ভূমির কুতুবকে দেয়া হাইকোর্টের জামিন আপিলে বাতিল

আগের সংবাদ

তৃণমূলে সহিংসতা বাড়ছেই : দুই সপ্তাহে অন্তত ২০টি স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে, দলগুলোকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ বিশ্লেষকদের

পরের সংবাদ

অন্য অলৌকিক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভাদ্র মাস। ভ্যাপসা গরম। ছয়টা বেজে গেছে। ছোট মেয়েকে নিয়ে টিউশনি থেকে বাড়ি ফিরল আকিলা। ইকবাল বাড়িতে নেই। শাশুড়ি জানালেন ঘরের জিনিসপত্র আনতে বাজারে গেছে। এটা ইকবালের প্রতিদিনের কাজ। আকিলা চোখেমুখে পানি দেবে। বাইরের গরম থেকে এসে পানি না নেয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। সে বাথরুমে গেল। বের হয়ে এসে রান্নাঘরে ঢুকল চা করতে। ইকবাল এসেছে। আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে মিষ্টি একটা গন্ধ পেল আকিলা। গন্ধটা খুব অপরিচিত। জাগতিক গন্ধের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছে না। অনেকটা বেলী ফুলের মতো কড়া। খুব কড়া। ঠিক কোনো ফুলেরও ঘ্রাণ নয়। অপার্থিব ঘ্রাণ, ইকবালের শরীর থেকে তীব্র ছড়াচ্ছে।
আকিলা বলল, আমি চুলায় চা দিয়েছি।
ইকবাল বিরক্ত মুখে বলল, চা বানালে কেন?
বাসি চা ভালো লাগে না।
বলতে বলতে ইকবালের কাঁধে হাত রাখতে চাইল আকিলা, কিন্তু ইকবাল কাঁধ সরিয়ে দিলো। আকিলার একটু অদ্ভুত লাগলো। ভাবলো সে হয়তো কিছু নিয়ে রাগ করেছে। আকিলা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার, তুমি রাগ করছো কেন?
একবার নয় বহুবার জিজ্ঞেস করলেও সে কোনো উত্তর দিলো না, শুধু চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকলো। ক্লান্ত হয়ে শাশুড়ির কাছে গিয়ে ছেলের বিরক্তির কারণ জিজ্ঞেস করল। কিন্তু শাশুড়িও কিছু জানাতে পারলেন না। আকিলা ভাবলো আছিয়ার নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। আছিয়া বড় মেয়ে। তার ঘরে গেল সে। আবার চোখ পড়ল ইকবালের দিকে, রান্নাবান্নার সরঞ্জাম নিয়ে চুপচাপ কাজ করছে আর বারবার ঘড়ি দেখছে, যেন কারোর জন্য অপেক্ষা করছে, ভেতরে একটা অদ্ভুত গতি। ইকবাল নিশ্চয়ই কারোর জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ নিশ্চয়ই আসবে। তার অভ্যাসই এরকম, বাড়িতে হঠাৎ করে অফিসের মেয়েদেরকে ডেকে এনে নিজ হাতে রেঁধে খেতে নিয়ে আসবে। আকিলা আছিয়াকে জিজ্ঞেস করল। আছিয়া নিরপরাধ স্বীকারোক্তি দিয়ে বলল, আমি কিছু করিনি মা।
আকিলা ভাবলো কী ঘটেছে ইকবালের সঙ্গে আলাপের পরই জানা যাবে। এই ভেবে সে সংসারের টুকরো কাজ করতে বসল। একটু পর উঠে আবার গিয়ে দেখল ইকবাল সব খাবার তৈরি করে রেখেছে, আর রান্নাঘরের ব্যবস্থা করছে। আকিলা সুযোগ দেখে কী বলতে যাচ্ছিল, তখন কল বেল বেজে উঠল। আকিলা আতঙ্কে উঠে পরে চোখ ঘড়ির দিকে স্থির করলো। তার কিছুটা অদ্ভুত লাগলো। সে ইকবালকে পাশ কাটিয়ে দরজা খুলতে গেল। অফিসের একটি মেয়ে এসেছে, একা। সঙ্গে কেউ নেই।
রাত দশটা বেজে গেছে। ইকবাল ছাড়া সবাই খেতে বসেছে। আকিলা বুঝতে পারল অফিসের মেয়েটির সঙ্গে নিশ্চয়ই ইকবালের কোনো কিছু ঘটেছে। অবশ্য অফিসের ঝামেলা বেশিদিন থাকে না।
এগারোটা বেজে গেছে। অফিসের মেয়েটি খেয়েই কিছু ফাইল হাতে নিয়ে চলে গেছে। সবাই যার যার ঘরে ঘুমাতে গেছে। আকিলা মোবাইলের চার্জার নিতে বসার ঘরে এলো। দেখে ইকবাল সবার কাপড়ের স্তূপ বানিয়েছে। ময়লা কাপড় ধোবে, এমন প্রস্তুতি নিচ্ছে। আকিলার অদ্ভুত লাগল। ইকবালের এরকম আচরণের মানে কী? ইকবাল সবসময় নিজেকে সংসারের কাজে জড়িয়ে ফেলছে, নিজের ঘরে ঘুমাতেও যায়নি। সন্ধ্যা থেকে দেখছে, শুধু কাজ করে ফিরছে। আকিলা একমুহূর্ত ভাবল ইকবালের সঙ্গে কথা বলবে, দ্বিতীয় মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল অফিসের মেয়েটির ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তবুও সে নিজের অস্বস্তি কাটাতে ইকবালের সঙ্গে কথা বলতে গেল।
আকিলা বলল, তুমি রাতে কাপড় ধোবে কেন? কী আশ্চর্য, বাড়ির সবার কাপড় ধোবে! তোমার সর্দি জ্বর, সমস্যা হবে।
ইকবাল কোনো উত্তর দিলো না। আকিলা বারবার জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। মন খারাপ করে ঘুমাতে গেল সে। ঘুমাতেও পারল না, মনটা ইকবালের ওপর আটকে আছে। হঠাৎ জেগে উঠল। উঠে ঘড়ি দেখল। রাত দুইটা বেজে গেছে। ইকবাল এখনো বিছানায় আসেনি। বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠল। রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ শুনে সেদিকে এগোলো। ইকবাল রান্নাঘরে বাসনপত্র ঘষামাজা করছে, এবার আকিলার রাগ উঠে গেলো।
এই! কী হয়েছে তোমার, এত রাতে কী করছো? দাঁড়াও, তুমি বিশ্বাস করবে না যে আমি এখনই মাকে ডাকব।
আকিলা শাশুড়িকে ডাকতে ফিরল। শাশুড়ি দাঁড়িয়ে ছিলেন, আকিলার চেঁচামেচি শুনে হয়তো তার ঘুম ভেঙে গেছে।
আকিলা মুচকি হেসে বলল, মা, দেখেন না আপনার ছেলে এত রাতে কী করছে।
শাশুড়ি বরফ শীতল গলায় ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ইকবাল? কী ব্যাপার? কিছু ঘটে থাকলে বল।
মায়ের কথা শুনে ইকবাল হালকাভাবে মায়ের দিকে তাকালো।
আকিলা ইকবালের দিকে এগোতে লাগল। শাশুড়ি তার হাত ধরে বললেন, করতে দাও। তার মন চায় যা করুক।
শাশুড়ি আকিলাকে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তার ঘরে যেতে বললেন। আকিলা ঘরে এলো, কিন্তু তার মন স্থির ইকবালের দিকে।
সকাল সাতটা বাজে। একটু আগে আকিলার ঘুম ভেঙে গেছে। রাতে দেরি করে ঘুমানোর কারণে দেরি করে ঘুম থেকে উঠল। সিদ্ধান্ত নিল আজ রান্নাবান্না কিছু করবে না, ইকবালকে বলবে বাড়ির সবাইকে নিয়ে বাইরে খাবে। বাথরুম থেকে এসে ইকবালকে খুঁজতে লাগল। ইকবাল এখনো কাজে মগ্ন। সে প্রতিদিন ঘরে বসে অফিসের ফাইলপত্র নিয়ে কাজ করে, কিন্তু গতকালের চেয়ে বেশি কাজে নিয়োজিত আছে আজ।
সকাল নয়টা। আছিয়া কলেজে চলে গেলো। ছোট মেয়েও স্কুলে। নাস্তা সেরে আকিলা টুকটাক কাজে বসল।
দুপুর হয়ে গেল। আড়াইটা বাজে, খাবার খেয়ে উঠে ইকবালকে দেখতে গেলো। শাশুড়ির ঘরে বসে ইকবাল কিছু লিখছে, এমন সময় কল বেল বেজে উঠল। ইকবাল আতঙ্কে উঠে দাড়িয়ে তাকালো। আছিয়ার কলেজ থেকে আসার সময় হয়ে গেছে, তাহলে ইকবাল এত বিচলিত কেন?
সন্ধ্যা সাতটা। আকিলা রান্নাঘরে গেল সন্ধ্যার চা বানাতে। ইকবাল রান্নাঘরের সব বাক্স পরিষ্কার করে সাজাচ্ছে। ইকবালকে কোনোদিন সংসার কাজে এমন ব্যস্ত হতে দেখেনি। কাল থেকে তার এসব আচরণ অদ্ভুত লাগছে। ইকবাল কি কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে! তাই তো সে আচরণ দিয়ে স্ত্রীর প্রতি বিতৃষ্ণা ছড়াচ্ছে। ঘর আর রান্নাঘর গুছিয়ে নিচ্ছে কোনো নারীর জন্য। আর কল বেল বাজছে বলে বারবার ঘড়ি দেখছে। ধুস, কী সব আজেবাজে ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আকিলার। কেউ একজন তার মাথায় হাত রাখলো। সে ভাবলো ছোট মেয়ে। তাই পেছনে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতেই দেখে শাশুড়ি। শাশুড়ি তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঘর ও ঘরের মানুষের জন্য যে করছে সে তোমার স্বামী।
শাশুড়ি অনেকক্ষণ আকিলার পাশে বসে থাকলেন। আর আকিলা কাঁদতে থাকল। রাত আটটা বেজে গেল। ইকবাল আজ এক মুহূর্তের জন্য বাড়ির বাইরে বের হয়নি। আকিলা একটু সন্তুষ্ট, হয়তো তার আর ইকবালের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। ইকবাল কোনো নারীর দিকে যাবে না, সে সবার কাছ থেকে অনেক দূরে ছুটছে। আকিলা চেষ্টা করছে ইকবালকে হাসি কথার মাধ্যমে খুশি রাখতে। সে নিশ্চিত ইকবাল হেসে হেসে তাকে জড়িয়ে ধরবে।
রাত এগারোটা বাজে। ইকবাল জমি-সংক্রান্ত দলিলপত্র নিয়ে বসেছে। এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। ইকবাল উঠে দাঁড়ালো। আকিলা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। কোনো নারী নিশ্চয়ই এসেছে। কিন্তু নারী নয়, দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশ অফিসার। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি ইকবাল হাসানের বাড়ি?
আকিলা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমার স্বামী। কেন কী হয়েছে?
এতক্ষণে আছিয়া আর শাশুড়িও দরজায় এসে হাজির। পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে আমার ইকবালের?
আছিয়াও ঘাবড়ে গেলো। বললো, হ্যাঁ আমার বাবা। কিন্তু কী হয়েছে স্যার?
পুলিশ অফিসার আকিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি তার নিখোঁজের কোনো রিপোর্ট করেছেন?
না মোটেও না। কোনো রিপোর্ট করা হয়নি। আমি কেন এসব করব, কেন তাও…।
আকিলার কথা মাঝখানে কেটে দিয়ে অফিসার বললেন, এই ছবিটা দেখুন চেনেন কিনা।
ছবিটা দেখেই আকিলার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তার হাত থেকে ছবিটা আছিয়া হাতে নিল। একটা পুরুষের লাশের ছবি। ঠিক যেন অফিসের টাইকোট পরা বাবার মতো।
পুলিশ অফিসার আকিলাকে বললেন, আপনার হাজব্যান্ড ইকবাল হাসান কাল সন্ধ্যায় দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার কাছ থেকে এই পার্স আর এই সবজির ব্যাগটি পাওয়া গেছে। পার্স চেক করার জন্য আমাদের কাছে কোনো পরিচয়পত্র বা মোবাইল ছিল না, এই যুগেও মোবাইল ছাড়া কেউ থাকে নাকি? বাড়ির বাইরে গেছেন, লন্ড্রি বিল দিয়েছেন, লন্ড্রি ম্যান থেকে আপনার বাড়ির ঠিকানা পেয়েছি। আমাদের সঙ্গে আসুন, আমরা লাশ হস্তান্তর করব।
তিনজনই স্তব্ধ হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারল না। আকিলা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ইকবাল সেখানে নেই, কোথাও নেই। শুধু একটি উজ্জ্বল আলো। সঙ্গে সঙ্গেই আকিলা অজ্ঞান।
জ্ঞান ফেরার পর দেখে শাশুড়ি আর দুই মেয়ে তার পাশে বসে আছে। শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে আকিলা জিজ্ঞেস করল, মা! আপনার ছেলে, কাল সন্ধ্যা থেকে আমাদের সঙ্গে আছে…।
আকিলা দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল কোনো বাক্স গোছানো নেই। এঁটো প্লেটগুলো কাল থেকে জড়ো হওয়া। কোথাও পরিচ্ছন্নতা নেই। ওয়ারড্রোব খুলে দেখল কোনো কাপড় ইস্ত্রি করা হয়নি। বাড়ির সবার জামাকাপড়ও একইভাবে বাথরুমে নোংরা পড়ে আছে। আকিলা শাশুড়ির ঘরে গিয়ে সেই ফাইলপত্র, দলিল আর পেপারপ্যাড খুঁজে দেখল, কিন্তু তার পাতাগুলো ফাঁকা, কিছুই লেখা নেই। কলম এমনিই আছে। আকিলা বিশ্বাস করতে পারছে না, ঘরের প্রতিটি কোণে ইকবালকে খুঁজছে… ইকবাল… ইকবাল চিৎকার করছে। শাশুড়ি তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে নিয়ে বললেন, ইকবাল মা চলে গেছে… তোমার ইকবাল চলে গেছে…। সে এখন দুনিয়ার কাজ থেকে মুক্ত। তার সন্তানদের জন্য ঘরের দায়িত্ব পালন করেছে সে। এখন তোমার ইকবাল আল্লাহর কাছে ফিরে গেছে। আর কোনোদিন আসবে না।
বলতে বলতে শাশুড়িও কাঁদতে লাগলেন। শাশুড়ি আরো বললেন, সে তোমার স্বামী, তোমার প্রতি তার মোহ ছাড়তে পারেনি, হয়তো আজরাইলের কাছ থেকে কিছু সময় ধার করেছিল।
মা আপনি কি জানেন যে সে আপনার ছেলে নয়, তার…।
শাশুড়ি কিছু বললেন না। একটু পর শুধু বললেন, তুমি নিশ্চয়ই অন্যরকম কিছু অনুভব করছো, নিশ্চয়ই করছো।
শাশুড়ি চলে যাওয়ার পর আকিলা স্বামীর সঙ্গে কাটানো মোট ত্রিশ ঘণ্টা মনে করল। ইকবালের কথা মনে পড়ল। সারাদিন তার কাজে ব্যস্ত থাকা, নিজেকে ছুঁতে না দেয়া। সারাদিন কাজ নিয়ে খুটখাট করা। চারপাশে বেলী ফুলের গন্ধ, আর হ্যাঁ, আকিলা যখন ইকবালের সঙ্গে রান্নাঘরে গেছে, শাশুড়িও সেখানে ছিল। খাবার, চা নাস্তা, ঘর গোছানো। আকিলা অনুভব করল। মৃত্যু। কলবেল শুনে ইকবাল নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে গেছে, কারণ আজরাইল আসার সময় হয়ে এলো। সমস্ত প্রশ্নের জবাব না পাওয়ায় আকিলার মাথা ব্যথায় ফেটে যেতে লাগল। সে দ্বিতীয় বার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়