ভূমির কুতুবকে দেয়া হাইকোর্টের জামিন আপিলে বাতিল

আগের সংবাদ

তৃণমূলে সহিংসতা বাড়ছেই : দুই সপ্তাহে অন্তত ২০টি স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে, দলগুলোকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ বিশ্লেষকদের

পরের সংবাদ

রুমির প্রেম আর প্রেমের রুমি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মান আয আহদে অদাম তোরা দুস্ত দরাম
আয অগাযে অলাম তোরা দুস্ত দরাম
আমি সেই আদমের যামানা থেকে তোমায় ভালোবাসি
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে আমি তোমায় ভালোবাসি।
ইন সোখানে অবিস্ত আয দারয়ায়ে বিপায়ানে এশ্ক
তা জাহানরা অব বাখশাদ জেসমহারা জান কোনাদ

সীমাহীন প্রেম দরিয়ার পানির কথা এটি ধরণিকে পানি আর দেহে দেবে প্রাণ যেটি।
আজ সেই প্রেমেরই বড় অভাব। প্রেমের অভাবের কারণেই আমাদের মাঝে আজ সব ধরনের অশান্তি বিরাজিত। বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি- সর্বত্র আজ ধারাবাহিকভাবে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যার হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেই চলছে। মানুষের মাঝে অস্থিরতা, অস্বস্তি বিরাজ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজদেহে শান্তি-স্বস্তির বড় অভাব এবং ক্রমান্বয়ে তা আরো অশান্তির পানেই ধাবিত হচ্ছে। আমরা এ অবস্থার দ্রুত অবসান চাই। আর সেজন্য প্রয়োজন মানুষের প্রতি মানুষের দরদবোধ ও দায়বদ্ধতা। সেটি তখনই আসে যখন মানুষের ভেতর অপরের প্রতি মায়া-মমত্ব ও ভালোবাসা থাকে, প্রেম থাকে। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে চরম অস্থির ও অশান্ত সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের এই দরদ ও দায়বদ্ধতা, মমত্ববোধ আর ভালোবাসার অনুপম সৌধের ওপর প্রেমের জয়গান গেয়ে যিনি শান্তিপিপাসু মানুষের জন্য এক ব্যতিক্রমী দর্শন প্রবর্তন করেন- তিনি হলেন মানবতাবাদী দার্শনিক, কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক জালালুদ্দিন রুমি। ৮১৫ বছর আগে জন্ম নেয়া অধ্যাত্মবাদের প্রাণপুরুষ রুমি তার কাব্য-সাহিত্য রচনায় এবং প্রেমদর্শন প্রচারে ফারসির পাশাপাশি আরবি, তুর্কি আর গ্রিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। জন্মেছেন আফগানিস্তানের বাল্খে, কীর্তিময়তার স্বাক্ষর রেখেছেন গোটা পারস্যে আর তীর্থস্থানে পরিণত হওয়া তার মাজার রয়েছে তুরস্কের কৌনিয়ায়। তিনটি দেশেই তিনি সমভাবে, সমমর্যাদায় সমাদৃত হয়ে আছেন। এ সৌভাগ্য পৃথিবীতে শুধুই তার। এর বাইরে সমগ্র বিশ্বে তিনি পরিচিত ও নন্দিত। অধ্যাত্মবাদের বিশ্বকোষ মাসনাভি শরিফে তিনি গেয়েছেন ২৬ হাজার দ্বিপদি বেইত; ফারসি ভাষার কুরআনখ্যাত এই মাসনাভি হচ্ছে মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক কাব্যসংকলন। ৪০ হাজার পংক্তিমালার সমারোহে বিন্যস্ত তার দিওয়ানে শাম্সে তাবরিযি; প্রেমগীত হিসেবে বিশ্বসাহিত্যে যার তুলনা এটি নিজেই। এর বাইরে তিনি ৩৫ হাজার পারসিক শ্লোক এবং ২ হাজার রুবাইয়াত রচনা করেছেন। তার সমগ্র রচনার মূল সুর হচ্ছে প্রেম। সৃষ্টিকে ভালোবেসে স্রষ্টার ভালোবাসায় উন্নীত হওয়ার সিঁড়ি হচ্ছে তার এই প্রেম। সেজন্য তাকে বলা হয় ঞযব গবংংবহমবৎ ড়ভ খড়াব অর্থাৎ প্রেমের বার্তাবাহক।
অধ্যাত্মবাদের অমর কবি রুমি আজও সারা বিশ্বে সমাদৃত। ইরান, তুরস্ক আর আফগানই শুধু নয়, কি প্রাচ্য আর কি প্রতীচ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ আর ইউরোপ-আমেরিকা সর্বত্রই রুমির কদর। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায় রুমির কর্ম আজ অনূদিত, বিশ্বের প্রায় ১২টি দেশের জাতীয় কবি রুমির কাব্য দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আর পাকিস্তানের জাতীয় কবি ইকবাল তাদের অন্যতম। গত দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত খোদ আমেরিকায় কবিতার সর্বাধিক বিক্রিত বই রুমির। কোলম্যান বার্কস, আর এ নিকলসন, এনিমেরি শিমেল, এ জে আরবেরি, ই জি ব্রাউন, জুয়েল ওয়াইজলাল, উইলিয়াম ছিতিক্স, জাভিদ মোজাদ্দেদি, ফ্রাঙ্কলিন লুইস, নাদের খালিলি, ফরোজানফার, যাররিনকুব, ইব্রাহিম গামার্দ, সামির আসাফ প্রমুখ বিশ্বখ্যাত কবি ও গবেষক রুমিকে নিয়ে কাব্য-সাহিত্য ও মানবপ্রেমের দ্যুতি ছড়িয়েছেন। রুমির ৮০০তম জন্মজয়ন্তী পালন উপলক্ষে জাতিসংঘের উদ্যোগে ইউনেস্কো কর্তৃক ২০০৭ সালকে ‘দ্য ইয়ার অব রুমি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত রুমির জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মহাসচিব বান কি মুনের বক্তব্যটি ছিল তাৎপর্যমূলক। তিনি বলেছিলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব অন্য যে কোনো কিছুর চাইতে রুমির চিন্তাধারা প্রচারের অধিক মুখাপেক্ষী। কেননা, রুমির কাব্যসম্ভারে শান্তি ও সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংলাপের আবেদন বা বাণী প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। আর এই বাণী হওয়া উচিত বিশ্বসমাজের কর্মতৎপরতা বা আচরণের আদর্শ।’
রুমি তার মানবপ্রেম, সহিষ্ণুতা, সমঝোতা ও দয়ার দর্শনের কারণে ৮০০ বছর পর আজও জীবন্ত রয়েছেন। সাম্প্রতিক যুগে বিভিন্ন জাতি ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব ও অসহিষ্ণুতা সৃষ্টির যেসব ঘটনা ঘটছে সেসবের অবসানে এবং বিশ্বে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় রুমির শিক্ষা অনুযায়ী তার বিশ্বদর্শনকে কাজে লাগাতে হবে। আর সেটি হচ্ছে রুমির প্রেমদর্শন, সর্বজনীন প্রেম, বিশ্বজনীন ভালোবাসা। সেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই মানুষ; বিভাজনের কোনো সুযোগ এখানে নেই। রুমি বলেছেন-
আমি না খ্রিস্টান, ইহুদি- না আমি মুসলিম
আমি না হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি অথবা জেন
আমি সংযুক্ত আমার প্রিয়তমের সঙ্গে
দেখেছি যেথায় দুটি পৃথিবী একটি হিসেবে
যা ইঙ্গিত দেয় এবং জানায়
প্রথম, শেষ, ভেতর আর বাহির-
এই নিঃশ্বাসের আশ্রয়ে আমি কেবলই মানুষ।
মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ বলেছেন- রুমির মসনভিতে অসাম্প্রদায়িক নীতিবোধের পরম শিক্ষা রয়েছে। কি হিন্দু, কি মুসলিম, কি ইহুদি কি খ্রিস্টান- তত্ত্বপিপাসু মাত্রেই এতে গভীর আনন্দলাভ করতে পারেন। আচার, শাস্ত্রাদেশ বা ধর্মের বাহ্য আবরণ নিয়ে এতে কোনো বাগাড়ম্বর নেই। মানবাত্মা ও পরমাত্মার ভেতরকার শাশ্বত ঐক্য ও প্রেমই এই কাব্যের বর্ণনীয়। জালালুদ্দিন রুমি সমস্ত বিশ্বমানবকে একই স্রষ্টার সৃষ্ট বলে জানতেন। তার কবিতায়ও সেই বিশ্বজনীন উদারতার প্রতিচ্ছবি প্রস্ফুট দেখতে পাওয়া যায়। প্রেমের রাজ্যে যে কোনো জাতি, বর্ণ বা দেশভেদ থাকতে পারে না জালালুদ্দিন রুমি তা অতি পরিষ্কাররূপে দেখিয়েছেন।
এখানে উল্লেখ করা যায়, বিশ্বপ্রেমিক রুমির জানাজার সময় মুসলমানদের সঙ্গে বহু খ্রিস্টান, ইহুদি ও অগ্নি উপাসক উপস্থিত ছিলেন। কেননা তারা সবাই তাকে বন্ধু ও আপনজন মনে করতেন। এটিই হচ্ছে রুমির সর্বজনীন প্রেমের নিদর্শন। রুমির সেই সর্বজনীন প্রেমের সাধনা যে রহস্যময়তার ঘোর তৈরি করেছে তার কবিতার সেই ঘোরে ৮০০ বছর পর আজকের আধুনিক মানুষও মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। তাই একটি শান্তিময় সমাজ আর স্বস্তিময় নিরাপদ আবাস গড়তে রুমির প্রাসঙ্গিকতা আজ অনেক বেশি। বিশেষ করে বর্তমানে ধর্মের নামে যে উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদ চলছে, নিরপরাধ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে বেহেশতে যাওয়া এবং সেখানকার হুর পাওয়ার নিষ্ফল বাসনায় একটি বিপথগামী-বিভ্রান্ত গোষ্ঠী যে পৈশাচিকতা চালাচ্ছে- তা থেকে উত্তরণেও আজ রুমির জীবনদর্শনের অনুসরণ প্রয়োজন।
রুমির কাছে জগত শান্তিময়। ভালোবাসা ও ভালোবাসতে শেখা- এরূপ মহৎ চিন্তা প্রেমের রাজ্যে প্রবেশের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলনের সেতুবন্ধন হলো প্রেম। সৃষ্টিকে ভালোবেসে স্রষ্টার ভালোবাসায় উন্নীত হওয়াই রুমির প্রেমদর্শনের মূলকথা। রুমির মতে, পৃথিবীতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাসে সক্ষম। রুমির অন্তর্দৃষ্টি, বচন ও জীবনবোধ মানবহৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়। পৃথিবীতে ক্রমাগত চলতে থাকা সংঘাত-সংঘর্ষ, হিংসা-বিদ্বেষ ও সব ঘৃণাকে চিরতরে নির্বাসন দেয়ার শিক্ষা দেয় রুমির প্রেমদর্শন। রুমির অনুজপ্রতীম প্রেমের আরেক বিখ্যাত কবি হাফিজের প্রেমবিষয়ক কবিতাংশ দিয়ে এখানেই ইতি টানতে চাই। হাফিজ বলেন: আয সেদায়ে সোখানে এশ্ক নাদিদাম খুশতার অর্থাৎ প্রেমের কথার চাইতে, প্রেমের আওয়াজের চাইতে মধুরতর আর কোনো কিছু দেখিনি। সেই প্রেমেরই জয় হোক, জয় হোক মানুষের আর জয় হোক মানবতার।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়