়