বাড়িসহ বিপুল সম্পদ : অনুসন্ধান চেয়ে ওসি মনিরুলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট

আগের সংবাদ

শ্রমিক ধর্মঘটে ‘অচল’ চা শিল্প

পরের সংবাদ

নাবিক

প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অপেক্ষায় ছিলাম আজো, এই বিকেলের শেষ সূর্যাস্তের। চার্চের বাইরে তখন অদূরে মাঠে খেলতে থাকা বাচ্চাদের কোলাহলও মানিয়ে গেছে এই বিকালের সঙ্গে। প্রতিদিনের মতো আজো মিস্টার এন্ড মিসেস ডি সুজা হেঁটে বেড়াচ্ছেন। মিস্টার ডি সুজা বয়স আশি ছুঁতে না ছুঁতেই চোখের দৃষ্টি হারান। আর তার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে পথ দেখানো মিসেস ডি সুজার বিরক্তিপ্রকাশ এবং সাংসারিক জীবনের চিরাচরিত বকা দেয়াটা যেন এ বিকালেরই অংশ। তার কিছু কিছু বকবকও আমার মুখস্থ। এই যেমন ধরুন,
‘জ্বলে পুড়ে মরলাম তোমার সংসারে এসে। চশমাটাও আনোনি? সব তো আমাকেই মনে করিয়ে দিতে হয়। হায় যিশু! এত দুঃখ ছিল আমার কপালে?’
পঁচাত্তর বছর বয়সি এই বৃদ্ধার একান্ন বছরের সাংসারিক জীবনে তিনি প্রায় প্রতিদিনই জ্বলেপুড়ে মরছেন এক অর্থে। কিন্তু দিন শেষে এটুকু বোঝাই যায় যে এভাবে রোজ একজন বৃদ্ধের পাশে থেকে জ্বলেপুড়ে না মরলে জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে। আমার সঙ্গে তাদের পরিচয়টাও হুট করেই হয়েছিল, ঠিক আজকের মতো এমন একটি বিকালে। অবুঝ সব প্রার্থনায় দুহাত জুড়ে দাঁড়িয়েছিলাম মোমের আলোয়। এক জোড়া হাত সেদিন পরম আদরে আমার বাহু ধরে আমাকে বসিয়েছিল মাঠের কোনার দিকের এই বেঞ্চিটায়। তারা সেদিন জানতে চায়নি আমার কান্নার কারণ। শুধু এতটুকু মনে পড়ে, প্রবল শীতের ওই বিকালে একটু ওম দেয়ার বৃথা চেষ্টা করেছিলেন আমাকে এই বৃদ্ধা, চাদরের একটি অংশে আমাকে জড়িয়ে। সেদিন নীরবে দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধা মাঝখানে বসে ছিলাম। ক্রমে চার্চে আসা বাড়তে থাকলো আমার, কোন এক অজানা টানে। ভার্সিটি, বন্ধুবান্ধব সব কিছুর বাইরে আলাদা এক জগত তৈরি হলো আমার। নিস্তরঙ্গ এক জগত, অদ্ভুত সুন্দর। কিন্তু আমি ভাবিনি কোনোদিনও, সেই নিস্তরঙ্গ জগতে কেউ আসবে এক সমুদ্র পৃথিবী নিয়ে। একজন পথভোলা নাবিক। এলোমেলো চুলের সেই নাবিককে গাছের নিচে বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম। মোমের সবটুকু আলো থাকা সত্ত্বেও সেদিন পুরো গির্জাটা ¤øান ছিল, আলোকিত সেই অন্ধকার চোখে। আমি বুঝতে শিখলাম ঈশ্বরকে ছাড়িয়ে প্রেমের সংজ্ঞা। ধীরপায়ে হেঁটে গেলাম। আশ্রয় দিলাম নিজের চাদরটুকুতে, প্রবল শীতে আমার শেষ সম্বল। আমি হেঁটে এলাম ক্লান্ত পায়ে, পরম আত্মতৃপ্তি নিয়ে। যেন সদ্য ঈশ্বরের পায়ে অর্পণ করা একটি স্বর্গের পারিজাত ফুল ফেলে এসেছি। আমার সেই নিস্তরঙ্গ জগতের আলোড়ন বলে দেয়, আমি প্রেমে পড়েছি। ক্ষমা করো ঈশ্বর! আমি তোমার এই সৃষ্টির প্রেমে মগ্ন হয়েছি। ফুরোচ্ছিল না সেই বিকাল আর সহজে, ঠিক যতটা গতিময় ছিল আমার ভাবনাগুলো। চার্চে বাজতে থাকা ঘণ্টাগুলো আমাকে বাড়ি ফেরার তাড়া দেয়। আমি প্রাণপ্রিয় ঈশ্বরের কাছে রেখে এলাম আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুকে, আমার নাবিককে। শূন্য দৃষ্টির ঘোর তখনো কাটেনি তার। আমার দেয়া চাদর গায়ে দিয়ে ঠায় বসে রইলো চার্চের ভেতর, জ্বলতে থাকা মোমবাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে বললাম,
‘আমি চলে যাচ্ছি। কাল আবার আসবো। আপনি এখানে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন। ভয়ের কিছু নেই।’
কোনো উত্তর পেলাম না, নীরবতা ছাড়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলাম আমি, ক্লান্ত পায়ে সেই পুরনো রাজপথ ধরে। পরদিন বিকালে ক্লাস শেষ হতেই ছুটে যাই সেখানে। যেটুকু বিকাল পরে আছে সূর্যাস্তের, প্রাণভরে না হয় দেখে নেব সেই আগন্তুককে।
কিন্তু গিয়ে তাকে আর পেলাম না। আমার দেয়া চাদরটি ভাঁজ করে রাখা পরম যতেœ বেদির সামনে। পাশে কয়েকটি মরে যাওয়া জবা ফুল। একটি কালো রঙের উইন্ডচাইম আর সেখানে একটি ছোট্ট চিরকুট বাধা। সেখানে লেখা ছিল গোটা গোটা অক্ষরে,
‘যারা পালিয়ে বেড়ায়
নগর থেকে সমুদ্রে,
বেঁচে থেকেও তারা
জীবন নামক অমৃতের ঘ্রাণহীন…
৩ই আগস্ট, ২০২৯
ভালো থেকো মায়াবিনী।’

চিরকুট হাতে বসে ছিলাম তারপর, সারাটা বিকাল। মিস্টার এন্ড মিসেস ডি সুজা হাঁটছিলেন তাদের মতোই, সেই পুরনো বকবকে। বাচ্চারা শালিক পাখিদের মতো কিচিরমিচিরে ভরিয়ে রেখেছে পুরোটুকু। আর বাতাসে দুলতে থাকা চার্চের ঘণ্টাগুলোর মৃদু ধ্বনি।
সন্ধ্যা মেলাতেই চাদরটা ব্যাগে ভরলাম। উইন্ডচাইমটাও নিলাম হাতে পরম যতেœ। চিরকুটটি ছিঁড়ে উড়িয়ে দিলাম। বাইবেলের প্রথম পৃষ্ঠায় গুটিগুটি অক্ষরে লিখে এলাম,
‘যারা ঈশ্বর ছেড়ে
সমুদ্রে আরাধনা গাঁথে,
এবং ঘর ছেড়ে
সেই ঘরেই পালিয়ে বাঁচে।
তারা চিরকাল
সুরহীনতায় ঘ্রাণহীন!
৪ আগস্ট, ২০১৯
ভালো থেকো নাবিক।’

সন্ধ্যে মেলানোর পরপরই বেরিয়ে পরলাম চার্চ থেকে। মিস্টার এন্ড মিসের ডি সুজা তখনো বসে আছেন মাঠের কোনায় সেই বেঞ্চিতে। গিয়ে নীরবে তাদের মাঝখানে বসলাম। কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া একটি সন্ধ্যের অপেক্ষা হয়তো তখন। হঠাৎই দৃষ্টিশক্তিহীন মিস্টার ডি সুজা সুমধুর কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন,
‘কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না।’

বাকিটুকু শেষ করলেন মিসেস ডি সুজা,
‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা।’

আমার হাতে থাকা উইন্ডচাইমটি দুলতে শুরু করলো মৃদু বাতাসে। টুংটুং সুরগুলো যেন সমুদ্রের ডাক এনে দেয়। যে সমুদ্র পথ ভোলায়, যে সমুদ্র প্রেম শেখায় এবং যে সমুদ্র ঘর ভেঙে আবার ভাসিয়ে নিয়ে যায় দিনশেষে সেই একলা সমুদ্রে। হ্যাঁ, আমি সেই সমুদ্রের গল্প বলছি…

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়