বাজারের ব্যাগে মিলল নবজাতকের লাশ

আগের সংবাদ

দেশীয় জ্বালানি উত্তোলনে গুরুত্ব : অনুসন্ধান ও উত্তোলনে মহাপরিকল্পনা > ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করার উদ্যোগ পেট্রোবাংলার

পরের সংবাদ

স্বাস্থ্য পরীক্ষার ভুল রিপোর্টে সুস্থ মানুষেরও জীবন সংশয় : অদক্ষ জনবল, মান নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : প্রথম ঘটনাটি চলতি বছরের জুন মাসে। ইতালির নাগরিক ফারহানা শেখ ঢাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসকের পরামর্শে সেখানে ছেলে আরাফাত রহমানের বুকে প্রথমে এক্স-রে পরে সিটিস্ক্যান করান। এখানকার রিপোর্টে আরাফাতের শরীরে দুরারোগ্য ক্যান্সারের জীবাণু রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারে আরো নিশ্চিত হতে বনানীর প্রেসক্রিপশন পয়েন্টে ওই দুটি পরীক্ষা আবারো করান। সেখানকার রিপোর্টেও ক্যান্সারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। পরপর দুটি রিপোর্টে ক্যান্সারের অস্তিত্ব পাওয়ায় পরিবারের সবাই ভেঙে পড়েন। সন্দেহ দূর করতে ওই একই পরীক্ষা করানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। কিন্তু সেখানাকার রিপোর্টে ক্যান্সারের কোনো জীবাণু পাওয়া যায়নি। এমন রিপোর্টে পরিবারটির মনে কিছুটা স্বস্তি এলেও পড়ে যান দ্বিধায়। আরো নিশ্চিত হতে রাজধানীর পান্থপথের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করানো হয়। এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টেও ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়া যায়নি। দেশে দুই ধরনের রিপোর্ট পাওয়ার পর কলকাতার একটি হাসপাতালে আরাফাতের বায়োপসি করা হলে সেখানকার রিপোর্টে ক্যান্সারের জীবাণুর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি চট্টগ্রামের এবং আরো মর্মান্তিক। ভুক্তভোগী চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানার ঈদগাঁ বউবাজার এলাকার বাসিন্দা আইনুর নাহার সীমা। গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে থাকায় সীমা বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এর মধ্যে একজন চিকিৎসকের পরামর্শে চট্টগ্রামের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এপিক হেলথকেয়ারে গত ২৫ জুলাই পেটের আলট্রাসনোগ্রাম করান। অধ্যাপক ডা. মো. দিদারুল আলম স্বাক্ষরিত ওই রিপোর্টে খাদ্যনালীতে ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ক্যান্সারের বিষয়টি আরো নিশ্চিত হতে একই পরীক্ষাটি আবার করানো হয় নগরীর শেভরন ল্যাবে। সেখানেও ক্যান্সারের জীবাণু পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. আলী আজগরের শরণাপন্ন হলে তিনি রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাইফুল হকের কাছে রেফার করেন। দুই ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পাওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে খাদ্যনালীতে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন ডা. সাইফুল। নগরীর পাঁচলাইশে নিজের মালিকানাধীন একুশে হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে ৮ আগস্ট অপারেশন করানো হয়। অপারেশন করে সীমার শরীর থেকে অপসারণকৃত টিস্যুটি চট্টগ্রামের চন্দনপুরার বিশেষায়িত সাইটো-সাইট ল্যাবে নিয়ে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করান তার স্বজনরা। সেই ল্যাবের রিপোর্টে অপসারণকৃত টিস্যুতে ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে সীমার অপারেশনের জায়গা দিয়ে রক্ত ও পুঁজ বের হতে থাকে। ডা. সাইফুলকে বিষয়টি জানানোর পর তিনি ওই সীমাকে আবারো একুশে হাসপাতালেরই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার স্বজনদের জানান, সীমার খাদ্যনালীতে একটি ফুটো হয়ে গেছে। ১৮ আগস্ট সীমাকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ওই দিনই মৃত্যু হয় সীমার।
একই পরীক্ষার রিপোর্ট একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একেক রকম হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। করোনা মহামারিকালে এমন তথ্য আরো বেশি করে সামনে এসেছিল। পরীক্ষা না করে নিজেদের মতো করে রিপোর্ট তৈরি করার অভিযোগও রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। পুরুষের পরীক্ষা রিপোর্টে নারীজনিত রোগের বিবরণ পাওয়া গেছে এমন নজিরও আছে। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।
বিভিন্ন সময় অভিযানে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেয়াদোত্তীর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপাদান পাওয়া যায়। সেখানে থাকে না প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, উপযুক্ত চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান বা প্যাথলজিস্ট। অদক্ষ ও ভুয়া জনবল দিয়েই অনেক প্রতিষ্ঠান চলে। এছাড়া বেশ কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডিগ্রিধারী বায়োকেমিস্ট বা প্যাথলজিস্টদের সিল-স্বাক্ষর দেয়া প্যাড রেখে দেয়া হয়। সুযোগ বুঝে ডায়াগনস্টিকের সাধারণ কর্মীরা নিজেদের মনগড়া রিপোর্ট লিখে দেন। বিশেষ করে সকালের দিকে চিকিৎসকরা হাসপাতালে নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকেন, তখন আগাম সিল-স্বাক্ষর দেয়া রিপোর্ট ফরম ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাইনবোর্ডে বিভিন্ন পরীক্ষার তালিকা থাকলেও বাস্তবে সেখানে অনেক পরীক্ষাই হয় না। তারা অন্য জায়গা থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনেন বা ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঠিক রিপোর্ট। কিন্তু রোগ নির্ণয়ের নামে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার যে রিপোর্ট দেয় তাতে রীতিমত জীবন সংশয়ে পড়তে হয় রোগীকে। প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক মনোভাব, মান নিয়ন্ত্রণ না থাকা, অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে ল্যাব চালানোর কারণেই এমনটা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব বলেন, একজন চিকিৎসক রোগীর রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টের ওপর নির্ভর করেন। রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দেন। সেই রিপোর্ট যদি হয় ভুল, তবে ওষুধ ও পরবর্তী সব চিকিৎসাই ভুল হবে- এটাই স্বাভাবিক। এতে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। তাই উচ্চ ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ টেকনোলজিস্ট যারাই রোগীর বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন, তাদের অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকারের পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকার ফলেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মানুষকে প্রতারিত করছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের সাবেক সভাপতি ও মৌলিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান ভোরের কাগজকে বলেন, হিস্ট্রোপ্যাথলজির ক্ষেত্রে রিপোর্টের তারতম্য হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অভিজ্ঞতার অভাব। এছাড়া তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা নেই। অন্যান্য রিপোর্টের ক্ষেত্রেও যে হেরফের হয়; সেক্ষেত্রে ল্যাবে যারা কাজ করেন এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিষয়টি তদারকি করেন- তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব থেকেই এমনটা হয়। এসব ল্যাবে মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা করা হয় না। মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় যে খরচ হয় সেটি তারা বাঁচায়। এসব নানা করণে রিপোর্টের হেরফের হয়। অনেক ক্ষেত্রে রি-এজেন্টের (ডায়াগনস্টিক টেস্টে রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান) কারণের রিপোর্টের পার্থক্য হয় বলে মনে করেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ইকবাল আর্সলান।
প্যাথলজিক্যাল ডায়গনসিসে ভুল হওয়ার বিষয়টি পুরো বিশ্ব জুড়েই আছে বলে জানান রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এস এম আলমগীর। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশে কত শতাংশ রিপোর্টের ক্ষেত্রে তথ্যের পার্থক্য হয়- এ বিষয়ে কোনো সুর্নিদিষ্ট তথ্য নেই। তবে প্যাথলজিক্যাল ডায়গনসিসে ভুল হতেই পারে। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয় পুরো বিশ্বেই হতে পারে। দেশ ভেদে তা কম বেশি হয়। মেশিন যখন পজেটিভ বলে, সেটি সব সময়ই যে পজেটিভ হবে- এমনটা নাও হতে পার। কিছু ক্ষেত্রে ভুল হয়। নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমার নিজেরও এমন অভিজ্ঞতা আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতা একটি বড় বিষয়।
আর বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসোসিয়েশনের (বিএমটিএ) সভাপতি আলমাস আলী খানও মনে করেন- মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং অদক্ষ জনবল দিয়ে কাজ করানোর ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ডায়গনসিস রিপোর্টের তথ্যে বড় ধরনের হেরফের হয়। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে সেবা বা দেশের ভাবমূর্তির চেয়ে বেশি প্রধান্য পায় ব্যবসার দিকটি। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান বিশ্ব মানের রিপোর্ট দিতে পারবে না; তখন তার প্রতিষ্ঠান চালানোর কোনো অধিকার নেই।
অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এমন অনেকেই বলেন আমাদের দেশের মেডিকেলের রিপোর্টে যে তথ্য দেয়া হয়েছে কলকাতা বা বিদেশে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেটি ভুল। এতে আমার দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। রোগীদের আস্থা না থাকায় তারা বিদেশ গিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছেন। এতে আমাদের দেশের রাজস্ব বাইরে চলে যাচ্ছে। একটা ভুল রিপোর্ট একটা পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি সেটি ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারোর পক্ষেই অনুধাবন করা সম্ভব নয়। অধিকাংশ বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দক্ষ জনবল নেই। তাদের ডিগ্রি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কয়েক মাসের একটা কোর্স করলেই এমন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। কম বেতনে ভালো ও দক্ষ জনবল না পেয়ে আনাড়িদের নিয়োগ দেয়া হয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়