বুয়েটে ছাত্রলীগের ব্যানারে সভা, বিক্ষোভ শিক্ষার্থীদের

আগের সংবাদ

উত্তরায় গার্ডার চাপায় নিহত ৫

পরের সংবাদ

হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে তিনি অমলিন

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আগস্ট মাসটি বাঙালি জাতির তথা বাংলাদেশের জন্য শোকের মাস। কিন্তু আমার জন্য এটি হৃদয়ে রক্তক্ষরণের মাস; অনুভূতি, উপলব্ধি ও মননশীলতার পরতে পরতে অসহ্য ও তীক্ষè যন্ত্রণা বহন করার মাস। আজকে ৪৭ বছর হলো, মুজিব ভাই আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আমার অনুভূতিতে, বিশ্বাসে এটা আজো পুরোপুরি সত্যরূপে প্রতিভাত হয় না। আমার মননশীলতা, অনুভূতি, হৃদয়ের অনুরণন, কোনো জায়গায় বঙ্গবন্ধু নেই বা তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন- এটা মানতে পারি না। আমার স্বপ্নের মধ্যে তো বটেই, জাগরণেও তাঁর উপস্থিতি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি। এ অনুভূতি কাউকে বোঝানো যাবে না, বোঝানো যায় না। আমার হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে তিনি অমলিন। তাঁর সঙ্গে সমস্ত স্মৃতি আমার হৃদয়ে নিত্য জাগ্রত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ বছরটিকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। শোকাবহ আগস্টে আমার প্রাণের মুজিব ভাইয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। ১৫ আগস্টের সেই নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সব সদস্যের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতায় যাদের অথবা যাদের পূর্বসূরিদের অবদান আছে, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে এই রক্ত¯œাত বাংলার যেসব দামাল ছেলে অভিষিক্ত, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে; ৪৭ থেকে ৭১- এই দীর্ঘ পথপরিক্রমণে একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মাঝে একেক গুচ্ছ তরুণ তাজা তপ্ত প্রাণ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু এসব কিছুরই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রতীক ছিলেন জাতির জনক, আমার প্রাণের মুজিব ভাই।
নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে রাখি, দীর্ঘ কারারুদ্ধ জীবনের মধ্যে ১৭টি মাস প্রত্যহ এত দীর্ঘ সময় ধরে আমি যে তাঁর নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি, বাস্তবে কারাগারের বাইরে অথবা ভেতরে অনুজ তার অগ্রজের, সন্তান তার পিতার এত নিবিড় সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয় না। যেটি আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার হয়েছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ¯œাতকোত্তর ডিগ্রিধারী উদ্ধত-উদ্গত-পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো উদ্ভাসিত যৌবনের অধিকারী।
আমি অনেকবার কারাগারে যাওয়া-আসার কারণে আমাকে অনেকেই বি ক্লাস বলতেন। মামলায় বারবার জেলখানায় যাওয়া-আসা করলে, সে শাস্তি নিয়েই হোক অথবা বিভিন্ন মামলার জামিনযোগ্য আসামি হিসেবেই হোক, জেলখানার পরিভাষায় তাকে বি ক্লাস আসামি বলা হতো। বি ক্লাস হওয়া সত্ত্বেও আমি আগে কখনো নিরাপত্তা বন্দি বা রাজবন্দি ছিলাম না। ৬৬ সালের ৯ জুন আমি ডিপিআরে রাজবন্দি হিসেবে কারাগারে ঢুকি এবং আমাকে কারাগারের পুরনো ২০ সেলে স্থান দেয়া হয়। এর সন্নিকটেই ছিল দেওয়ানি, যেখানে কারাগারে মুজিব ভাইয়ের অবস্থান ছিল। দেওয়ানির পাশেই ছোট্ট একটি রান্নাঘর, যেটি একান্তভাবেই মুজিব ভাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হতো।
সেবার যখন আমাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ‘বারবার ঘু-ঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘু-ঘু তব বধিবে পরাণ’। তিনি দ্রুত এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং নিচু স্বরে বললেন, প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে, পরে সয়ে যাবে। তাঁর সেই সান্তুনার বাণীতে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ বি ক্লাস থেকে নিরাপত্তা বন্দি হয়ে জাতে উঠেছি। আর মুজিব ভাই-ই নন, নিরাপত্তা বন্দিরাই কুলীন ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে কারাগার থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত ১৭টি মাস তাঁর নিবিড় সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
তারপর ১৯৬৯-এর শেষার্ধে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই এবং তাঁরই নির্দেশে একাত্তরে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি, যার প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এ সমস্ত দায়িত্ব পালনের সুবাদে স্বাভাবিকভাবেই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। তাঁর অপার স্নেহে আমি সিক্ত হয়েছি।
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার অজস্র স্মৃতি থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে দুয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি। যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়টি আইয়ুব খান চূড়ান্ত করে ফেললেন এবং মুজিব ভাইকে (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি) আসামি করে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানোরও তাদের দুরভিসন্ধি তখন পাকাপোক্ত হয়ে উঠল। তখন মুজিব ভাইকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করার তাদের সিদ্ধান্তটি সুস্পষ্টভাবে জানাজানি হয়ে গেল। তখনকার এক বিকালে আমরা জেলখানার অভ্যন্তরে দেওয়ানি এবং ২০ সেল মিলে যে চত্বর ছিল তা হাঁটার জন্য তো বটেই এমনিতেও বিস্তীর্ণ। মুজিব ভাই ও আমি পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ মুজিব ভাই আমার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি বিস্ময়াভিভূত নয়নে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আলম কালকে তোর ভাবি দেখা করতে আসলে আমি তাকে আর খাওয়া আনতে নিষেধ করে দেব। আমার খানেওয়ালাই যদি আমার কাছে না থাকে (জেলখানায় আমি এত খেতাম যে আমার সহযোদ্ধা রাজবন্দিরা আমাকে খাদক বলে অভিহিত করত) তাহলে বাহির থেকে এত খাওয়া এনে লাভ কী? শুধু শুধু রেনুর উপরে বাড়তি ঝামেলা চাপানোর তো কোনো মানে হয় না। আমরা তো আগেভাগেই জানতাম, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিই শুধু নয়, তাঁকেও নিঃশেষ করে দেয়ার একটা জঘন্য পাঁয়তারা চলছে। আমিও অবরুদ্ধ। বুকফাটা আর্তনাদ করারও সুযোগ নেই। কিন্তু অনুভূতির রক্তক্ষরণ অনেকটাই বৃদ্ধি পেল। আমার দুটি চোখ কেবল অশ্রæসিক্তই হয়নি, আমি তাঁর হাতটা চেপে ধরা অবস্থাতেই সশব্দে কেঁদে দিয়ে বলেছিলাম, মুজিব ভাই, ওরা সত্যিই কি আপনাকে
মেরে ফেলবে? ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তো আপনি বিশ্বাস করেন না। আপনি বিচ্ছিন্নতাবাদীও নন, তবে আপনার প্রতি কেন তাদের এত আক্রোশ? আইয়ুব জান্তার কেন এত জেদ? আপনি আপসহীন পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যার দাবিতে।
পরে যখন মুজিব ভাইকে দেওয়ানি থেকে সরিয়ে সমস্ত বন্দিকে লকআপের পরে তাঁকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি দেওয়ানির পাশের সেল নতুন ২০-এ ছিলাম। তখন আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকা ডেপুটি জেলারগণ, বিশেষ করে শামসুর রহমান ও তোফাজ্জল হোসেন আমাদের সমবয়সি ও বন্ধুপ্রতিম ছিলেন, তাদেরকে অনুরোধ করায় তারা নিজেদের চাকরির ঝুঁকি নিয়ে আমাকে সুযোগ করে দিতে সেদিন নতুন ২০-এ লকআপ করেননি। ফলে যে রাস্তা দিয়ে মুজিব ভাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই রাস্তার সন্নিকটে একটি কলাপসিবল গেট ধরে আমি অঝোরধারায় কাঁদছিলাম। মুজিব ভাই তার স্বভাবসুলভ পাজামা-পাঞ্জাবি, মুজিব কোট পরা অবস্থায় হাতে পাইপ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে খুবই গম্ভীর মননশীলতা ও মননে ধীর পদক্ষেপে জেল পুলিশদের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিলেন। যদিও অবলীলাক্রমে তিনি পাইপ টানছিলেন, তবুও তাঁর মুখমণ্ডলে একটা চরম দুশ্চিন্তার ছাপ পরিস্ফূট হয়েছিল, যা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। আমি চরম আবেগাপ্লুত হৃদয়ে চিৎকার করে বললাম- মুজিব ভাই, তোমাকে কি ওরা মেরে ফেলবে? আর কখনো কি তোমার দেখা পাব না? আমরা পূর্ব বাংলাকে জীবনের বিনিময়ে মুক্ত করব, ইনশাল্লাহ। তবুও তোমার শেষ নির্দেশনা দিয়ে যাও। মুজিব ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ডান হাতে পাইপ ছিল। বা হাত উঁচিয়ে বললেন- ওরা যদি আমাকে মেরেও ফেলে, তবুও চলমান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেও। পাকিস্তানিদের অপশাসন হতে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতেই হবে। এ দায়িত্ব আমি তোমাদের হাতে রেখে গেলাম। পথবিচ্যুত হয়ো না। ভয়ভীতি নির্যাতন নিগ্রহকে তোমাদের উপেক্ষা করতে হবে। এর বেশি কথা বলার সুযোগ তখন আর ছিল না।
বাকশালের বিরোধিতা করে সংসদ ছেড়ে আসার পর ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আমার যাতায়াত প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফুর রহমান মারা যাওয়ার পর মণি ভাই তার সঙ্গে করে আমাকে ৩২ নম্বরে নিয়ে যান। আত্মীয়স্বজন ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়া বাসার ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। আমি ৩২ নম্বরের বাড়ির ছাদে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে বঙ্গবন্ধু অবস্থান করছিলেন। একটি ইজিচেয়ারে বসা অবস্থায় তিনি আমাকে দেখলেন। তাঁর ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠল, চোখ অশ্রæসজল হলো। তিনি ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। আমি ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। তখন হেলিকপ্টারে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার জন্য আত্মীয়দের ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছিল। মরহুম জিল্লুর রহমান তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে তালিকা প্রস্তুত করতে ব্যস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি টুঙ্গিপাড়ায় যাবি? প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হেলিকপ্টারে স্থান সংকুলানের অভাবের কথা চিন্তা করে আমি মুজিব ভাইকে না করেছিলাম।
১৫ আগস্টের দুয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়। আমি বাকশালে যোগ দিইনি বিধায় আমার সংসদ সদস্য পদ তো এমনিতেই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধু আমাকে পরামর্শ দিলেন, গোপালগঞ্জে তাঁর বাবার নামে স্থাপিত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য। জবাবে আমি বলেছিলাম, আমার মনটা এখন খুব খারাপ। আপনাকে পরে জানাব। এই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা।
মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বের যে আসন, সেটি মানুষের হৃদয়ে তিলতিল করে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। সে আসনটি ছিল মোঘলদের হীরকখচিত ময়ুর সিংহাসনের চাইতেও মূল্যবান, অতুলনীয়। তাইতো প্রশ্ন এসে যায়, ১৫ আগস্টের পর সারা বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত তো হলোই না, বরং নীরব, নিথর, নিস্পৃহ, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল কেন? এই নিস্পৃহতার কী কারণ- তার পূর্ণ বিশ্লেষণের ভার আমি ইতিহাসের কাছেই অর্পণ করতে চাই। তবুও আমার নিজের ধারণা, ঘটনার আকষ্মিকতা এবং নৃশংস নির্মমতায় সমগ্র জাতি হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত- বাকশাল গঠন প্রক্রিয়ার প্রকোপে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। অনেক দল, বিশেষ করে ভ্রান্ত বামের সংমিশ্রণে আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। ভাগের মা গঙ্গা পায় না- এমনই এক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল সে সময়। অন্যদিকে, যাদের ওপর সংগঠনগুলোর দায়িত্ব অর্পিত ছিল তারা সবাই দায়িত্ব পালনে কেবল ব্যর্থই হননি, অনেকটা অস্বীকৃতি জানানোর মতোই ছিল তাদের নিস্পৃহতা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, রক্ষীবাহিনী রাজনৈতিক নির্দেশের অভাবে সেনাবাহিনী হতে পরিত্যক্ত ২৬ জন ধিকৃত মানুষকে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসেনি।
বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারানোর ক্ষতবিক্ষত আমার হৃদয়কে দীপ্তিহীন আগুনের শিখায় দগ্ধিভূত করে যখন একান্তে ভাবি, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের গৃহটি আক্রান্ত হওয়ার পর দুই ঘণ্টার কাছাকাছি সময় তিনি হাতে পেয়েছিলেন। এই সময়ের মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে এবং রক্ষীবাহিনীর যিনি রাজনৈতিক দায়িত্বে ছিলেন- তাদের সবার সঙ্গে টেলিফোনে বারবার পরিস্থিতি জানিয়ে সাহায্যের জন্য, অর্থাৎ ওদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার টেলিফোন করার পরও কারো কাছ থেকে তিনি কোনো সহযোগিতা পাননি শুধুমাত্র কর্নেল জামিল ব্যতিরেকে। আমি প্রত্যয় দৃঢ়চিত্তে মনে করি, সশস্ত্রবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তো বটেই, ন্যূনতমভাবে তাদের দেহরক্ষীদের নিয়ে বের হলেও দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করার পথ খুঁজে পেত না। কিন্তু দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর, মর্মান্তিক শাহাদাতের পূর্বে তিনি বুকভরা বেদনা নিয়ে উপলব্ধি করে গেলেন, তিনি কতটা একা, নিঃস্ব ও রিক্ত!
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে কিন্তু দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ডাকে যারা সাড়া দেননি, নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ ও নিস্তব্ধ থেকেছেন, তাদের শনাক্ত করে আওয়ামী লীগের মতো সংগঠন থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরে থাক, তাদের চিহ্নিত করে প্রতিবাদ ও জবাবদিহিতা পর্যন্ত চাওয়া হয়নি। বারবার সাহায্য চেয়েও নিষ্ফল হয়ে একাকীত্ব ও অসহায়ত্বের বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আজো সেই গøানি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। যারা নিষ্কলুষ চিত্তে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন, তারা আজো কান পাতলে হয়তো ইথারে তাঁর বিদেহী আত্মার এই বেদনার ধ্বনি শুনতে পান।
১৫ আগস্ট কোনো সেনা-অভ্যুত্থান বা কোনো বিদ্রোহ হয়নি। কোনো জনতার বিপ্লবও সংঘটিত হয়নি। অন্যদিকে হত্যাকারীরা সংখ্যায় যে কেবল ২৬ জন ছিল তাই নয়, তাদের প্রায় সবাই সামরিক বাহিনী হতে হয় বহিষ্কৃত, নয় চাকরিচ্যুত।
৭১-এর ২৫ মার্চ সারা বাংলাদেশ যখন পৈশাচিক শক্তি সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলো এবং কারফিউ জারি করে নির্বিচারে গুলি ছুড়ে নিরীহ নিরস্ত্র নিতান্ত সহজ-সরল মাটির মানুষগুলোকে হত্যা করা হলো, তখন হৃদয়ের সমস্ত যন্ত্রণাকে প্রশমিত করে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার সংকল্প ও পূর্ব পরিকল্পনাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রজ্জ্বলিত আকাক্সক্ষাকে নির্দিষ্ট কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করি। কারণ, ২৫ মার্চে আমার একহাতে ছিল বাঁশের বাশরি আর হাতে রণতূর্য। কিন্তু ১৫ আগস্টে হৃদয়ে শুধু রক্তক্ষরণ হয়েছে, কিছুই করতে পারিনি।
১৫ আগস্টের কিছুদিন আগেও আমি যুবলীগের মহাসচিব ছিলাম। সেখান থেকেও আমাকে সুকৌশলে সরিয়ে দিলে (মনি ভাইয়ের বিপক্ষে ছিলেন) আমি শুধু নিষ্ক্রিয় ও নিস্তব্ধই হয়ে যাইনি, হয়তো ওই প্রতাপশালী অংশের কেউ আমাকে রক্ষীবাহিনী অথবা আততায়ী দিয়ে হত্যা করিয়ে তারা নিজেরাই শোকসভা, প্রতিবাদ সভা ও মিছিল করতেন। আমার সুহৃদ, শুভাকাক্সক্ষীদের এমন হুঁশিয়ারির প্রেক্ষিতে আমি আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হই। সব ধরনের সংগঠন থেকেই আমাকে বিযুক্ত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর আমি ওইদিন ভোরে আমার পিতার টেলিফোনের মাধ্যমে জানতে পারি। আমি যে বন্ধুর বাসায় থাকতাম, তার টেলিফোন নম্বর কেবলমাত্র আমার পরিবারের সদস্যদেরই জানা ছিল। খবরটি শুনে পিঞ্জিরাবদ্ধ ব্যাঘ্রের ন্যায় বন্ধুর বাসায় ছটফট করছিলাম। মানসিক অবস্থা এমন ছিল যে, মন চাইছিল চিৎকার করে একাকী রাস্তায় বের হয়ে একাই প্রতিবাদ করতে থাকি। আমার বন্ধু ও তার স্ত্রী আমাকে নিবৃত্ত করার জন্য নানা ধরনের সান্ত¡না ও প্রবোধ বাণী শোনাচ্ছিলেন। তাদের মূল কথা ছিল, ধৈর্য ধর, পরিস্থিতি পর্যালোচনা কর, বিশ্বস্তদের সঙ্গে যোগাযোগ কর। যাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছি, তারাই আমাকে ধৈর্যধারণ ও শান্ত থাকতে বলেছেন। অকস্মাৎ এমন কিছু যেন না করি যেটি আত্মঘাতী ও অনর্থক বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে আমাকে ঠেলে দেবে। জীবনে আমি আর কখনো এতটা অসহায়বোধ করিনি।
স্বাধীনতার পূর্বকাল হতেই ভ্রান্তবামেরা বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে আসছিল। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তাদের সেই চেষ্টা সফল হয় এবং যত কষ্টদায়কই হোক এটা নির্মম বাস্তব, বাকশাল গঠন ১৫ আগস্টের পটভূমিকা রচনায় অনেকটাই প্রণোদনা প্রদান করে। নেতা অবশ্য আমাকে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমি আমার মানুষকে বলেছিলাম, সাড়ে তিন বছর কিছুই দিতে পারব না। তারা তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে। এখন আমি কী করে তাদের শান্ত রাখব? তাই এখন একটা রেজিমেন্টেশনের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান একটা উন্নয়ন আনতে চাই। তারপর আবার বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসব, ইনশাল্লাহ। কিন্তু ১৫ আগস্ট তাঁর সেই ওয়াদা পূরণ করার সুযোগ দেয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়