আজকের খেলা

আগের সংবাদ

কুশিয়ারা ফেনী গঙ্গায় জোর : ১২ বছর পর কাল থেকে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক > প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে পানি সমঝোতার সম্ভাবনা

পরের সংবাদ

রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট

প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : ইতিহাসের পৈশাচিকতার পুনরাবৃত্তি। ঠিক ২৯ বছর পর রক্তাক্ত আগস্টেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের রক্তের স্রোত মিশে যায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে। টার্গেট এক ও অভিন্ন। ১৫ আগস্টের টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ২১ আগস্টের মূল টার্গেট তারই কন্যা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার গভীর চক্রান্ত বাস্তবায়নে যুদ্ধক্ষেত্রের আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করে ঘাতক-হায়েনারা রাজনৈতিক সমাবেশে। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে ওই হামলা চালিয়েছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার। বিশ্লেষকদের মতে, ভয়াবহ এই গ্রেনেড হামলা দেশের রাজনীতির এক টার্নিং পয়েন্ট। রাষ্ট্রীয় মদতে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন চেষ্টায় তাদের ওপর বীভৎস আক্রমণ দেশের রাজনীতিতে এক সুস্পষ্ট বিভক্তি রেখা টেনে দিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণেই রাষ্ট্র ও সমাজে আজ এক ধরনের বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যার মাসুল দিতে হচ্ছে জাতিকে।
২০১৮ সালের অক্টোবরে গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ১৫ আগস্টের মতই ২১ আগস্টের হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল ঘাতকরা। আর এই ষড়যন্ত্রে তখনকার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত। তদন্তে প্রমাণিত হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ব্যাহত করা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করার অশুভ লক্ষ্য নিয়েই সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে এই দানবীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে ঘাতক চক্র। রায়ের পর্যবেক্ষেণে আরো বলা হয়, রাজনীতি মানেই কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে মতবিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে দলই থাকবে বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদারনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধী দলীয় নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। এই রাজনীতি এ দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে, তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চালানো হবে? রাজনীতিতে এমন ধারা চালু থাকলে মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে।
ফিরে দেখা সেই বিভীষিকাময় দিন : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, সেদিন ছিল শনিবার। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হবে।

তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শেখ হাসিনার বক্তব্য তখন শেষ। ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। হঠাৎ বিকট শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরণ। এরপর খই ফোটার মতো ফুটতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। জনাকীর্ণ সমাবেশে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাককে লক্ষ্য করেই ছোড়া হচ্ছিল গ্রেনেডগুলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরিত হয় ১৩টি গ্রেনেড। পরিস্থিতি বুঝে ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা ঘিরে ফেলেন তাকে। প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করতে মানবঢাল রচনা করেন তারা। ভাগ্যক্রমে ঘাতকের গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা থেকে তিনি বেঁচে গেলেও ভয়াবহ ওই ঘাতক বুলেট কেড়ে নেয় নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ তাজা প্রাণ। আহত হন ৪ শতাধিক নেতাকর্মী। লাশের মিছিলে স্বজনদের আহাজারি আর আহতদের চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে রাজধানীর পরিবেশ।
এদিকে হামলাকারীরা যখন বুঝতে পারে গ্রেনেড জখম করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে, তখন গুলি ছুড়তে শুরু করে। নেতারা ও দেহরক্ষীরা দ্রুত মানবঢাল রচনা করে শেখ হাসিনাকে তার বুলেটপ্রæফ গাড়িতে তুলে দেন। এ সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পর পর ৬টি বুলেট। ভাগ্যক্রমে বুলেট থেকেও রক্ষা পান শেখ হাসিনা। তবে বুলেটবিদ্ধ হন তাকে পেছন থেকে আগলে রাখা তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মাহবুব। গাড়িতেও একাধিক বুলেট আঘাত হানে। গ্রেনেড বা বুলেটের আঘাতে শেখ হাসিনা আহত না হলেও বিকট শব্দে তার কানের শ্রবণযন্ত্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২১ আগস্ট যেভাবে রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট : বিশ্লেষকদের মতে, ১৫ আগস্ট আমাদের রাজনীতিতে একটি গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। তখন বিএনপি ছিল না। কিন্তু বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে ১৫ আগস্টকে ঘিরে। একুশ শতকে এসে যখন বিভিন্ন দেশ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখছে, রূপকল্প তৈরি করছে, তখন এ দেশে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার রাজনীতি আরো বেগবান হয়েছে। একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড ও বোমা হামলার মতো ‘নির্মূলের’ রাজনীতির এই ভয়ংকর রূপ এর আগে খুব কম দেখা গেছে। সহাবস্থান ও সমঝোতার রাজনীতির কফিনে সেদিনই কি শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নও উঠেছে।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান থেকে আর্জেস গ্রেনেড এনে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নের জন্য পরিকল্পিত হামলা চালায় ঘাতকরা। এই হামলার সঙ্গে সরাসরি বিএনপি এবং জিয়াপুত্র তারেক রহমান জড়িত ছিল। যে আর্জেস গ্রেনেড আমাদের সেনাবাহিনীতেই ব্যবহার করা হয় না, সেই আর্জেস গ্রেনেড কোথা থেকে এসেছে, আজ জাতি জানে। তিনি বলেন, ১৫ আগস্টের বর্বরতা ঘটেছিল রাতের অন্ধকারে জনগণের চোখের আড়ালে। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়েছে প্রকাশ্যে। কোনো জনসভায় হামলা চালিয়ে একটি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা চালানোর কোনো নজির স্মরণকালের ইতিহাসে বিরল। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার দায় বিএনপির।
এদিকে পৈশাচিক হামলায় স্প্রিন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন ৪০০ এর বেশি আহত নেতাকর্মী। সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা স্প্রিন্টারের কষ্ট নিয়েই মারা গেছেন জননেতা আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ অনেকেই। গ্রেনেডের বিকট শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত কানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখনো ব্যবহার করতে হয় ‘হিয়ারিং এইড’। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্নের এই রাজনীতিই দেশকে আজ দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ভোরের কাগজকে বলেন, ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায়ই ২১ আগস্ট। শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে পারলেও নিহত হয়েছেন আইভি রহমানসহ ২৪ জন। এই হামলায় আহত হয়ে অনেকেই পরে মারা গেছেন। এখনো স্প্রিন্টার নিয়ে যারা দুঃসহ যন্ত্রণায় বেঁচে আছেন, তাদের অনেকেই বলেন, এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর চেয়ে মৃত্যুই ভালো ছিল। তিনি বলেন, কারা একুশে আগস্ট ঘটিয়েছে? বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে। অবিস্ফোরিত গ্রেনেডসহ আলামত ধ্বংস করে দিয়েছে। শান্তির সম্মেলনে যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্র ব্যবহার করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার একটাই লক্ষ্য ছিল- দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে রাখা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নষ্ট করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা একসূত্রে গাথা। ২১ আগস্টের পুরো রহস্য উন্মোচন করে শ্বেতপত্র প্রকাশ প্রয়োজন বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।
বিশ্লেষকদের মতে, গ্রেনেড হামলা নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির ধারায় পরিণত হয়েছে। শুধু রাজনীতিকরাই নন; শিক্ষক, চিকিৎসক, পেশাজীবীসহ পুরো সমাজ ব্যবস্থায় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতিতে সমঝোতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। কিন্তু এখন আর তা নেই। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আস্থাবোধ নেই। এসব হারিয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, খুনোখুনি, নির্মূলের রাজনীতি আমাদের রাজনীতির একটি নিয়মিত অনুষঙ্গ। প্রতিদ্ব›দ্বীকে নির্মূল করা আমাদের রাজনীতির একটি সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে- যা লিয়াকত আলী খানের সময় থেকে শুরু। রাজনীতিতে বিরোধী দল থাকবে। বিকল্প থাকবে। একটা দল যদি মনে করে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, তাহলে তো রাজনীতি হয় না। কিন্তু ২১ আগস্টের মূল লক্ষ্যই ছিল রাষ্ট্রশক্তিতে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বীকে একেবারেই নির্মূল করে দেয়া। নিজের রাস্তা পরিষ্কার করা। তিনি বলেন, এখন মানুষ রাজনীতিবিমুখ। রাজনৈতিক জনসভায় মানুষ ভাড়া করে আনতে হয়। অন্যদিকে রাজনীতিবিদরা রাজনীতিবিমুখ। তাদের সন্তানদের ক্ষমতার অংশীদার করতে চায়, কিন্তু রাজনীতি করতে দেয় না। শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশের সন্তান এ দেশে নেই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়