বাড়িসহ বিপুল সম্পদ : অনুসন্ধান চেয়ে ওসি মনিরুলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট

আগের সংবাদ

শ্রমিক ধর্মঘটে ‘অচল’ চা শিল্প

পরের সংবাদ

কবি ফজলুল হক ও তার দুঃখের তপস্যা

প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ১২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবি ফজলুল হক- সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনে এক অনিবার্য নাম ছিল আশির দশকে। এ সময়েই যে কজন তরুণ কবিতায় জাতীয়ভাবে আলোচিত হয়ে উঠছিলেন, সে সময়ের খ্যাতি পাওয়া গুটিকয়েকজনের মাঝে হয়তো কবি ফজলুল হককে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ক্রমশ তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের মতো তরুণদের এক প্রিয় কবি হিসেবে। সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনের গণ্ডি পেরিয়ে রাজধানীকেন্দ্রিক আলোচনায় তিনি উঠে আসেন সেই সময়েই। আর সেজন্যই তাকে আমরা বলে থাকি আশির দশকের শক্তিমান কবি।
একটা দশক কিংবা একটা সময় কিছু তরুণ কবিকে চিনিয়ে দিয়েছিল সে সময় বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে এবং সেই দশকটা আশির দশক। কিন্তু ফজলুল হক সেই দশকে পড়ে থাকেননি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন সব প্রজন্মের এক প্রিয় কবি, শক্তিমান কবি।
কবি ফজলুল হক, আশির দশকের শেষ দিকে যাকে আমরা ফজলু ভাই হিসেবে কাছ থেকে দেখছি। ছাত্র আন্দোলনের এক ছোটখাটো কর্মী হিসেবে কিংবা সাংবাদিকতার কিংবা লেখালেখির সূত্র ধরে ফজলু ভাইর কাছাকাছি হয়ে যাই আমরা অনেকেই। রাজনীতির মাঠেও আমরা তাকে জোর করে টানতাম। কখনো মিছিলে হাত উঁচিয়ে তিনি আমাদের সতীর্থও হয়েছেন।
কিন্তু ফজলু ভাই যেহেতু আপাদমস্তক একজন সাহিত্যের মানুষ, একজন সাংবাদিক, সেহেতু তার সরকারি চাকরির পাশাপাশি কবি-লেখক-সাংবাদিক হিসেবেই তার সঙ্গে আমাদের আড্ডা হতো। কখনো তার উপদেশ আমরা দ্বিধাহীন মেনে নিতাম কখনো বা তর্কে জড়াতাম।
২) ফজলু ভাইয়ের সঙ্গে গত প্রায় ২০-২৫ বছর দূরত্ব ছিল আমার। এ দূরত্ব সীমানার, ভৌগোলিক। কিন্তু আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। গেল কয়েক বছর এ যোগাযোগটা আরো ব্যাপক হয়েছিল, ডিজিটালাইজড পৃথিবীর কারণে। আলাপ-আলোচনা চলত, তার কবিতার কথা বলতেন, আমিও তার বিভিন্ন কবিতা বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাগুলোতে পড়তাম। ইদানীং ভারতের কবি-সাহিত্যিকদের মাঝেও তিনি দেখা দিয়েছিলেন যেন ধূমকেতু হিসেবে। ভারতের পত্রিকায় তার কবিতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাও পড়েছি বছর দুয়েক আগে।
৩) ফজলু ভাই সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বেশিদিন হয়নি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় যাতে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে না হয়, সেজন্য তিনি সিলেট শহরে আবাস গেড়েছিলেন। অর্থনৈতিক টানাপড়েন ছিল তবুও তিনি এটাই করেছিলেন। একটা ছেলে ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। মেয়েটা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ফজলু ভাইয়ের চোখ চকচক করত যখন তার ছেলেমেয়েদের ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার খবর আমাদের দিতেন। ছোট ছেলেটিও এমসি কলেজে ভর্তি হয়েছে এবার।
গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে গিয়েছিলাম। কেন জানি এ সময়টাতে তিনি বাড়িতে ছিলেন। আমাদের সময়ের দু-একজন ছাড়া কাউকে দেশে খুব একটা পাওয়া গেল না। কিন্তু ফজলু ভাই এই কয়েকটা দিন যেন আমাকে পাহারা দিয়েছেন। জানতেন আমি হয়তো সঙ্গহীন, তাই প্রায় প্রতিদিন ফোন করে জানিয়ে দিতেন, কখন আমাকে বেরুতে হবে, কখন তিনি আসছেন আমাদের কৈশোর-যৌবনের সেই ছোট্ট শহরটাতে।
কীভাবে সেই এলাকাটার সংস্কৃতির উদ্যান চৈত্রের খরার মতো রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ হাজারেরও অধিক ছাত্রছাত্রীর বিয়ানীবাজারে কীভাবে রাজনীতির মন্দা চলছে, এ নিয়ে চলেছে নিটোল আড্ডা। এরই মাঝে আমেরিকা থেকে গেছেন কবি তমিজ উদ্দিন লোদী। লোদী ভাইও সে সময় (আশির দশক) থেকেই পরিচিত আরেক শক্তিমান কবি-সাহিত্যিক। ফজলু ভাইয়েরও অগ্রজ তিনি। আড্ডাটা জমতে থাকে, আমি কবিতার মানুষ নই। সাহিত্য আমাকে ছায়া দেয় ঠিকই, আর এই সময়টাতে ছায়া দেয়া মানুষ তারা দুজনই। আমরা আড্ডা দেই দীর্ঘ সময়, আমার মাত্র তিন সপ্তাহের ছুটিতে। আমাদের আলোচনা কবিতা থেকে রাজনীতি স্পর্শ করে। সমাজ-সভ্যতার অংশ হয়ে যায় সাহিত্যের এই আড্ডাগুলো।
এরই মাঝে একদিন আমাদের কথা হয় দেখতে যাব মুক্তিযোদ্ধা লেখক-সাহিত্যিক আব্দুল মালিক ফারুককে। ফজলু ভাই কী কারণে শেষপর্যন্ত এই দিন যেতে পারেননি। সাংবাদিক-শিক্ষক খালেদ জাফরীকে নিয়ে ফারুক ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে আসি। ফজলু ভাই আফসোস করেন, উপস্থিত থাকতে পারেননি, সেজন্য। ব্রিটেনে ফিরে আসি আমি। ফারুক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে বিয়ানীবাজারের অসংখ্য মানুষ কাঁদে। কিন্তু জীবনের অনিবার্যতাকে কেউ তো আর রোধ করতে পারে না। এটাই সত্য, কঠিন।
ফজলু ভাই তার বন্ধু এবং এক সময়ের আরেক সহপাঠী গোলাম কিবরিয়ার (সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান) কথা প্রায়ই বলতেন। কিবরিয়া ভাই দীর্ঘদিন থেকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। এক সময়ের সুবক্তা কিবরিয়া ভাইয়ের কথা বলতেও কষ্ট হয়। বড় একা কাটাচ্ছেন সময়। সিলেটের বাসায় ফজলু ভাই-ই মূলত তাকে সঙ্গ দিতেন, দেখতে যেতেন প্রতি সপ্তাহে, যা চলছিল তিনি শহরে আবাস গড়ার পর থেকেই।
৪) ফজলু ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের প্রজন্ম শুধু না, এর পরের প্রজন্মেরও আছে যেন সেই চিরচেনা বন্ধন। কবি হিসেবে তো আছেনই, এমনকি কেউ কেউ তাকে শ্রদ্ধাভরে গুরু বলেই সম্বোধন করেন। ভর গলায় ফজলু ভাইয়ের একটা কবিতা আবৃত্তি শুনেছিলাম একদিন, অন্তত ৩০ বছর আগে। নির্মলেন্দু গুণের ‘মাননীয় সভাপতি। সভাপতি কে? কে সভাপতি? /ক্ষমা করবেন সভাপতি সাহেব,/আপনাকে আমি সভাপতি মানি না’- সেই থেকে আমি তার আবৃত্তিরও মুগ্ধ শ্রোতা। তার আলাপচারিতায় একটা শৈল্পিক ভাব থাকত, অদ্ভুত হাত নাড়ানো দিয়ে মোহবিস্ট করতে পারতেন তিনি তার সতীর্থ কিংবা অগ্রজ আর অনুজদের।
তার কবিতা নিয়ে তিনি ছিলেন অসম্ভব রকম আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। শুধুমাত্র তার কথা-উচ্চারণ-দ্রোহ-তপস্যা কিংবা তার আবেগ আমরা অনেকেই খুব ভালো করেই চিনতাম, আর সেজন্যই তার বিমূর্ত কবিতাগুলোও কেন জানি আমার ধারণ করতে খুব একটা বেগ পেতে হত না। আর সেজন্যই ফজলু ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক-দ্ব›দ্ব থাকা সত্ত্বেও তার সান্নিধ্য আমার মতো অনেকেই উপভোগ করত। গত ফেব্রুয়ারি দেশে থাকাকালীন তার উচ্চারণগুলো টন টন করে বাজছে আমার কানে। সেই শব্দগুলো ভাসছে যেন ইথারে, আমার আশপাশে- এই শব্দগুলো আমার মতো কয়েকজনের সামনেই হয়তো উচ্চারণ করতেন তিনি, আমরা উল্লসিত হতাম।
ফজলু ভাইয়ের কণ্ঠ স্থির হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে পারেননি কয়েক সপ্তাহ। সে সময় ফোন করেছিলাম, উত্তর আসে ফোন-বার্তায়। তার কাছ থেকে শেষ বার্তাটি পেয়েছিলাম ২৮ জুন- অনেক কিছু লিখেছিলেন। শেষ বাক্যটি ছিল ‘দুঃখের তপস্যা এ জীবন!’
২১ জুলাই নিউইয়র্কে এসেছি। ২৬ জুলাই ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি স্তব্ধ বিয়ানীবাজার। সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনে শোক। ‘দুঃখের তপস্যা’ শেষ হয়ে গেছে কবি ফজলুল হকের। এটাই সত্য, কঠিন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়