বাজারের ব্যাগে মিলল নবজাতকের লাশ

আগের সংবাদ

দেশীয় জ্বালানি উত্তোলনে গুরুত্ব : অনুসন্ধান ও উত্তোলনে মহাপরিকল্পনা > ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করার উদ্যোগ পেট্রোবাংলার

পরের সংবাদ

দুই ছেলেকে চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন ভ্যানচালক পিতা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মকিম উদ্দীন। পেশায় তিনি একজন ভ্যানচালক। অশিক্ষিত হয়েও শিক্ষাকে ধারণ করে উদাহারণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি ভ্যান চালিয়েই চীনে পাঠিয়ে তার দুই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন। শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা আর মনের জোর নিয়েই অসাধ্যকে সাধন করেন এই বিপ্লবী পিতা।
ছোট সময় থেকেই স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়ার মকিম উদ্দীনের। কিন্তু অভাবের কারণে সেই সময় পড়ালেখা থেমে যায় তার। তবে নিজে পড়ালেখা করতে না পারলেও, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য মনে একটা জেদ কাজ করত তার। নিজে পড়ালেখা করতে না পারার আক্ষেপ তাকে সব সময় তাড়া করত। তাই সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি।
মকিম উদ্দীন দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে পায়ে চালিত ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন এবং ছেলেমেয়ের খরচ জোগান দিতেন। এখন একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যানের আয় দিয়েই সংসার চালান তিনি। দুই ছেলে দুই মেয়ের বাবা মকিম উদ্দীন। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক বছর আগে। আর ছোট দুই ছেলে পড়াশোনা করছেন। বড় ছেলে হবিবুর রহমান চীনের জিয়াংসু ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ডিজাইন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচার অটোমেশন বিভাগে পড়াশোনা করছেন। আর ছোট আবুল হাসিম চীনের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করছেন।
হাজারো কষ্টে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় সমাজে এক সফল ও গর্বিত বাবার সম্মানের জায়গা তৈরি হয়েছে মকিম উদ্দীনের। তার পরিবারও সমাজের কাছে এক আদর্শ পরিবার হিসেবে ভূষিত হচ্ছে। প্রতিবেশী ফরিদা আক্তার ও আসমানী বেগম বলেন, চাচা-চাচি (মকিম উদ্দীন ও তার স্ত্রী) ছেলেদের অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করাচ্ছেন। আমি ভাবি তাদের মত পরিশ্রম করে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারব কিনা। তবে তারা আমাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। কষ্ট ও পরিশ্রম করে সব কাজ করা যায়। তারই দৃষ্টান্ত তাদের দুই ছেলে।
মকিম উদ্দিনের দুই ছেলের স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, মকিম উদ্দিনের দুটি ছেলেই খুবই মেধাবী। তারা ক্লাসে মনোযোগের সঙ্গে পড়াশুনা করত। অন্য বাচ্চাদের মধ্যে ঘোরাফেরা করত না। তাদের ফলাফলও অনেক ভালো ছিল। তবে তাদের বাবা-মা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের পড়াশুনা ও মানুষের মতো মানুষ হওয়ার রাস্তা প্রসারিত করেছে। তারা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে মা-বাবার কষ্ট দূর করুক এটাই কামনা।
ভ্যান চালক মকিম উদ্দীনের স্ত্রী হুসনে আরা বেগম বলেন, আমার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েদের অনেক কষ্ট করে বিয়ে দিয়েছি। আর ছেলেদের পড়াশোনার করানোর সময়টা মনে হলে আমার বুক ফেটে যায়। মনের অজান্তেই চোখ থেকে কান্না বের হয়। কখনো খেয়েছি, কখনো আবার না খেয়ে থেকেছি তবুও সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। পৈতৃক এক বিঘা আবাদি জমি ছিল। ছেলেদের জন্য তা বিক্রি করতে হয়েছে। একমাত্র ভ্যানটিই আমাদের সম্বল। ওদের বাবার অনেক বয়স হয়েছে তবুও প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে বের হয়। কোনোদিন তিনি বসে থাকেন না। আজকে ছেলেরা চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করছে। প্রতি মাসে টাকা দেয়া লাগে। ছেলেরাও অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। আমাদের যত কষ্টই হোক আমরা তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাতে চাই। এভাবেই তিনি ও তার স্বামীর দৃঢ়তার কথা বলছিলেন হুসনে আরা বেগম।
ভ্যান চালক মকিম উদ্দীন বলেন, এক বিঘা আবাদী জমি ছিল আমার। বড় ছেলে বলল, সে চীনে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করবে। আমি ভেবেছি, ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হলে অনেক আবাদি জমি কিনতে পারবে। তাই জমিটা বিক্রি করে ছেলেকে চীনে পাঠিয়েছি পড়াশোনার জন্য। পরে আবার ছোট ছেলেও চীনে গেছে। এখন প্রতি মাসে তাদের জন্য টাকা পাঠাতে হয়।
মকিম উদ্দীন আরো বলেন, আমার একমাত্র আয়ের পথ ভ্যান। এটি চালিয়ে যা হয় তার সবটুকু জমা করে পাঠিয়ে দেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী কখনো খাই, কখনো আবার না খেয়ে থাকি। কাউকে বলি না এমন কষ্টের কথা। আমার কষ্ট হোক তবুও তারা (সন্তানরা) ভালো করুক এটাই চাওয়া আমার।
মকিম উদ্দীনের বড় ছেলে হবিবুর রহমান বলেন, ২০১৯ সালে চীনে ডিপ্লোমা পড়াশোনা করতে আসি। বাবার কাছে চীনে আসার আগ্রহের কথা জানানোর পর কোনো প্রশ্ন না করেই রাজি হয়ে যান। তার শেষ সম্বল ৩৩ শতাংশ জমি বিক্রি করে দেন। তাই আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, আমি ও আমার ছোট ভাই পড়াশোনা শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে দেশের জন্য কাজ করব। কারণ আমাদের দেশ উন্নত দেশগুলোর থেকে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে আছে। আমরা আমাদের মেধা দেশের জন্য কাজে লাগাতে চাই। আমাদের খুব ইচ্ছা আমরা গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করব। আর বাবা মায়ের সেবা করব। তারা যে কষ্ট ও শ্রম দিয়ে আমাদের উন্নত শিক্ষা দিয়ে ধন্য করেছেন, শেষ বয়সে তাদের কষ্টটা লাঘব করতে চাই বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন বলেন, ভ্যান চালিয়ে বৃদ্ধ বাবা দুই ছেলেকে চীনে পড়াশোনা করাচ্ছেন, বিষয়টি অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো। এখান থেকে বোঝা যায়, যদি মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে, তবে সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। এটি আমাদের জন্য আনন্দায়ক বিষয়। যদি কখনো তার প্রয়োজন হয় তাহলে উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে দাঁড়াবে।
এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান জানান, মকিম উদ্দিন ও তার মেধাবী সন্তানদের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অন্যদের কাছে শুনেছি। মহৎ ও মহান সেই বাবা-মা, যারা সন্তানদের মানুষ করতে তাদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে সব ধরনের কষ্ট করছেন। অশিক্ষিত হয়েও মকিম উদ্দিন শিক্ষার প্রতি ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা সত্যিই বিরল। শুধু উপজেলা প্রশাসন নয়, মকিম উদ্দিনের দুই ছেলের পড়াশুনা ও মকিম উদ্দিনের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসনও থাকবে বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়