বাড়িসহ বিপুল সম্পদ : অনুসন্ধান চেয়ে ওসি মনিরুলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট

আগের সংবাদ

শ্রমিক ধর্মঘটে ‘অচল’ চা শিল্প

পরের সংবাদ

ফের বিপাকে মমতা, পার্থর পর গ্রেপ্তার হলেন অনুব্রত : ৮ আইপিএস ও ৫ আইএএসকে দিল্লিতে তলব

প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সত্যজিৎ চক্রবর্তী, কলকাতা থেকে : ফের মুখ পুড়ল পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের। বিপাকে পড়া তৃণমূলের জন্য পরিস্থিতি আরো জটিল হলো গতকাল বৃহস্পতিবার। বারবার ডেকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ি গিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই গরু পাচার মামলায় গ্রেপ্তার করল বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে। এদিন সকালেই সিবিআইয়ের বিশাল বাহিনী অনুব্রত মণ্ডলের বোলপুরের নীচুপট্টির বাড়িতে হানা দেয়। বাড়ির ভেতরে গিয়ে তাকে পরোয়ানায় সই করিয়ে গ্রেপ্তার করে বলেই খবর। এ সময় বাড়ির সামনে প্রচুর মানুষের জমায়েত হয়। বিকালে অনুব্রত মণ্ডলকে আসানসোল আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাকে ১৪ দিনের হেফাজতে চায় সিবিআই। ২০ আগস্ট পর্যন্ত হেফাজত মঞ্জুর করেন আদালত।
গরু পাচার মামলায় তদন্তে অসহযোগিতার কারণেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে অনুব্রত মণ্ডলকে। এদিন অনুব্রতর বাড়িতে ঢোকার ৪৫ মিনিট কেটে গেলেও তার নাগাল পাননি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। প্রথমে অনুব্রতর ঘরে ঢুকতে বাধা দেয়া হয় বলেও অভিযোগ ওঠে। উল্লেখ্য, অনুব্রতর আস্তানায় বুধবার রাত ১১টা নাগাদ হানা দেয় সিবিআইয়ের বিশাল বাহিনী। এরপর বৃহস্পতিবার সকাল

থেকেই বোলপুরের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযানে বেরোন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এদিন সকালে প্রথমে রতনকুঠি গেস্ট হাউসে তল্লাশি অভিযান চালান তারা। অনুব্রত মণ্ডলের বাড়িতে যারা ছিলেন, তাদের প্রত্যেকের ফোনই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলেই জানা গিয়েছে। অনুব্রতকে তার বাড়িতেই জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি চলতে থাকে তল্লাশি। সিবিআই সূত্রের দাবি, গরু পাচার মামলায় অনুব্রত মণ্ডলের যোগ পাওয়া গেছে তদন্তে। এরপর তাকে ১০ বার সাক্ষী হিসেবে নোটিস দেয়া হয়েছিল। তারই দেহরক্ষী সায়গল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই অনুব্রত মণ্ডলের নাম উঠে আসে। এদিকে সিবিআই তাকে তলব করলেও, বারবার আইনজীবী মারফত অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়িয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু সিবিআইয়ের দশম নোটিস পাওয়ার পর থেকেই কার্যত মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অনুব্রত মণ্ডল। তাছাড়া এবার আরএসএসকেএমের চিকিৎসকদের পক্ষ থেকেও রেহাই মেলেনি। সোমবার সিবিআই হাজিরা এড়িয়ে এসএসকেএম-এ গেলেও, হাসপাতাল থেকে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তার শারীরিক নানা সমস্যা থাকলেও, ভর্তির প্রয়োজন নেই। এরপর মঙ্গলবার বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে এক চিকিৎসক তাকে বাড়িতেই দেখতে আসেন। যা নিয়ে বিতর্ক ছড়ায়। তাকে সাদা কাগজে বেড রেস্টের প্রেসক্রিপশন লিখে দেয়ার জন্য হাসপাতালের সুপার ও অনুব্রত মণ্ডল নির্দেশ দেন বলে সাফ জানান ওই চিকিৎসক। সেই অডিও ক্লিপ ভাইরাল হতেই বিতর্কের শুরু। ওই অডিও ক্লিপ প্রকাশ্যে আসতেই জলঘোলা হতে শুরু করে। এরপরই বৃহস্পতিবার সকালে সোজা বাড়িতে গিয়ে অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করল সিবিআই।
অনুব্রতর গ্রেপ্তারির পরই ১৬ আমলাকে সমন পাঠোনার ঘটনায় নতুন করে জল্পনা বেড়েছে। ১৬ জনের মধ্যে ১১ জনই আইপিএস। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বিপি গোপালিকাসহ ৫ জন আইএস। সেই তালিকায় রয়েছেন মমতা ঘনিষ্ঠ একাধিক আইপিএস অফিসার। আগস্টের মধ্যে তাদের হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। কয়লা ও গরু পাচারকাণ্ডে আমলা ও পুলিশ কর্মকতারা জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ।
সংশ্লিষ্টদের মধ্যে গত একমাসের মধ্যে শাসক দলের দু’জন প্রথম সারির নেতা গ্রেপ্তার হলেন। অনুব্রত তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি তৃণমূলের জাতীয় কর্ম সমিতিতেও রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পর অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেপ্তার বেশ বিপাকে ফেলেছে তৃণমূলকে। তবে এখনই এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত বা অবস্থান জানাতে চায়নি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তদন্ত চলুক আইন মেনেই। সঠিক সময়ে দল সিদ্ধান্ত নেবেন। অনুব্রত প্রসঙ্গে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেন বলেন, তৃণমূল কোনোরকম দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না। কিছুদিন আগেই নজিরবিহীনভাবে এক অভিযুক্ত নেতাকে দল ও মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করেছে তৃণমূল। যেটা অন্য কোনো রাজ্যে হয় না, সেটা এই রাজ্যে হয়েছে। শান্তনুর বক্তব্য, আইন আইনের মতোই চলুক। সঠিক সময়েই দল সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সিবিআইয়ের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, ওদের তদন্তের গতি অত্যন্ত ধীর। তদন্ত শুরু হলে ১০-১২ বছরের আগে শেষই হয় না। আমরা চাই এই মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ হোক। এরপরই সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে শান্তনু বলেন, সিবিআইয়ের এফআইআরে নাম থাকা শুভেন্দু অধিকারী এখনো পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে ঘুরে বেড়ান। বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পরিষ্কারই বলেন, যারা অন্যায় করবেন, তারাই শাস্তি পাবেন। তৃণমূলে দুর্নীতিকে কোনো দিনই প্রশ্রয় দেয়া হবে না। বিরোধীরাও একাধিক তোপ দেগেছেন তৃণমূলকে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, বন্যেরা বনে সুন্দর। আর চোরেরা জেলে। তৃণমূলের গোটা দলটাই চোর। এটা একটা চেইন বিজনেস। এই শৃঙ্খলের ওপরই গোটা দলটা চলে। বিজেপির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, বাংলার রাজনীতির স্বার্থে এই ধরনের নেতাদের শাস্তি পাওয়া খুব দরকার। তার যে দাম্ভিকতা, যে কথাবার্তা, তাতে শাস্তি একদিন পেতেই হতো। এবার তৃণমূলের খেলা শেষ হয়ে এসেছে।
কে এই অনুব্রত : অনুব্রতর বাবা কৃপাসিন্ধু মণ্ডলের ছিল মুদিখানার দোকান। সেই সঙ্গে একটা গ্রিলের কারখানা ছিল বলেও শোনা যায়। অনুব্রত এখন থাকেন বোলপুরের নীচুপট্টি এলাকার পনেরো নম্বর ওয়ার্ডে। তবে তাদের গ্রামের বাড়ি ছিল বোলপুর থেকে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে নানুর থানার হাটসেরান্দি গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় কোনো আগ্রহ ছিল না। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে আর স্কুলে ধারে কাছে যাননি। বাবার মুদিখানা দোকানে বসে পড়েন। সেই সঙ্গে গ্রিলের কারখানার কাজকর্মও দেখতেন। অনেকে বলেন, অনুব্রত এরপর কিছুদিন মাছের ব্যবসাও করেছেন। তবে অনুব্রতর ঘনিষ্ঠদের অনেকের দাবি, সে কথার ভিত্তি নেই। আবার নিন্দুকেরা বলেন, অনুব্রতর রাজনৈতিক পদ ও মর্যাদার সঙ্গে মাছের ব্যবসার ব্যাপারটা ঠিক যায় না বলে হয়তো সেটা এড়িয়ে যান। কিশোর বয়স থেকেই অনুব্রতর কংগ্রেসি রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সে সময়ে বীরভূমের গ্রামেগঞ্জে এক শ্রেণির সিপিএম নেতার উৎপাত ক্রমশই বাড়ছিল। সে সব মোকাবিলার ব্যাপারে অনুব্রত বরাবরই ছিলেন বেপরোয়া। তবে কংগ্রেস রাজনীতিতে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি অনুব্রত। তখন বাংলায় যুব কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন প্রদ্যুৎ গুহ। অনুব্রত প্রদ্যুতের অনুগামী ছিলেন বলেই জানা যায়। এমনকি সেই সময়ে রাজীব গান্ধীর বাংলা সফরের এক ছবিও অনুব্রত তার অ্যালবামে গুছিয়ে রেখেছেন। তাতে অনুব্রতকেও দেখা যাচ্ছে। অনুব্রতর বয়স যখন ৩০ বছর, তখন পাড়ারই মেয়ে ‘ছবি’র সঙ্গে প্রেম হয়। সেই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। অনুব্রতর শ্বশুরমশাইয়ের ছিল ট্যুর-ট্রাভেলের ব্যবসা। সেই সঙ্গে বোলপুর বাজারে তাদের একটি জুতোর দোকান ছিল। অনুব্রতর বিয়ে অবশ্য বিশেষ ঢাকঢোল পিটিয়ে হয়নি। রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়েছিল। অনুব্রত-ছবির সেই বিয়েতে সাক্ষী ছিলেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতা চিত্তরঞ্জন রক্ষিত, বীরভূম জেলা পরিষদের এখনকার সভাপতি তথা সিউড়ির বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী। এরপর ৯১ সালে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন ছবি। অনুব্রতর ওই একটিই সন্তান। অনুব্রতর নাম রাজ্য স্তরে উঠে আসে ২০০০ সালে। নানুরে গণহত্যার পর স্থানীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অনুব্রতই। তখন থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে পড়ে যান তিনি। কারণ ছিল একটাই। সিপিএমের বিরুদ্ধে অনুব্রত ছিলেন আপসহীন এবং সাহসী। সেই থেকেই তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্রমশ উত্থান তার।
স্থানীয়রা বলেন, এরপর বাড়বাড়ন্ত আরো শুরু হয় এগারো সালে তৃণমূল বাংলায় ক্ষমতায় আসার পর। বিশেষ করে ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে অনুব্রতর সেই পুলিশের গাড়িতে বোম মারার ভাষণ হইহই করে ভাইরাল হয়েছিল। তারপর হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় নাম জড়ায় তার। গোষ্ঠী কোন্দলে বিদীর্ণ বীরভূম তৃণমূলকে একা ঠাণ্ডা করেছিলেন অনুব্রত। অনেকে বলেন, দিদির অপত্য স্নেহই ছিল অনুব্রতর উত্থানের ভিত্তি। পুলিশকে বোমা মারার কথা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে যখন তীব্র সমালোচনার ঝড় বইছে, সেই সময়ে মমতা অনুব্রতকে পাশে বসিয়ে বলেছিলেন, ওর মাথায় অক্সিজেন কম যায়! শুধু সংগঠনে থেকে অনুব্রত যে দাপট নিয়ে বীরভূম নিয়ন্ত্রণ করেছেন গত এগারো বছর তা বাংলার রাজনীতিতে কিংবদন্তি হয়ে থাকবে। গতকাল অনুব্রত গ্রেপ্তারের পর প্রবীণ কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান বলেন, কথায় বলে পাপ ছাড়ে না বাপকেও। এই জন্মের পাপ এই জন্মেই শোধ করে যেতে হবে। সেই পাপের শাস্তি এবার শুরু হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়