সাংবাদিকদের মেরে উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মামলা

আগের সংবাদ

সামাজিক অপরাধ বেড়েছে

পরের সংবাদ

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস : ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও নারীর ভূমিকা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ৯ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। জাতসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ দিন আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করে। প্রতিবছর জাতিসংঘ আদিবাসী দিবসের একটা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। এ বছরের প্রতিপাদ্যকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে যার সরল অর্থ দাঁড়ায়- ‘ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকা।’ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের ঐতিহ্য অনুযায়ী এবং জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, জাতিসংঘ আদিবাসী দিবসের একটি সর্বজনীন শিরোনাম নির্ধারণ করে আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সে শিরোনামের একটা স্থানিক অর্থ নির্ধারণ ও নির্মাণ করে। জাতিসংঘ প্রদত্ত এবং নির্ধারিত প্রতিপাদ্যের মূল বক্তব্যকে অপরিবর্তিত রেখে নিজেদের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজেদের উপস্থাপনের জন্য নিজের মতো করে একটি শিরোনাম নির্ধারণ করে। তাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কেবল একটি উৎসব বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রদর্শনীর দিন নয়; বরং বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের বহুমাত্রিক দাবি-দাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-চাহিদা ও শোষণ-বঞ্চনার ইতিবৃত্ত উপস্থাপনের পাশাপাশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধিকার আদায়ের একটি প্রতিবাদের দিন হিসেবে পালিত হয়।
এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ ২০২২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত একটি নতুন আদিবাসী দশক ঘোষণা করেছে। এ দশককে বলা হবে, ‘আদিবাসী ভাষা দশক’ যার মূল দৃষ্টি থাকবে ‘আদিবাসী ভাষা ব্যবহারকারীদের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ’। ফলে ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস একটি নতুন আদিবাসী দশক ঘোষণারও শুরুর বছর। জাতিসংঘের এ হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রচলিত প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ভাষার মধ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ ভাষা বিলীন হওয়ার মুখে আছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে আছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা। তাই আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আগামী ১০ বছর আদিবাসী ভাষা দশক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আর জাতিসংঘের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী আদিবাসী ভাষাগুলো বিলুপ্তির মুখে, তার প্রধানত কারণ হচ্ছে আদিবাসীদের মানবাধিকারের বিষয়টি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে গুরুত্বহীন হয়ে উঠছে। তাই আদিবাসীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে তাদের ভাষা সংরক্ষণের বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাই এ বছর বিশ্বব্যাপী আদিবাসী দিবসে আদিবাসী ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান সংরক্ষণ এবং সম্প্রসারণে আদিবাসী নারীদের ভূমিকার পাশাপাশি আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণের মাধ্যমে তাদের মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর ৯০টি দেশে প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী মানুষ বাস করে। আর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হচ্ছে পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫ শতাংশ। কিন্তু এ ৫ শতাংশ হচ্ছে বিশ্বের সমগ্র জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পড়াদের মধ্যে অন্যতম। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর সমগ্র দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ শতাংশই হচ্ছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এ আদিবাসী জনগোষ্ঠী পৃথিবীর প্রায় ৭ হাজার ভাষায় কথা বলে এবং প্রায় পাঁচ হাজার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ আদিবাসী। যারা পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের জন্য যোগ্য ও বৈচিত্র্যময় করে রেখেছে, তারাই আজ বিলুপ্তি ও হুমকির মুখে, এটা মানবজাতি এবং বিশ্ব মানব সমাজের জন্য কোনোভাবেই সম্মানের বিষয় নয়। তাই বিশ্বের আদিবাসী মানুষের স্বতন্ত্র জীবনাচার, স্বতন্ত্র ভাষা এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি সংরক্ষণের দায় ও দায়িত্ব বিশ্ব সম্প্রদায়ের, বিশ্বসমাজের এবং বিশ্ব মানবজাতির।
এবার আসা যাক এ বছরের প্রতিপাদ্যের আলোচনায়। বিশ্বব্যাপী আদিবাসী সমাজ এখনো প্রধানত পরিচালিত হয় সনাতন, প্রথাগত, সমাজ-সংস্কৃতি নিবিষ্ট (সোসাইটি-কালচার স্পেসিফিক) এবং ঐতিহ্যগত জ্ঞান দ্বারা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তথাকথিত উন্নয়ন ভাবনা আদিবাসী সমাজের যে স্বাভাবিক জীবনাচার, সমাজ ব্যবস্থা এবং জীবন সংগ্রাম তার সঙ্গে সবসময় মানানসই নয়। এ কারণে পৃথিবীর বিখ্যাত সব নৃবিজ্ঞানী আদিবাসী সমাজের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং এর বহুবিধ আইনি-আমলাতান্ত্রিক জটিল কাঠামো আদিবাসী মানুষের, সামাজিক আচার, রীতিনীতি এবং অর্থনৈতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রায় সময়ই খাপ খায় না। তাই আদিবাসী জনগোষ্ঠী আধুনিক রাষ্ট্রকে এড়িয়ে চলেছে এবং নিজের মতো জীবন-যাপন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের জীবনে খানিকটা জোর করে প্রবেশ করেছে। প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী জেমস স্কট দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার আপল্যান্ডে বসবাসকারী জুমচাষিদের, যাদেরকে তিনি বলেছেন জুমিয়া (মূলত উইলিয়াম ভ্যান শেন্ডেলের শব্দের প্রবক্তা), শত শত বছরের অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে দেখিয়েছেন যে, জুমিয়ারা রাষ্ট্রকে সব সময় এড়িয়ে চলেছে এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। এ রকম কোটি কোটি আদিবাসী রাষ্ট্রব্যবস্থার নানান জটিল সমীকরণের বাইরে একটা নিজস্ব সত্তা নিয়ে এবং নিজস্বতা বজায় রেখে নিজেদের জীবনকে যাপন করার চেষ্টা করেছে। আর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রয়েছে শত শত বছরের নিজস্ব জীবনাচার ও ঐতিহ্যগত জ্ঞান, যা বংশপরম্পরায় ব্যবহৃত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে অনন্তকাল ধরে।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীর অবস্থান সব সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীরাই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনে পরিবার, সংসার, সমাজ, সামাজিক রীতিনীতি, নানান সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং বহুবিধ সামাজিক প্রথা প্রভৃতিকে ধারণ করা, পালন করা এবং সংরক্ষণ করার প্রধান দায়িত্ব পালন করে। আদিবাসী নারীরাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারক ও উৎস। এভাবেই আদিবাসী সমাজের নানান চিকিৎসা পদ্ধতি, কৃষিকাজের নানান পর্ব ও পদ্ধতি, জীবনাচারের নানান ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের উদ্ভাবন, প্রয়োগ এবং সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আদিবাসী নারী। আদিবাসী নারীদের এ ভূমিকাকেই বিবেচনায় নিয়ে এ বছরে জাতিসংঘ প্রতিপাদ্য করেছে ‘ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান সংরক্ষণে এবং বিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকা’। এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। এক. আদিবাসী জনগণের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের গুরুত্ব এবং এর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি, দুই. সমাজে নারীর ভূমিকা ও গুরুত্ব। আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা আছে। শত শত বছর ধরে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই বংশপরম্পরায় যে জ্ঞান কোনো ধরনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছাড়া আদিবাসী সমাজে বিদ্যমান আছে এবং সক্রিয়ভাবে চালু আছে, তাকে বলা হয় আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান। কোনো কোনো সময় এটাকে বলা হয় প্রথাগত জ্ঞান, সনাতন জ্ঞান, লোকজ জ্ঞান কিংবা ইন্ডিজেনাস নলেজ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জ্ঞানকে, যাকে বলা হয় এথনোমেডিসিন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাইয়ো-মেডিসিনের চেয়ে এটা অধিকতর কার্যকর বলে বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী বিতর্ক জারি আছে। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রফেসর ড. উইলিয়াম সাক্স এ বিতর্কে এথনোমেডিসিনকে বাইয়ো-মেডিসিনের চেয়ে এগিয়ে রেখেছেন, যা তিনি তার দীর্ঘদিনের গবেষণার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। আর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এ ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান সংরক্ষণে ও বিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকাকে যথার্থ মূল্যায়ন করার জন্য জাতিসংঘ একটা নিরঙ্কুশ ধন্যবাদের দাবিদার।
পরিশেষে বলব, যা আমি অন্য একটি লেখায় পত্রিকান্তরে লিখেছিলাম, “সত্যিকার অর্থে এ-পৃথিবীকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর এবং মানব-বৈচিত্র্যে মনোরম করে তোলার পেছনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সর্বাধিক অবদান রেখেছে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে একটা বিরাট সংখ্যক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জমি, জল, জঙ্গল, ভিটা, মাটি কেড়ে নেয়া হয়েছে নানামুখী উন্নয়নের ঢেঁকুর তুলে; পর্যটনের নামে আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতিকে বানানো হচ্ছে ‘বিলাসী বিনোদন সামগ্রী’ ও বিক্রয়যোগ্য পণ্য; রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে আদিবাসী মানুষের নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারা হয়ে পড়ছে সংকটাপন্ন। সর্বোপরি বিশ্বায়ন-নগরায়ণ-শিল্পায়ন-আধুনিকায়নের নামে আদিবাসী সংস্কৃতি হয়ে পড়ছে বিপন্ন।” এ রকম একটি বিশ্ব বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয়েছে। পৃথিবীটাকে আরো সুন্দর, বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ করার জন্য আদিবাসীদের প্রতি বিশ্ব মানবতার সদয় ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির উদয় হোক, এটাই কাম্য।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়