ভূমির কুতুবকে দেয়া হাইকোর্টের জামিন আপিলে বাতিল

আগের সংবাদ

তৃণমূলে সহিংসতা বাড়ছেই : দুই সপ্তাহে অন্তত ২০টি স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে, দলগুলোকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ বিশ্লেষকদের

পরের সংবাদ

কিশোর কবিতায় সংযোজন : নূপুর বাজে দুপুর সাঁঝে

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শিশু-কিশোরদের মনের খবর রাখেন রমজান মাহমুদ। ছোট শিশু বড় হতে চায় তাড়াতাড়ি। তাদের চোখের সামনে বড়রা যা করে তা করতে সচেষ্ট হয় ছোটরা। কাজটি পারার বয়স হোক বা না হোক তা করার জন্য শিশুদের আকুতি লক্ষণীয়। যা প্রকৃতির শিক্ষা, শিশুর আচরণ বা স্বভাব সবকিছু জানার প্রবল আগ্রহ বলেই প্রতীয়মান হয়। রমজান মাহমুদ শিশু-কিশোরদের প্রকৃতিগত স্বভাব বেশকিছু চিত্রকল্প তার ‘নূপুর বাজে দুপুর সাঁঝে’ কিশোরকবিতা গ্রন্থে ধারণ করেছেন।
রমজান মাহমুদ নিজে শিশু হয়ে শিশুর মতোই মায়ের কাছে আবদার করেছেন, মাগো, আমি পুকুর জলে সাঁতরাতে চাই, মেঠোপথে একা হাঁটতে চাই, গাছে চড়তে চাই, মাছের সঙ্গে কানামাছি খেলতে চাই। মায়ের এক কথা- আরো একটু বড় হতে হবে। কিন্তু শিশু রমজান মাহমুদ মায়ের কাছে প্রশ্ন রাখেন- মা, তুমি যে সব সময় আমার সব কাজে বাধা দাও তুমি কি হিসাব করে দেখেছো আমি যে আগের চেয়ে বড় হয়েছি? কাজেই তার ভাবখানা বোঝা যায় আমাকে আর বারণ করো না, আমাকে মুক্ত হওয়ার জন্য ছেড়ে দাও। এই চাওয়া বা আকাক্সক্ষা শিশু রমজান মাহমুদের একার নয়, পৃথিবীর সকল শিশুর আকাক্সক্ষা। এই আকাক্সক্ষা তার গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ছোট আমি বড় আমি’ কবিতায় আছে।
শিশু রমজান মাহমুদ একটু বড় হয়েছেন। কাজেই তার মনের রঙিন পাখা উড়ে বেড়াতে চায়। তখন তার কলম সঙ্গী হয় এবং চাকা হয়ে শিশু রমজান মাহমুদকে নিয়ে যায় অজানার পথে। তার সাথে খেলা করে কলমবন্ধু। কলমবন্ধু আরো অনেক কিছু জানার ও দেখার জন্য অন্য কোথাও নিয়ে যাবে বলে কথা দেয় ‘সঙ্গী’ নামক কবিতায়। শিশুদের নামে চিঠি আসলে ওরা খুশি হয়। কিন্তু বড়দের নামে চিঠি আসে। ওদের নামে আসে না কেন এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় মা-বাবা, ভাইয়া ও দিদিকে। আমাদের শিশু রমজান মাহমুদ একটি চিঠি পেয়েছেন। কে দিয়েছে চিঠি, জানো? রূপ ঝলমল রঙিন খামে, স্বপ্ন এঁকে নরম নরম শব্দ আর মধু মাখা ছন্দে চিঠি দিয়েছে পাখি। তাই তার মনে আনন্দ। চিঠি পেয়ে অন্য শিশুরা যেমন খুশি হয় তেমনি খুশির কথা ‘চিঠি’ শিরোনামের কবিতায় অনুভব করা যায়।
দুপুরবেলা শিশুদের মন ছটফট করে। ইস্কুল থেকে এসে একটু বিশ্রাম। তারপর আর মন টেকে না ঘরে কিন্তু বাইরে প্রচণ্ড রোদ্দুর। রোদের তাপে চোখ রাঙিয়ে আগুন যেন তীর ছুড়ে মারে। রোদ্দুরের তাপে শুকনো মাঠ, মাঠের ফসল, ঘাস সব ঝিম ধরে আছে। উত্তাপে ঘাম ঝরে, মাথা ঘোরে। কাজেই বাইরে যাওয়া যায় না। বৈশাখ মাসের ভরদুপুরে কষ্টের চিত্র এঁকেছেন ‘ভরদুপুরে’ নামক কবিতায়।
‘প্রিয় স্বাধীনতা’ কবিতায় সূর্যের হাসি, পাখিদের ওড়াউড়ি, ভাইবোন মিলে আনন্দ-উল্লাস, পুকুরে মাছের খেলা, ঘাসের বিছানা, কলমের কালি, রং-তুলি, প্রীতি-ভালোবাসা ইত্যাদি বর্ণনায় চিত্রকল্প এঁকেছেন চমৎকারভাবে। শিশুদের মনে এর প্রভাব পড়বে এবং স্বাধীনতার মর্ম বুঝতে পারবে।

শিশু রমজান মাহমুদের ভাবনার শেষ নেই। সেই সাথে মায়ের ভাবনা একাকার হয়ে যায় ‘নেই জানা’ কবিতায়। সব কাজেই মায়ের মানা। বাইরে গেলে দত্যি-দানো হানা দিতে পারে। মেঘ-বৃষ্টি, দমকা হাওয়া ধাওয়া দিতে পারে। অচিনপুরের যন্ত্রদানবের ভয়। কিন্তু শিশুর অস্থির মন এসব বাধা মানে না। শিশু তার স্বভাবগত কারণেই ছটফট করে। দৌড়ে ছুটে যায় খেলার সাথীদের নিয়ে। মুহূর্তেই খেলায় মশগুল হয়ে ভুলে যায় মায়ের বারণ বা নিষেধের কথা। ফলে বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যায়। তখন শিশু রমজান মাহমুদ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠেন। তখন তিনি প্রশ্ন করেন, মাগো আমার এত ভুল কেন হয়ে যায় আমি জানি না। তুমি আমায় বলে দাও। তারপরে রাগ করো। এই প্রশ্ন এবং আবদার সকল শিশুর মনের ভাবনার, মনের প্রশ্ন হয়ে কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে।
‘আহ্বান’ কবিতাটি আরো মজার। শিশু রমজান মাহমুদ যখন একা থাকেন, তখন তার প্রতি চারদিক থেকে ডাক আসে। তাকে ডাকে বাগানের ফুল, পাখি ও চাঁদ। আকাশ ডাকে উঁচুতে যেতে। নদীর তীর, নৌকো ডাকে জলে ঢেউ তুলে নানান ছবি আঁকতে। তাকে ডাকে ঘাস, লতা, বৃষ্টি, মাঠের হইচই। এত ডাকে কি সাড়া দেয়া যায়? কাজেই যে কোনো একটি ডাকে সাড়া দিতে হয় যা নিজেকেই ঠিক করতে হয়।
শিশু-কিশোর মনে যে কত বিচিত্র কল্পনা, অনুভূতি দানা বাঁধতে পারে তা বলে শেষ করা যায় না। ‘হঠাৎ একদিন’ কবিতায় পাঠককে নিয়ে যাবে তার শিশুকালের স্মৃতিতে। যাকে আমরা বলি নস্টালজিয়া। এই কবিতাটির উপস্থাপনার বৈচিত্র লক্ষণীয়। শিশু রমজান মাহমুদের নিজের ছায়া নিয়ে কবিতা। এর শুরু এভাবে-
‘আমি যখন হাঁটতে থাকি/রাস্তা ঘেঁষে ঘেঁষে
আমায় যেন জড়িয়ে ধরে/পেছনে কে এসে।
তারপর-

ভয়ের চোটে দৌড়ে ছুটি/দৌড়ে যেতে হাঁপিয়ে উঠি/তবু দেখি ছোটাছুটি/আমার পেছনেই
দেখতে পেয়ে দ্বিগুণ ভয়ে হারিয়ে ফেলি খেই।’
স্বরবৃত্ত ছন্দে এই কবিতার উপস্থাপনা খুবই আকর্ষণীয়। এর তাল, লয়, ছন্দ-ঝংকারসহ সামগ্রিক বিষয়াদি খুবই চমৎকার। যে কারণে এই কবিতার চমৎকারিত্ব চিহ্নিত করা যায়, এর পর্ব ভাগের হিসাব নিচে দেখানো হলো :
স্বরবৃত্তের মাত্রা ও চাল ৮+৬ প্রথম স্তবক।
দ্বিতীয় স্তবক ৮+৮ প্রথম বাক্য এবং ৮+৫ দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাক্য। এই ধারায় পুরো কবিতাটি ২ পাতায় শেষ হয়েছে। এই কবিতাটির জন্য রমজান মাহমুদকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
শরৎকে নিয়ে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। চমৎকার কবিতাটির শুরু এভাবে-
‘আকাশের কালো ঘোমটা সরিয়ে/
রোদের মায়াবী বিনুনি পরিয়ে/
শুভ্র মেঘের ওড়না জড়িয়ে/
জাগালো কে মুখখানি?
ছন্দমুখর উজল-উছল/সেইতো শরৎরানি।’
এমনিভাবে দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে কবিতার শেষ স্তবকে আছে
‘এত মাতামাতি প্রকৃতির বুকে/
এত উৎসব মেতে ওঠে সুখে/
এত হাসি গান সকলের মুখে/সব কত সুস্বাদু
রূপবদলের পালকিতে আসা/ এমন শরৎ জাদু।’
এখানে লক্ষণীয়, কবিতার উপস্থাপনাটি নতুন আঙ্গিকে, খুবই আকর্ষণীয়।
আলোচ্য গ্রন্থেও শেষে আছে ‘ইচ্ছে’ শিরোনামের কবিতাটি; বড়ই আশা জাগানিয়া এই কবিতা। রমজান মাহমুদ এই কবিতায় নিজেই খোকার ভূমিকায় উপস্থিত। সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। খোকা সূর্যকে বলছে, কালো অন্ধকার সরিয়ে
‘… আমার চোখে আলো মেখে/থেকে থেকে আমায় ডেকে/ যখন তুমি বল :
খোকা তুমি সূর্য হয়ে/আমার মতো জ্বলো।’
খোকা তখন মনে মনে ভাবে :
তোমার ডাকে আপন মনে/ভাবতে থাকি আমি/তোমার মতো হব নাকি/হব আরো দামি।
এমনিভাবে পাহাড়ের চেয়ে বড় হতে চায় খোকা। গাছের চেয়ে বড় দানবীর হতে সংকল্প করে। সবশেষে খোকার মধ্যে দৃঢ়তা লক্ষণীয়। সে পণ করে-
‘পণ করি এই সূর্য পাহাড়/ গাছ হবো না আমি/ হলে সত্যি মানুষ হব/সবার চেয়ে দামি।’
রমজান মাহমুদের এই কবিতাগ্রন্থে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিষয় স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। শিশু বয়সে প্রত্যেক শিশুর কল্পনার জগৎ থাকে। এই জগৎ শিশুদের সম্পূর্ণ নিজের। সেখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। রমজান মাহমুদ একজন শিশুর ভূমিকায় শিশুর কল্পনার জগতে অনায়াসে প্রবেশ করেছেন। শিশুর কল্পনা, ভাবনাকে নিজের মতো করে সহজ ভাষায় উপস্থাপনা করেছেন কবিতাগুলোতে। তিনি কোনো কোনো কবিতায় শিশুর মনে ঘুমিয়ে থাকা সুপ্ত আশাকে জাগিয়ে তুলেছেন।
‘নূপুর বাজে দুপুর সাঁঝে’ কবিতাগ্রন্থে আরো সুন্দর লেখা, সুন্দর কবিতা অন্তর্ভুক্ত আছে। তা হলো ‘সঙ্গী’, ‘ভরদুপুরে’, ‘প্রিয় স্বাধীনতা’, ‘নেই জানা’, ‘আহবান’, ‘কবির চোখে’, ‘মন’, ‘নিজের চোখে দেখা’, ‘মজার ঘরে’ ও ভাষার জাদু।
বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন শিল্পী আজিজুর রহমান। মূল্য ৪২ টাকা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়