বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টের যাত্রা শুরু

আগের সংবাদ

সিন্ডিকেটে চড়ছে চালের বাজার : প্রতি কেজিতে পরিবহন খরচ বেড়েছে ৫৮ পয়সা, বিপরীতে দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা

পরের সংবাদ

শ্রমিক ধর্মঘটে ‘অচল’ চা শিল্প

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১৩, ২০২২ , ১২:২৬ পূর্বাহ্ণ

** অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি আজ থেকে ** চিঠিতে মহাপরিচালকের কড়া বার্তা, অনড় শ্রমিকরা **

 

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও বিকুল চক্রবর্তী : শ্রীমঙ্গলের সোনাছড়া চা বাগানের শ্রমিক পার্বতী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, আমাদের মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। অথচ বাজারে গিয়ে এক লিটার তেল কিনতে লাগে ২২০ টাকা। চালের কেজি ৫০-৬০ টাকা। আটা ৫০ টাকা। বাগান থেকে তো আটা দেয়া হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাত্র তিন কেজি আটা দিয়ে কী হয়? তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকা পার্বতী জানালেন, ১২০ টাকায় আমরা আর খেয়েপড়ে চলতে পারছি না। একটা কাপড় কিনতে পারছি না। ইউনিয়ন বানাইলাম। সেখান থেকেও কিছু পাই না। এজন্য আমরা ধর্মঘট করছি। সরকার জানুক আমাদের অভাবের কথা। ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চার দিন ধরে চা বাগানগুলো কয়েক ঘণ্টা করে ধর্মঘট চলছে। আজ থেকে পূর্ণদিবস ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিকরা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দি জানান, মজুরি বাড়ানোর দাবিতে চারদিন ধরে শ্রমিকদের ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে। এরই মধ্যে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক চিঠি দিয়ে বলেছেন, ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ধর্মঘট না করতে। আমরা সেটি মানিনি। কোনো সুরাহা না হওয়ায় আজ শনিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের পূর্ণদিবস ধর্মঘট চলবে। এতে বাগানগুলোয় চা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।
শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক (ট্রেড ইউনিয়ন) মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, চা শ্রমিক ইউনিয়নকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, দেশের স্বার্থে চা উৎপাদন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য চা শ্রমিকদের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে। আইন অনুযায়ী শ্রমিকরা এভাবে ধর্মঘটে যেতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করলেও তাদের দাবি মেটানো হচ্ছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রমিকরা এখন মালিকদের সঙ্গে বসবে। সেখানে বিষয়টি মিটমাট না হলে সরকারের পক্ষে শ্রম অধিদপ্তর সালিশকারীর ভূমিকায় যাবে। কিন্তু তা না করে আন্দোলনে গেলে শ্রম আইন লঙ্ঘন হবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত শ্রম অধিদপ্তরের উপপরিচালকের অফিসে মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের কথা থাকলেও মালিকপক্ষ না আসায় সেই বৈঠক হয়নি।
জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত শ্রম অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আগামী ২৮ আগস্ট শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী শ্রীমঙ্গলে এসে চা শ্রমিক ও মালিকদের সঙ্গে বসতে চেয়েছেন। তিনি না আসা পর্যন্ত চা শ্রমিকরা যাতে ধর্মঘটে না যান, সেই আহ্বানও জানান তিনি। কিন্তু চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা সেই কথা না মেনে বলেছেন, সাধারণ শ্রমিকরা এই আন্দোলন করছেন। কাজেই তাদের পক্ষে এখন আন্দোলন স্থগিত করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় শ্রম অধিদপ্তর শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ করে চা শ্রমিকদের আন্দোলনকে থামাতে চাইছে এবং এ সংক্রান্ত একটি চিঠিও এসেছে বলে স্বীকার করেছেন উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম।
ভোরের কাগজের হাতে আসা গতকাল শুক্রবার শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ চা সংসদের মধ্যে চলমান দ্বিপক্ষীয় দরকষাকষি আলোচনা (মজুরিসহ দাবিনামা) নিষ্পত্তির দাবিতে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য শ্রমিকরা গত ৯ আগস্ট থেকে চা বাগানগুলোতে দিনের কাজের শুরুতে দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করে যাচ্ছে। ফলে চায়ের ভরা মৌসুমে উৎপাদন ও চা শিল্পে শান্তিশৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এরপরের লাইনেই চা শ্রমিকদের হুমকি দিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলমান রেখে এ ধরনের কর্মবিরতি ‘শ্রম আইনের পরিপন্থি’। এ রকম পরিস্থিতিতে চা শিল্পে উৎপাদন ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা জরুরি। শ্রমিকদের এ ধরনের আইনবহির্ভূত কর্মবিরতি প্রত্যাহার ও আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করে চা শিল্পে স্বাভাবিক উৎপাদন বজায় রাখার কথা বলা হয় ওই চিঠিতে।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দি বলেছেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরে শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে চা শ্রমিক ইউনিয়ন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রস্তাবনা দিয়েছিল। কিন্তু গত ১৮ মাসেও সেই প্রস্তাবের কোনো কূলকিনারা না হওয়ায় শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছেন। চা শ্রমিক ইউনিয়নের মতে, শ্রমিকরা চাইছেন তাদের জন্য মানসম্মত মজুরি কাঠামো করতে। কিন্তু মালিকরা বলে দিয়েছেন, বর্তমান মজুরি ১২০ টাকার সঙ্গে ১৪ টাকা যোগ করে ১৩৪ টাকার বেশি দিতে পারবেন না। কিন্তু এই টাকায়ও শ্রমিকরা কোনোভাবেই খেয়েপড়ে বাঁচতে পারবেন না। শ্রমিকরা বলছেন তারা ক্ষুধার্ত। ভরা ‘পেটে’র জন্য তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনজর চেয়েছেন।
শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও চা বাগানে গতকাল শুক্রবার চা শ্রমিকদের এক সমাবেশে শ্রীমঙ্গলের উপজেলা চেয়ারম্যান ভানু লাল রায় বলেন, চালের দাম বাড়ছে, তেলের দাম বাড়ছে, লবণের দাম বাড়ছে। গাড়ি ভাড়া বাড়ছে। সব কিছু বাড়ছে। সঙ্গত কারণেই ১২০ টাকা মজুরি নিয়ে কোনো মানুষ তার পরিবার চালাতে পারবে না। মজুরি বাড়ানোর দাবিকে যৌক্তিক দাবি করে তিনি বলেন, এখন আর মালিকদের সুযোগ দেয়া চলবে না। তাদেরকে মজুরি বাড়াতেই হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, টানা পাঁচ দিন ধরে পঞ্চগড় বাদে দেশের ৫ জেলায় ২৪১টি চা বাগানে শ্রমিক ধর্মঘট চললেও সমাধানের কোনো আলামত নেই। আন্দোলন চলাকালে শ্রমিকরা যেমন মজুরি পাবেন না; তেমনি মালিকপক্ষও পড়বে লোকসানে। আর পাতা বড় হয়ে গুণগত মান হারাবে চা। দ্রুত পরিস্থিতির সমাধান না করলে চা শিল্প তছনছ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ চা সংসদের আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, পানীয় জলের ব্যবস্থা ও বোনাসসহ ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করবে বাগান মালিক। এর জন্য দুই বছর পর পর বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশীয় চা সংসদের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক হবে এবং সেই বৈঠকে ঐকমত্যের পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। যার ফলে পরবর্তী দুই বছর শ্রমিকরা বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবেন। সর্বশেষ দ্বিবার্ষিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এরপর বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশীয় চা সংসদের কাছে ২০ দফা দাবিনামা দিয়ে তাদের চাহিদা জমা দেয়। দফায় দফায় এ পর্যন্ত ১৩টি বৈঠকও হয় দুই পক্ষের মধ্যে। চা শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরা জানান, আরো চার মাস গেলে দ্বিবার্ষিক চুক্তি দুটির মেয়াদ অতিক্রম করবে। অর্থাৎ দুই দফা বেতন বাড়ত। সে হিসেবে তারা ৩০০ টাকা মজুরি চেয়েছেন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা পরাগ বারই বলেন, বাগান মালিকরা শ্রমিকদের ঘামের মজুরি দেবে। এখানে আন্দোলন করতে হবে কেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, আমাদের চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী দুই বছর পর পর মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও মালিকরা চুক্তির আইন ভঙ্গ করছেন। তিনি বলেন, দাবি না মানা হলে দেশের সব বাগান একসঙ্গে বন্ধ করে দেয়া হবে।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী জানান, সমঝোতা চুক্তির মধ্যে কর্মবিরতি ও আন্দোলনে যাওয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক। তিনি বলেন, ১০ বছর ধরে চা পাতার দাম বাড়েনি। কিন্তু ১০ বছরে চা শ্রমিকদের বেতন কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। তার মতে, ২ টাকা কেজি দরে শ্রমিকদের সপ্তাহে একবার আটা দেয়া হয়। শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা সব কিছুই আমরা দিচ্ছি। এই হিসাব করলে তাদের দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩০০ টাকা। এ ব্যাপারে তরুণ চা শ্রমিক নেতা দুলাল হাজরা বলেন, এ হিসাব করলে একজন শ্রমিকের বর্তমান মজুরি ৬০০ টাকা। যা চা বাগানের বাইরে চালু আছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়