সরকারি তিন ব্যাংকে নতুন এমডি

আগের সংবাদ

নিরাপত্তাহীন নির্মাণের খেসারত

পরের সংবাদ

বিএনপির নেতৃত্ব ও আলো আঁধারের গল্প

প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিএনপির নেতৃবৃন্দ প্রায়ই বলে থাকেন যে তাদের দলে নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সংকট নেই। কথাটি অনেক ব্যাখ্যার বিষয় কিন্তু বিএনপি সেই ব্যাখ্যায় যায় না কিংবা স্বীকারও করে না কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপির দলীয় চেয়ারপারসন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এমন কিছু আইনি এবং বিচারিক রায়ে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন, যা তাদেরকে দেশের কোনো আইনেই নির্বাচন করা কিংবা সরকার গঠন করার মতো বৈধতা দেয় না। যেখানে দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতাই বিচারিক রায়ে দণ্ডিত সেখানে দল যদি এই রায় অনুযায়ী নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে পারত তাহলে বিএনপির নেতৃবৃন্দের বক্তব্য একভাবে মেনে নেয়া যেত। কিন্তু বিএনপির নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিকভাবে তেমন কিছু করেননি সেটি তারা করার অবস্থানেও নেই কারণ দলের কোন পর্যায়ের নেতাকর্মী অন্য কাউকে দলের চেয়ারপারসন কিংবা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এ দুপদের কোনো পদেই মেনে নেয়ার অবস্থানে নেই। অন্যদিকে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক রায়ে ১০ বছর দণ্ড ভোগ করছেন। যদিও দলীয় নেতাকর্মীরা মৌখিকভাবে মানছেন না কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে অমান্য করারও কোনো সুযোগ নেই। বলার চেষ্টা করা হয়ে থাকে সরকারের ইচ্ছায় নাকি এমন দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে! কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে এর মাধ্যমে কতখানি অবজ্ঞা করা হয় তা আইন-আদালত যারা বোঝেন তারা ভালো করে বলতে পারেন। বিএনপির বাঘা বাঘা আইনজীবী বেগম জিয়ার মামলার সব স্তরে আইনি লড়াই তথা যুক্তি-তর্ক ও ব্যাখ্যা উপস্থাপনে কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু আইনের বাইরে গিয়ে নিম্ন থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত কেউ দ্বিধা বিভক্ত রায়ও দেননি, সুতরাং বিচারের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা বাইরে করা গেলেও আদালতের ভেতরে তা সম্ভব নয়। সুতরাং এ মামলা নিয়ে যত কথাই বলা হোক, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে কারা ভোগ করছেন বেগম খালেদা জিয়া। তাই তার নেতৃত্ব বিচারিক সংকটে পড়েছে। দেশের আইন ও আদালতকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি কারাগারে যাওয়ার আগ মুহূর্তে দলের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব তার পুত্র তারেক রহমানের হাতে ন্যস্ত করে গেছেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণকারী নিজেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই রাজনীতি না করার শর্তে মুচলেকা দিয়ে সপরিবারে লন্ডন চলে গেছেন। তিনিও বেশকিছু মামলার পলাতক আসামি হিসেবে অভিযুক্ত।
২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ড মামলার তিনিও কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, সুতরাং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব দেশে থাকলে তিনিও পালন করতে পারতেন না। লন্ডনে থাকার সুবাদে তিনি ভার্চুয়ালি পালন করছেন, সে কারণেই বিএনপির নেতৃবৃন্দ সাম্প্রতিক সময়ে দাবি করেন এখনকার এবং ভবিষ্যৎ নেতা হচ্ছেন তারেক রহমান। বিএনপির গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করতে না পারলে বোধহয় তারা এ কথাও বলতে পারতেন না। বিএনপির ৭নং ধারা অনুযায়ী ‘কমিটির সদস্য পদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা ছিল, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যে কোনো পর্যায়ের যে কোনো নির্বাহী কমিটির সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ তারা হলেন (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি, (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।
কিন্তু বিএনপি সম্মেলন ছাড়াই গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে। চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালনের অধিকার প্রদান করে যিনি লন্ডন থেকে দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু তিনি দেশে আসছেন না, তার দেশে আসার আইনগত যথেষ্ট জটিলতা রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলা করে তিনি দেশে কীভাবে আসবেন সেটিও একটি মস্তবড় আইন ও বিচারিক প্রশ্ন। সে আইন ও বিচারিক প্রশ্নের মোকাবিলা করেই তিনি দেশে ফিরতে পারেন, কিন্তু রাজনীতিতে দলকে নেতৃত্ব দেয়ার তার জন্য বিচারিক বিষয়টি প্রথমেই মোকাবিলা করতে হবে। সেটি নিষ্পন্ন না হওয়ার আগে তাকে আইন অনুযায়ী কারাগারেই যেতে হবে। এটি যেহেতু তার জন্য বড় সমস্য, দলের জন্যও মস্ত বড় সমস্যা, এর থেকে তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়াও খুব সহজ বিষয় নয়।
দলের এই সমস্যাটি নতুন নয়। ২০১৭ সালের পর থেকেই বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর আরো প্রকট হয়েছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি তাই নেতৃত্বের বড় ধরনের সংকটে পড়ে। দল তখন ড. কামাল হোসেনকে কেন্দ্র করে একটি ঐক্য জোট গঠন করেছিল। ড. কামাল হোসেন সে ঐক্যকে নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেয়ার চেষ্টা করলেও দল ও জোটের মনোনয়ন নিয়ে লন্ডন, ঢাকা এবং বিভিন্ন দল ও জোটের টানাটানিতে লেজে-গোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়। মনোনয়ন দেয়া না দেয়া, পাওয়া না পাওয়া, বাণিজ্য, জামায়াতকে ধানের শীষ দেয়া, না দেয়া ইত্যাদি নিয়ে যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল তা বিএনপির জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক ঘটনা ছিল না। নানা প্রশ্ন তখন সব মহলে ঘুরে বেড়িয়েছিল যে জোট জিতলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? এ প্রশ্নের উত্তর নানাজন নানাভাবে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোনো উত্তরেই যথাযথ ভিত্তি দাঁড় করনো যায়নি। ড. কামাল হোসেন নিজেও নির্বাচনে প্রার্থী হননি, সুতরাং সে নির্বাচনেই দেখা গেছে বিএনপির নেতৃত্ব সংকট কতটা গভীরে ছিল।
সম্প্রতি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন এক বক্তৃতায় স্বীকার করেছেন যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনকে ইমাম মানার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। বিএনপি দলের অন্য কোনো নেতাকেই সে সময় দলের হাল ধরার মূল নেতা হিসেবে নির্বাচিত করতে পারেনি। সে ঐক্য দলের অন্য কোনো নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে নির্বাচনে বিএনপি লেজে-গোবরে অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। এমনকি দলের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েও শপথ গ্রহণ করবেন কি করবেন না সেই ‘ঠেলা-ঠেলি’তেও তিনি পড়ে গেলেন। লন্ডন থেকেও তিনি যথাযথ নির্দেশ পেয়েছেন বলে জানা যায়নি। অথচ দলের যুগ্ম মহাসচিব হারুণ অর রশিদের নেতৃত্বে ৪-৫ সদস্য শপথ গ্রহণ করলেন এবং সংসদেও যোগদান করলেন। তিনি এবং তারা কার নির্দেশে করলেন? অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম কেন করতে পারলেন না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দলের শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্ব সংকট আছে কি নেই তা কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই।
এ তো গেল ২০১৮ সালের কথা, এখন বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে রাজপথের আন্দোলন করার পরিকল্পনা করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করার কথাও ঘোষণা করছে- তাদের উদ্দেশ্য নির্দলীয় সরকার গঠন করা, বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা, দেশে তাদের ভাষায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করছে। এরই মধ্যে সাত দল নিয়ে একটি জোট তৈরি করা হয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ। অবশ্য ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে বিএনপি জামায়াত-হেফাজতকে নিয়ে একটি গণতন্ত্র মঞ্চ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল। যেটি গণজাগরণ মঞ্চের আক্রমণ করতে গিয়ে উল্টো বাধা খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। গত ৮ আগস্ট গণতন্ত্র মঞ্চে আসীন হলেন আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. রেজা কিবরিয়া, জোনায়েদ সাকীসহ অন্যরা। বিএনপি এটিকে তাদের আন্দোলনের প্রথম সাফল্য হিসেবে দাবি করছে তবে গণতন্ত্র মঞ্চের আসীন হওয়া দলগুলোর তেমন কোনো জনভিত্তি নেই। ইমাম হওয়ার মতো যোগ্য কোনো নেতাও নেই।
বিএনপিতে এখন মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং আমীর খসরু মাহমুদই যুগপৎ আন্দোলনে দল ও জোটের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। বাইরে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে এবার দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী থাকবে না কিন্তু গণমাধ্যমেই কয়েক মাস আগে জামায়াতের শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির এ দুই নেতার মধ্যে একটি সমঝোতা বৈঠক হয়েছে, সে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াত চেহারা দেখাবে না। তবে নিশ্চয়ই আন্দোলনে মৌন সম্মতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকবে না জামায়াত। বিএনপির এ অবস্থানটি কৌশলগত, এ কৌশল মানুষকে বুঝতে না দেয়ার কৌশল; কিন্তু বাস্তবে কী হবে সেটি দেখা যাবে যদি কোনো আন্দোলন মাঠে দাঁড়ায় তখন। উনিশ দলীয় জোটের বেশিরভাগ দলই নীরবতা পালন করছে, সেটিও কৌশলের অংশ হতে পারে। কারণ উনিশ দলের অভ্যন্তরে বেশিরভাগই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। দেশি এবং বিদেশিদের কাছে বিএনপি গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে পুরনো মিত্রদের আড়ালে বা অদৃশ্য রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে। মির্জা ফখরুল এবং আমীর খসরু মাহমুদ দৌড়াচ্ছেন বামপন্থিদের জোটে টানার জন্য কিন্তু সে টানে কতটা লাভ হবে বলা মুশকিল। কারণ বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শগত অবস্থান অন্তত বাম দলের জানা আছে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির মিত্রতা নষ্ট হওয়ার নয়, সুতরাং বিএনপি মঞ্চ ও জোট গড়ার নানা চেষ্টায় আছে শুধু একটা লক্ষ্য নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা। সে আন্দোলন যদি সফল করা যায় তাহলে খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়াকে ইরানের খোমেনির মতো মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে! এটি একটি বড়ই কঠিন চ্যালেঞ্জ বিএনপির সম্মুখে। অন্য কোনো নেতাকে বিএনপি হাল ধরার আসনে বসাতে পারছে না। এ সংকট কীভাবে আগামী দিনের গণতন্ত্র মঞ্চ তৈরি করে আন্দোলনের মাধ্যমে কাটানো যাবে? সেই জটিল পরীক্ষায় বিএনপি এখন বড়ই সংকটের মুখে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়