এশিয়া কাপ : হংকংকে লজ্জায় ডুবিয়ে সুপার ফোরে পাকিস্তান

আগের সংবাদ

বন্ধুত্ব সুসংহত করার প্রত্যয় : বাংলাদেশে চীনা বলয় ঠেকাতে চায় দিল্লি > পানিসহ সীমান্ত সুরক্ষায় সমাধান চায় ঢাকা

পরের সংবাদ

গর্ব করার বিষয়গুলোই ধ্বংস হচ্ছে ক্রমান্বয়ে

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কল্পনা করুন, কোনো এক বিজ্ঞানী তৎকালীন জার্মানি তথা সারা দুনিয়ার ত্রাস হিটলারকে প্রমাণ করে দিলেন যে, তার পূর্বের চতুর্দশ পুরুষটি ছিলেন সেই ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ, যে সম্প্রদায়কে হিটলার পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রাণপাত করেছিলেন। কিংবা দিনাজপুরের দোর্দণ্ড প্রতাপ সমাজের ত্রাস ধর্মীয় জোশে বলিয়ান সোলেমানকে যদি কেউ বলেন, কিছুদিন আগেই অর্থাৎ গত বছরের দুর্গাপূজার সময় যে অভাগা সংখ্যালঘু দরিদ্র মানুষটির ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, সেই মানুষটিও আসলে ওই প্রবল প্রতাপশালী হিংস্র মানুষটির মতো একই জিন বহন করছেন নিজের শরীরে, কেননা তাদের দ্বাদশ ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষটি একই ব্যক্তি ছিলেন। এমন তথ্য দেয়া বিজ্ঞানীকে সমাজে বাঁচানো যাবে কি-না সন্দেহ আছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও সঠিক যে, যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানীকে হত্যা করলেই বৈজ্ঞানিক সত্যকে পাল্টে দেয়া যায় না। চামড়ার রং, ধর্ম বা জাতের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির আয়োজনকে জিনতত্ত্বের ওপর ভর করা সত্যি বলছে, আজকের পৃথিবীর কোটি কোটি জীবিত মানুষ আসলে এসেছে কয়েকটি আলাদা দম্পতির বংশধারার পথে। এই পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীরা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া হোমো সেপিয়েন্স। আজকের পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের ঊর্ধ্বতন পুরুষ ও নারীরা যদি সবাই আলাদা আলাদা হতেন, তাহলে এক হাজার বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা আজকের জনসংখ্যার থেকে প্রায় হাজার কোটি গুণ বেশি হতো। অথচ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে জনসংখ্যা ছিল তিন কোটির আশপাশে। এর অর্থ একটাই হতে পারে- হাজার বছরের ব্যবধানে সময়ের উল্টোপথে তাদের পূর্বনারী-পূর্বপুরুষরা হয়তো বড় হচ্ছিলেন একই বাবা-মায়ের কোলে-পিঠে। বিজ্ঞানীরা তাই সারা পৃথিবীর মানুষকে আত্মীয় বলে ভাবতে শেখান।
কিন্তু পৃথিবীর পরিস্থিতি এখন পাল্টে গিয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণিত সমাজে আমরা কেউই আর বসবাস করতে পারছি না। আগে হনুমানকে হানিমুন বানালে কিংবা চাঁদ-তারা কোনো প্রতীককে পায়ের নিচে এঁকে দিলে কেউ আপত্তি করত না, করলেও অন্য লোকে হেসে উড়িয়ে দিত। এখন আপত্তি ওঠে না, বরং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অশান্তি চারদিকে ছেয়ে ফেলে। দেব-দেবী, ধর্মগুরু, ধর্মীয় স্থান কিংবা বিষয় প্রভৃতি সম্পর্কে সমালোচনা তো অনেক পরের কথা। সম্পূর্ণ অকিঞ্চিৎকর মন্তব্য, এমনকি নির্ভেজাল কৌতুককে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে বহু অশান্তির আগুন জ্বলছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে। এখানেই প্রশ্ন- পরিস্থিতি এমন পাল্টে গেল কেন? আগুন জ্বলার আশঙ্কা এমন বেড়ে গেল কেন? উত্তরে অনেকেই বলবেন, সামাজিক অসহিষ্ণুতা ভূমিকার প্রভাবের কথা। তবে তা কিন্তু প্রকৃত ব্যাধি নয়, ব্যাধির লক্ষণ মাত্র। ব্যাধির মূলে আছেন ক্ষমতার কারবারিরা, যা এই বিষাক্ত অসহিষ্ণুতাকে সৃষ্টি ও লালন করে চলেছেন। নানা উপলক্ষে যে আগুন জ্বলছে বা জ্বলবার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে- সচরাচর তা নিজে জ্বলে না, তাকে জ্বালানো হয়। প্রথমে ক্ষমতাবানরা একটা নিশানা স্থির করে। তারপরে সেই অনুসারে একটা অশান্তির উপলক্ষ খুঁজে অথবা বানিয়ে নেয়। তারপরে অশান্তির নাম করে নির্ধারিত শিকারের ওপর চড়াও হয়। এভাবেই চোখের সামনে স্বাধীনভাবে কথা বলার, ছবি আঁকার, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ লেখার, সিনেমা বানানোর, সংবাদ প্রচারের অধিকার সবই কেমন মøান হয়ে পড়েছে।
বহু ক্ষেত্রেই প্ররোচনার কারণ হিসেবে দাঁড় করা হয় মানুষের আবেগে কিংবা ধর্মের আবেগে আঘাত করার যুক্তি। এমন এক সমাজে আমরা পৌঁছে গিয়েছি, যেখানে কট্টর স্বভাবের মতান্ধরাই সর্বেসর্বা। তাদের চোখে নেই জিনতত্ত্বের ন্যূনতম সত্য তথ্য। তারা অনেকে আপন জিনের অংশীদার তো ভাবেই না, বরং বিরোধী শিবিরের মহাশত্রæ ভাবতেই বেশি পছন্দ করে। আমাদের প্রাণে এখন আর দেশভক্তি নেই। মনের ভেতর দেশটাই আর নেই। দেশ বললে, দায় নিতে হয়; প্রতিবেশীকে আগলে রাখার দায়, ভিন্ন সুর সঙ্গে নিয়েও সমষ্টিবদ্ধ থাকার দায়। দেশভক্তি থাকলে আর্ত দেশবাসীর প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য, সহমর্মিতা আসে অন্তর থেকে। দেশ শুধু কাঁটাতার বা দেয়াল ঘেরা এক ভৌগোলিক ভূখণ্ড নয়। আরো বড় কিছু। এই দেশভক্তি প্রতিবেশীর দিকে সন্দিহান হয়ে তাকাতে নয়, সহমর্মী হতে শেখায়, ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিয়েও তাকে নিজের একটি অংশ হিসেবে দেখার কাজটা সহজ করে দেয়। এ-ই হলো দেশ। দেশ মূলত একটি সমষ্টিবদ্ধ ধারণা। স্বাধীনতা এক সমষ্টিবদ্ধ অর্জন। এসব ভুলে গিয়ে ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস ইত্যাদি খণ্ডিত এককে বিভিন্ন ধরনের অপর তৈরির ভেদাভেদ ও বিদ্বেষে মেতে উঠে আজ আমরা দেশকেই বুকের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছি। এই সমাজ ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ অবধি নিয়ে যেতে পারছে না, আমিত্বে গ্রাস করে ফেলছে। সেই সুস্থ সমাজকে আমরা হারিয়েই ফেলেছি, যেখানে ছিল আমাদের পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ এবং আত্মসমীক্ষা আর সংযম। সমস্যাটি কি শুধুই আমাদের, মানে তৃতীয় বিশ্বের? নিশ্চয়ই নয়। সমস্যাটি পশ্চিমেরও। পশ্চিমের দাবি, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেকটাই সফল। শিল্পবিপ্লব আর রেনেসাঁর যুগ, দুই মহাযুদ্ধের বিভীষিকা ইত্যাদি পেরিয়ে বহু দিন, বহু বছর, বহু যুগজুড়ে পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ নির্মাণে উজ্জ্বল প্রভাতের ছবি এঁকে রেখেছে ঠিকই। তবে তারা পূর্বের দিকে তাকিয়ে নিজেদের সাফল্যের মূল্যায়ন করে। নিজেদের চারপাশে, মনের ভেতর ও বাইরে যে অন্ধকার, যে বৈষম্য, যে শ্রেণি বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িক অহমিকা তাদের ঘিরে রেখেছে, তা তারা দেখতে পায় না। পাশ্চাত্যের এই অসুখ তার গণতান্ত্রিকতাকে খণ্ডিত করে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে তাকেও গ্রাস করেছে বর্ণবৈষম্য ও ইসলাম ফোবিয়া। এমনটা ছিল না বিশ্ব এর আগে কখনো। এমনকি ইসলাম-পূর্ব আরবেও ইহুদি, খ্রিস্টান, প্রকৃতিবাদীরা পাশাপাশি বসবাস করেছেন। কোনো ধরনের সংঘর্ষ গোত্রপ্রধান সমাজকে সাম্প্রদায়িকতা দুষ্ট করার সুযোগ পায়নি। এক গোত্রের সঙ্গে আর এক গোত্রের লড়াই হতো। গোত্রপ্রধান অথবা সর্বমান্যরা মীমাংসায় বসতেন।
এই সেদিনের বাংলাদেশেই দেখুন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি অধ্যায়ে, আন্দোলনের আলোড়নে, সব ধর্মীয় সমাজের সংযোগের কোথাও কোনো কমতি ছিল না। সেদিনের নেতৃত্বের, লড়াইয়ের অঙ্গীকারের লক্ষ্য ছিল একটাই- শোষণমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠন। এই ভাবাদর্শ সংখ্যাগুরুবাদী সংকীর্ণতাকে নাকচ করে ভবিষ্যতের বহুত্ববাদিতার ভিত এবং সিঁড়ি তৈরি করেছিল। তার প্রমাণ মিলবে সেই সময়ের লেখক, কবি, চিত্রকর, সাংবাদিক এবং জনমুখী রাজনীতিবিদ সবার কাজে। কথা ছিল, দেশ হয়ে উঠবে সব সম্প্রদায়ের ভাব ও ভাবাবেগের মানবজমিন। কথা ছিল, দেশ হয়ে উঠবে ধর্মময়, নিরপেক্ষ এবং সহিষ্ণুতা মিলিত চর্চার মানবজমিন। কথা ছিল, এই দেশে সামাজিক বৈষম্য থাকবে না, প্রতিটি সম্প্রদায় নির্ভয়ে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, নিজ প্রয়োজনে মন্দিরে যাবে, মসজিদে যাবে, গির্জায় যাবে। কথা ছিল, কেউ ধর্মের বিচারে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু হিসেবে চিহ্নিত হবে না। সবাই হবে দেশের সমান সুযোগ-সুবিধাভোগী নাগরিক।
কিন্তু আজ যেন সবটুকুই শুধু ইতিহাস। বর্তমানটা বড় কলঙ্কজনক। বাংলাদেশটা আর আগের জায়গায় নেই। অসহিষ্ণুতার আগুন হাতে তার এখন। যে কোনো সময় জ্বলে উঠতে পারে যে কোনো অজুহাতেই। সেই কবে যেন ভুলে গেছে সবাই ’৭২-এর সংবিধানকে। রাষ্ট্রেরও নির্দিষ্ট ধর্ম হয়ে গিয়েছে এখন। সংখ্যায় কমতে কমতে প্রায় শেষ ধাপেই এসে গেছে অমুসলিম অধিবাসী। ঠিক যেন ভুলেই গেছে তারাও এ দেশেরই সন্তান। যুদ্ধে-লড়াইয়ে তাদেরও ছিল সমান তালের উন্মাদনা, সহযোগিতা। এ যেন সেই কবেকার ইতিহাস। সোলেমান আর গোপাল। দুজনে দুটি পৃথক মানুষ। দুটি সুস্পষ্ট অবয়ব। তাদের তখনো ধরা যেত, ছোঁয়া যেত। বলা যেত- গোপাল, সোলেমান অপমান করেনি। তোমার বোঝার ভুল হয়েছে। সোলেমান অমনি দোষ স্বীকার করত। কোলাকুলি করত গোপালের সঙ্গে। ব্যাপারটা ওখানেই চুকে যেত। আজ যেন এসব আর এভাবে কেউ ভাবে না। আসলে মানুষ আর যেন মানুষ থাকতে চায় না। তাই গোপাল আর গোপাল থাকল না। সে হিন্দু সমাজের বিস্তীর্ণ জলে নুনের পুতুলের মতো গলে গেল। সোলেমানও আর সোলেমান থাকল না। সোলেমানও মিলিয়ে গেল মুসলমান সমাজের মধ্যে। নুনের পুতুলদের আর যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাচ্ছে না। এই বিশালব্যপ্ত না-বোঝা, না-শোনার সামনে তাই আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি হতভম্ব হয়ে। আমাদের বিধ্বস্ত বিশ্বাস, চেতনাজুড়ে এই কথাটাই ঝনঝন করে বাজছে- আমরা বিভক্ত হয়ে গেলাম। দেশে ঘৃণার রাজনীতি আর সমাজনীতির প্রাবল্য আমাদের মাঝে মেরুকরণ বাড়িয়েছে, আস্থার পরিমাণ কমিয়েছে, বাক স্বাধীনতার পরিসর খণ্ডিত করেছে। যে বিষয়গুলো নিয়ে গোটা বিশ্বে আমরা গর্ব করতাম, খ্যাতিমান ছিলাম, সম্মান অর্জন করতাম- ঠিক সেগুলোই আমাদের ধ্বংস হচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়