ভূমির কুতুবকে দেয়া হাইকোর্টের জামিন আপিলে বাতিল

আগের সংবাদ

তৃণমূলে সহিংসতা বাড়ছেই : দুই সপ্তাহে অন্তত ২০টি স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে, দলগুলোকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ বিশ্লেষকদের

পরের সংবাদ

শিক্ষা প্রদানে সংখ্যাগত রূপান্তর নয় গুণগত মান বৃদ্ধি বেশি জরুরি!

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জনপরিসরে জানাজানি আছে, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। তাই শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া প্রকারান্তরে জাতির মেরুদণ্ডের যথাযথ পরিচর্যার শামিল। আমরা এ পরিচর্যার তারিফ করি। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যদি মেরুদণ্ড ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে কোনো জাতি মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। যেহেতু আজকের প্রজন্মই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, সেহেতু আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে হলে আজকে প্রজন্মকেই যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী হবে। তাই তারা যথাযথ শিক্ষা পাচ্ছে কিনা, সেটা আগামীর বাংলাদেশ কী রকম হবে তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে আরো মনে রাখা জরুরি যে, মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম একটি হচ্ছে শিক্ষা। বলা হয় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকারের সারণি অর্থাৎ প্রথমে খাদ্যের সংস্থান, তারপর কাপড় পরিধানের ব্যবস্থা, এরপর একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই। খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানের পরই মানুষের মৌলিক অধিকার হচ্ছে শিক্ষা। তাই প্রতিটি রাষ্ট্র শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সেবাগুলোর মধ্যে অন্যতম বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশও শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় সার্বিক পলিসি-ফ্রেমওয়ার্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সেবা খাত হিসেবে বিবেচনা করে। সম্প্রতি ছুটির দিন বাড়িয়ে সপ্তাহে একদিনের জায়গায় দুদিন করে সরকার যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তাকে সমন্বয় করার জন্য একটি দিকনির্দেশনা প্রকাশ করেছে। সে দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ক্লাস খোলা রাখার দিন কমিয়ে, ক্লাসের সময় কমিয়ে, ক্লাসের সংখ্যা বাড়িয়ে, বৃহস্পতিবার অর্ধদিবসের জায়গায় পূর্ণ দিবস করে একটি নির্দেশনা জারি করেছে, যাতে ছুটির দিন বাড়ানোর কারণে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন ও পাঠদানের ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ ধরনের পরিকল্পনা এবং নির্দেশনার মধ্যে শিক্ষার প্রতি সরকারের সচেতন মনোযোগ প্রকাশিত হয়েছে এবং শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের বিষয়টিও প্রতিভাত হয়েছে। কোভিড-উত্তর সর্বক্ষেত্রে যখন নতুন উদ্দীপনা কাজ করছে এবং কোভিডের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার একটা আপ্রাণ চেষ্টা, তাগিদ ও প্রবণতা কাজ করছে, সেখানে কর্মদিন কমানোর কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন করে কোনো ধরনের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে যে সরকারের এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচেতন দৃষ্টি আছে, এর মধ্য দিয়ে সেটাই নতুন করে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু এখন বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, সরকারের সব ধরনের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নতুন পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সত্যিকার অর্থে ছুটির দিন একদিন বাড়ানোর কারণে যে ঘাতটি সেটা ক্লাসের সময় কমিয়ে ক্লাসের সংখ্যা বাড়িতে পুষিয়ে নেয়া যাবে কিনা।
৩১ আগস্ট জারি করা নতুন আদেশে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘হাফ ক্লাস’ বলে আর কোনো কিছু থাকবে না। সপ্তাহের অন্যান্য পাঁচদিনের মতোই ওইদিন সব স্কুল এবং কলেজে পূর্ণ ক্লাস অনুষ্ঠিত হবে। নবম ও দশম শ্রেণিতে আগে ছিল দৈনিক ৬ পিরিয়ড, কিন্তু এখন থেকে প্রতিদিন ক্লাস হবে ৭ পিরিয়ড। ফলে আগে ছিল প্রতিদিন ৬টি করে ৬ দিনে ৩৬টি ক্লাস; আর এখন থেকে দৈনিক ৭টি করে ৫ দিনে ৩৫টি ক্লাস। অন্যদিকে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একটি করে ক্লাস বাড়িয়ে সপ্তাহে ৩৫টি করা হলেও বৃহস্পতিবার দুই পিরিয়ড আগে ছুটি দিতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ষষ্ঠ, সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণিতে সপ্তাহে ক্লাসের সংখ্যা হবে ৩৩টি। রবি থেকে বৃহস্পতিবার এক শিফটের মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ৬ ঘণ্টা ১০ মিনিট ক্লাস চলবে এবং এর মধ্যে থাকবে ১৫ মিনিটের সমাবেশ ও ৩০ মিনিটের বিরতি। আর দুই শিফটের মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলগুলোর প্রতি শিফটে ১৫ মিনিটের সমাবেশ, ৩০ মিনিটের বিরতিসহ ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট ক্লাস চলবে। এক শিফটের প্রতিষ্ঠানে প্রতি পিরিয়ড চলবে ৪৫ মিনিট। আর দুই শিফটের মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে প্রথম পিরিয়ড চলবে ৪৫ মিনিট। আর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পিরিয়ড চলবে ৪০ মিনিট। আর পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম পিরিয়ড চলবে ৩৫ মিনিট করে। অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির প্রতিটি ক্লাস পিরিয়ড হবে ৫০ মিনিটের। বাংলা, ইংরেজি ও শাখাভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ের জন্য সপ্তাহে সব বিষয়ে ৫টি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য তিনটি ক্লাস হবে। আর ঐচ্ছিক বিষয়ের জন্য সপ্তাহে ৫টি ক্লাস হবে। শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে মোট ৩৩টি ক্লাস করতে হবে। এ হচ্ছে সরকারি নির্দেশনার সারাংশ। মোটা দাগে বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার দিন একদিন কমালেও ক্লাসের সংখ্যার দিক দিয়ে সেটা কীভাবে পুষিয়ে নেয়া যায়, তার একটা প্রচেষ্টা এখানে আছে। আবার ক্লাস পিরিয়ডের সময় সামান্য কমিয়েও প্রতিদিন ৬টার জায়গায় ৭টা ক্লাস দিয়ে ৬ দিনের শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে ৫ দিনে কাভার করা যায় তারও একটা আন্তরিক প্রচেষ্টা আছে। ক্লাস, দিন, সংখ্যা, পিরিয়ডের সময় এবং ক্লাসের বণ্টন প্রভৃতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে উপলব্ধি করা যায়, প্রচুর শ্রম দিয়ে এ নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে এবং একদিন ছুটির দিন বাড়ানোর কারণে কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে যাতে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে তা অত্যন্ত সচেতনভাবে যতেœর সঙ্গে নজরে রাখা হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের প্রতি এবং শিক্ষার প্রতি কর্তৃপক্ষের এ দরদের কদর করি এবং সাধুবাদ জানাই। কিন্তু ক্লাস পিরিয়ডের সময় কমিয়ে ক্লাসের সংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের শরীর ও মনে অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি হবে কিনা, সেটাও বিবেচনায় নেয়া জরুরি। ক্লাসের সংখ্যা বাড়ানো বা কমানো কিংবা ক্লাস পিরিয়ডের সময় কমানো কিংবা বাড়ানো বা সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাড়ানো বা কমানোর চেয়ে সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা। এসব নির্দেশনা, পরিকল্পনা ও পরিমার্জনার ভেতর দিয়ে নানান সংখ্যাগত পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটছে সত্য; কিন্তু শিক্ষা, পাঠ, পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে কতটা গুণগত পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটছে সেটা বিবেচনায় নেয়া সবচেয়ে বেশি জরুরি। আশা করি, রাষ্ট্র শিক্ষার গুণগত রূপান্তরের দিকেও সমান মনোযোগ দেবে যাতে করে একটি সমৃদ্ধ আগামীর প্রজন্ম তৈরি হয়, যারা এ জাতির সত্যিকার মজবুত ও টেকসই মেরুদণ্ড নির্মাণ করতে পারে।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়