কিউআর কোডযুক্ত : ২ লাখ রিকশার নিবন্ধন দেবে ডিএনসিসি

আগের সংবাদ

সড়কে যেন অনিয়মই নিয়ম : মালিক-শ্রমিকদের বাধায় আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি

পরের সংবাদ

প্রাণের রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথের অনেক অসামান্য গুণ থেকে যদি কোনো একটি মাত্র গুণকে বেছে নিতে হয় সর্বপ্রধান বলে, তবে তা বোধহয় হবে তাঁর আলোকসামান্য প্রাণশক্তি। এই শক্তির কথা তিনি বারংবার বলেছেন তাঁর লেখায় এবং দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে তাঁর সকল রচনায়, হোক সে ‘গোরা’র মতো দীর্ঘ উপন্যাস, নয়তো ‘লেখন’-এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতা, সর্বত্র প্রাণের প্রবাহ পরিব্যাপ্ত। এই প্রাণশক্তি কল্পনাকে মিলিয়েছে যুক্তির সঙ্গে, গাম্ভীর্যকে সঙ্গী করেছে পরিহাসপ্রিয়তার, সৃষ্টি করেছে বৈচিত্র্যের ও মৌলিকতার। তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, যেন গ্রিক পুরাকাহিনীর সেই বাদ্যযন্ত্র তিনি, বাতাসের কম্পনে গান করে ওঠেন, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততা কখনোই দূরে রাখেনি অশান্ত পরিশীলন-ব্যগ্রতাকে।
তবু এসব কথা একে একে বলার পরও, বলতে হয় যে, প্রাণশক্তি বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অবকাশবিহীন অগ্রসরমানতায়। বলেছেন তিনি, ‘আমার বাল্যকাল হতেই আমি গতির উপাসক।’ পর্বত নন, যদিও পর্বতের মতোই দৃঢ় ও দীর্ঘ; বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ নন, যদিও চলমানতা তাঁর সমগ্র সত্তায়। যেন তীর্থযাত্রী তিনি, সম্মুখবর্তী তীর্থের। সিপাহী অভ্যুত্থানের চার বছর পরে যাঁর জন্ম, তিনি জীবিত ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত। এই দীর্ঘসময়কালের সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর কোনো না কোনো রকমের যোগাযোগ ছিল, কিন্তু সেই ঘটনার ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেছেন তিনি, নিজের পথ ধরে। নিজেকে তিনি বলেছেন ঘরকুনো, কিন্তু তাঁর মতো বিশ্বভ্রমণ তাঁর দেশের আর কেউ করেননি, দেহে যত-না করেছেন তারও বেশি মনে।
প্রাণের সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক দ্বিমুখী। একদিক মৈত্রীর দিয়ে, অন্যদিকে দ্ব›েদ্বর। প্রাণের পক্ষের অবলম্বন আবশ্যক, কিন্তু বস্তু যেখানে স্তূপ হয়ে ওঠে প্রাণ সেখানে নিহত হতে পারে, তার চাপে। রবীন্দ্রনাথের গৃহে ও পরিবারে বস্তুর অভাব ছিল না, কিন্তু বস্তুতান্ত্রিক ছিলেন না তিনি। বস্তুর অবলম্বন গ্রহণ করেছেন, না-করলে অতবড় কবি হতে পারতেন না, কিন্তু বস্তুকে ছাড়িয়ে উঠেছেন সব সময়ে। ‘রাজসিংহ’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন যে, সে-উপন্যাসের জগতে ভার নাই, ‘আমাদিগকে যেখানে কষ্টে চলিতে হয় এই উপন্যাসের লোকেরা সেখানে লাফাইয়া চলিতে পারে।’ অন্যদিকে ‘আজকালকার নভেলিস্টরা কিছুই বাদ দিতে চান না, তাঁহাদের কাছে সকলই গুরুতর।’ বস্তুর ভারবাহী ছিলেন না তিনি- জীবওে নয়, সাহিত্যেও নয়। প্রমথ চৌধুরী যখন দুঃখ করে বলেন, ‘অন্নদামঙ্গল আজকাল কেউ পড়ে না, সকলে পড়ে মেঘনাদবধ’, তখন বোঝা যায় তিনি সাহিত্যের সত্য ও বস্তুর সত্যকে আলাদা করে দেখছেন না, ‘অন্নদামঙ্গলে’র চেয়ে ‘মেঘনাদবধ’র যদি অধিক প্রিয় হয় পাঠকের তবে সেটা বস্তুর আবেদনে নয়, ‘মেঘনাদবধে’র অন্তর্নিহিত প্রাণসম্পদের আবেদনে।
বস্তুকে রবীন্দ্রনাথ ভয় করেছেন। যেমন তিনি ভয় করেছেন মৃত্যুকে। সেই জন্য বস্তুর সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন স্থাপন করতে চেয়েছেন অনেক সময়, যেমন চেয়েছেন মৃত্যুর সঙ্গে। ‘যাকে আমরা জড় বলি তার সঙ্গে আমাদের যথার্থ আপনিই দুই স্বতন্ত্র জগত তৈরি হয়ে উঠত।’ কিন্তু বস্তুর অভাব যে-দেশের প্রধান সত্য, দারিদ্র্য যে-দেশের অসম্ভব রকমের সেখানে প্রাণ বস্তুর সঙ্গে মৈত্রী করে প্রাণবন্ত হতে পারে না, বস্তুর সঙ্গে বিরোধিতাই তার একমাত্র পথ, বস্তুকে জয় করে তবেই সে জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে যথার্থ অর্থে। সেই দ্ব›েদ্বর শিক্ষাটাই প্রয়োজন ছিল বাঙালি সমাজের। এবং সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ভয় করেছেন বস্তুতান্ত্রিক যন্ত্রকে। বস্তুর মতো যন্ত্রকেও ভয় করবার কথা, যন্ত্র যদি অত্যন্ত প্রবলভাবে থাকে তবেই। যে-দেশে তাঁর জন্ম সে-দেশের বস্তুর প্রাচুর্য আছে এমন বলা যাবে না; অসম্ভব দরিদ্র সে-দেশ, দরিদ্রতমদের অন্যতম সেখানে যন্ত্র প্রায় নেই-ই, রবীন্দ্রনাথের কালে কম ছিল আরো। বাংলাদেশের যান্ত্রিকতা যন্ত্রসৃষ্ট নয়, যন্ত্রের অভাব দ্বারা সৃষ্ট। সমস্ত দেশ প্রকাণ্ড একটা স্তূপের মতো পড়ে আছে, নিশ্চুপ হয়ে, মাঝে মাঝে চেষ্টা হয়েছে জাগাবার। লেখকেরা মনে করছেন জাগাবেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের অভীপ্সিত জাগরণ আসলে ছিল আরেক ঘুমের প্রস্তুতি, এক ঘুম থেকে অন্য এক ঘুমে নিয়ে যেতে চেয়েছেন তাঁরা। রাজনীতিকেরা চেষ্টা করেছেন, ভিন্ন ভিন্ন পথে, কিন্তু জাগরণ ঘটেনি। জাগতিক বস্তুর অভাব-পীড়িত দেশে রবীন্দ্রনাথ বস্তুকে উপেক্ষা করার কথা বলে নিজের মনীষার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন, কিন্তু অভাব মেটাবার কাজে দেশবাসীকে কাক্সিক্ষত সহায়তা দান করতে পারেননি। কাক্সিক্ষত বললাম এই জন্য যে, তাঁর ভূমিকা শুধু কবির ছিল না, ছিল শিক্ষাগুরুরও। যন্ত্রকে সন্দেহ করা তাঁর নিজের পথে অহেতুক নয়, কেননা তিনি যান্ত্রিকতাবিরোধী, কিন্তু অন্য যে-যান্ত্রিকতা সৃষ্টি হয় যন্ত্রের অভাব থেকে তার পক্ষে যন্ত্র শত্রæ তো নয়ই, মিত্র বটে। বস্তু ও যন্ত্র সম্পর্কে তাঁর ভয়টা ছিল ধনীর, অভিজাতের, কিন্তু সেই ভয় তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যেও। আমাদের পক্ষে বস্তুকে নয়, আসলে ভয় করার কথা ছিল বস্তুহীনতাকে; যন্ত্রকে নয়, যন্ত্রহীনতাকে। তা হয় নি, হয় নি যে তার একটি কারণ লেখকদের অসহযোগিতা। অসাধারণ লেখক রবীন্দ্রনাথ সাধারণ এখানে।
প্রাণের প্রকাশ সর্বত্র এক প্রকারের হয় না- হতেই পারে না, হওয়াটা নিয়মবিরুদ্ধ। প্রাণ থেকে বিদ্রোহে, যেমন থাকে কর্মযোগে। যেমন ছিল বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, নজরুলে এবং কৃষক ও তরুণদের বিদ্রোহী উদ্যমে। অন্যদিকে ছিল রামমোহনের ও বঙ্কিমচন্দ্রের নির্মাণ-কুশলতায়। রবীন্দ্রনাথ শুধু বিদ্রোহী নন, কর্মীও নন শুধু- যদিও বিদ্রোহ ও কর্ম উভয়ই ছিল তাঁর মধ্যে; তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি সৃষ্টিকারী, নির্মাণের তুলনায় সৃষ্টি করেছেন অধিক, যে-সৃষ্টি বিদ্রোহই এক প্রকারের।
নদীর কথা বার বার এসেছে, তাঁর রচনায়। সেই নদীর মতোই তিনি- নিরন্তর প্রবহমান, কিন্তু প্রমত্তা নন, পদ্মা নদী যেমন অনেক সময় হয়ে থাকে। সেই পদ্মা তিনি, জনপদকে যা স্পর্শ করে কিন্তু জনপদে হারিয়ে যায় না, বজায় রাখে প্রবহমানতা ও নিজস্বতা। এই যে তিনি এসেছেন জনপদবাসীর নিকটে, প্রবেশ করেছেন সমাজের অভ্যন্তরে, সমস্যার বাঁকে- সেজন্যই প্রত্যাশা জেগেছে মানুষের, তিনি দেবেন বাণী, জাগরণের। এবং বাণী অবশ্যই আছে রবীন্দ্রনাথের। তিনি বলেছেন, ‘আমার প্রধান সার্থকতা সবকিছু প্রকাশ করা- বাণীর দ্বারা করেছি, কর্মের দ্বারাও করেছি।’ এমন সার্থকতা, বলাবাহুল্য, অন্যকারো জীবনে আসেনি এদেশে। কিন্তু- অনিবার্য কিন্তুটা- এখানে যে, এই বাণীর প্রকাশে যতটা অভিনবত্ব আছে, বাণীর চরিত্রে ততটা অসাধারণত্ব নেই। তাঁর বাণীর মূল সুর ভক্তির, এর মূল উপাদান প্রাচীন আধ্যাত্মিকতা তথা ভাববাদ।
সৃষ্টির চাইতে অবশ্য স্রষ্টা বড়। গোরার চেয়ে অনেক বড় গোরার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ। গোরায় সেই নম্রতার অভাব ছিল, যা রবীন্দ্রনাথের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু ওই কোমলতাকে বাড়িয়ে, ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে তুলে ধরা হয়েছে; রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে কোমলতার দিকটা অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ ও রোমান্টিকতার সঙ্গে যুক্ত, ভক্তির রসে তা আপ্লুত। তাঁর ভাষায়, রূপকল্পে, বিষয়ের উপস্থাপনায় এবং সর্বোপরি তাঁর সঙ্গীতে একটা নম্রতা রয়েছে, যা প্রাণশক্তির বিরোধী নয়, বরং বলা যায় ধারক। নম্রতার মধ্যেও তিনি দৃঢ়, কোথাও কোনো শব্দে, উপমায় কি রূপকল্পে, চিন্তার বিস্তারে কি যুক্তির সংগঠনে শিথিলতার প্রশ্রয় দেননি। প্রকাশ প্রাণকে বেষ্টন করে রেখেছে। সংহত করেছে বটে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি আদৌ। এই দুইকে, শক্তি ও প্রকাশকে একত্র করে রাখা আবশ্যক। আলাদা করলে তারা উভয়েই প্রাণ হারায়। শক্তি প্রকাশের সঙ্গে এবং প্রকাশ শক্তির সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সূত্রে যুক্ত।
রবীন্দ্রচর্চায় কিন্তু প্রবণতা আছে প্রকাশকে বড় করে দেখবার, তাঁর মনোহারিত্বের নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করবার। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে একটা স্বাভাবিক ও অবাঙালিসুলভ বীরত্ব ছিল যার জন্য তিনি একাকী ছিলেন ভিড়ের মধ্যে থেকেও, যার একটা চকিত নাটকীয় প্রকাশ দেখেছি জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার সময়, সেটিকে বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ থাকেন না।
কোমল রবীন্দ্রনাথকে অনুসন্ধানের প্রধান কারণ অনুসন্ধানকারীদের মানসিকতা। রবীন্দ্রভক্ত মধ্যবিত্ত বস্তুকে ভালোবাসে এবং প্রায়-নির্জীব বস্তুর মতোই অন্যের মধ্যে প্রাণের দেখা পেলে হয় বিব্রত, নয়তো বিচলিত হয়। মধ্যবিত্ত রবীন্দ্রনাথকে যত না ভালোবাসে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিকে, যে-মূর্তিকে তারা নিজেদের প্রয়োজন মতো কাটছাঁট কড়ে গড়ে নিয়েছে। মূর্তির এই রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত কোমল, নিতান্ত নিরীহ, বাঙালির চেয়েও বাঙালি, ভাববাদী ও উদাসীন, রোমান্টিক ও শান্ত, এবং গৃহবাসী। দ্বিতীয় কারণ, রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই মনোহরণের ক্ষমতা রাখেন আলোকসামান্য। আমাদের দেশে আমরা গরিব বলেই হবে, পোশাক জিনিসটা অতিশয় মূল্যবন। পোশাকেই পরিচয় হয় এবং সম্মান লাভ ঘটে মানুষের এবং যেখানে ইচ্ছা করে পোশাক খুলে লেখা হয়, যেমন খোলে সাধু সঙ, ফকির-দরবেশরা, সেখানেও ওই পোশাকের কারণেই অলৌকিক মাহাত্ম্যের আভাস দেখতে পাই আমরা। পোশাক না-থাকাটাও পোশাক হয়ে দেখা দেয়, এক প্রকারের। রবীন্দ্রনাথের কাজে পোশাক আছে এমন মোহন যা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। এই আবরণ তাই বড় হয়ে উঠতে চায় বক্তব্যকে ছাপিয়ে। অগ্রসরমানতার ও সৃজনশীলতার যে-শিক্ষা আছে তাঁর রচনায় সে-শিক্ষা পৌঁছায় নি দেশবাসী সকলের কাছে; অনেকের কাছে
পৌঁছাবার কথাও নয়, দারিদ্র্যের কারণে; অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন যারা তারাও বাইরের শোভা নিতে চেয়েছে ভেতরের মর্মবস্তুকে উপেক্ষা করে। তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ গানের রচয়িতাই মূলত, অন্যকিছু ছাপিয়ে।
মানতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাথ নিজেও প্রশ্রয় দিয়েছেন ভক্তের এই দুর্বলতার। তিনি আঘাত করেননি তেমন করে যেমন করে করলে আধ মরারা বঁচুক না-বাঁচুক জেগে উঠতে চাইতো, তন্দ্রা ভেঙে। গোরা একদা পল্লীগ্রামে গিয়ে একেবারে অনাবৃত দেকতে পেয়েছিল ‘সেখানকার নিশ্চেষ্টতার মধ্যে স্বদেশের গভীরতর দুর্বলতার মূর্তি’ এবং বুঝতে পেরেছিল সেই নিশ্চেষ্টতার কারণ এই যে, ‘পল্লীর মধ্যে বাহিরের শক্তিসংঘাত তেমন করিয়া কাজ করিতেছে না, যে-বৃহৎ পল্লী এই বঙ্গভূমি সেখানে আঘাত প্রয়োজন ছিল বড় রকমের। প্রশ্ন উঠবে কবিকে কেন দায়িত্ব দিচ্ছি সমাজ-জাগরণের? দিচ্ছি এই কারণে যে, তিনি কবিই নন শুধু, তাঁর ভূমিকা ছিল শিক্ষাগুরুরও। নিজেকে সংগঠিত করেছিলেন তিনি একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে- শুধু প্রাতিষ্ঠানিক রূপে নয়, রচনার মধ্যে দিয়েও; রচনার মধ্যেই বরঞ্চ প্রধানত।
দুর্বলতার সেই প্রশ্রয়দান প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। রবীন্দ্রনাথের চলমানতা অসামান্য। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে, ‘কালান্তরে’, হরিপদ কেরানীদের কথকতায়, বিদ্রোহিনী এলাদের চিত্রায়নে, ‘গল্পসল্পে’র উপস্থাপনায় অনেক অনেক দূরে এগিয়ে এসেছেন তিনি অবশ্যই ভানুসিংহ ও প্রতাপাদিত্যদের জগৎ থেকে। কিন্তু এ-অগ্রসরমানতা বৈপ্লবিক নয়। ভক্তির, ভাববাদের, আধ্যাত্মিকতার মূল কাঠামো ভেঙে বের হয়ে যাননি তিনি, অসামান্য তিনি তাঁর সামান্য পাঠকদের সঙ্গে একই বৃত্তে অবস্থান করেছেন। একই বৃত্ত বলা ভুল হয়তো, তাঁর বৃত্ত অনেক বড়, কিন্তু একই তার চরিত্র। তীর্থযাত্রী নগরবাসী এখানে, নগরের মূল্যবোধ তাঁর সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। এমনটা সম্ভব নয় যে, তিনি পৌঁছে যাবেন একেবারে অকল্পিত কোন নতুন দেশে। তাঁর অগ্রসরতা প্রকাশের ক্ষেত্রে যতটা সুবিস্তৃত, চেতনার ক্ষেত্রে ততটা নয়।
তবু তাঁর তীর্থযাত্রা অত্যন্ত বড় সত্য। রবীন্দ্রস্তুতি সেই দিকটাকে ভুলিয়ে দিতে চায়, তাঁকে পরিণত করতে চায় অলস বিগ্রহে- অর্থাৎ, নিস্তেজ বস্তুপুঞ্জে।
তীর্থযাত্রীকে নম্র শান্ত নিরীহ নগরবাসী করে তোলাটা অন্যায়- শুধু রবীন্দ্রনাথের জন্য নয়, সমগ্র দেশবাসীর জন্য; কেননা রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে দেখতে গেলে তদ্দ্বারা অবজ্ঞা করা হয় তার প্রাণশক্তির প্রধানতম প্রকাশকে এবং দেশবাসীর পক্ষ থেকে দেখতে গেলে এর ফলে অবজ্ঞা করা হয় পরিবর্তনের অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনকে। রবীন্দ্রনাথ সত্য, শিব ও সুন্দরের পূজারী ছিলেন এই বিবরণ দেয়াটা অর্থহীন, তিনি মানুষের মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকারের পক্ষে ছিলেন দ্বিধাবিহীন- এই সত্যটাকেই উন্মোচিত করা আবশ্যক। আর সেই সত্যটা যত বেশি জানা হবে, ততবেশি স্পষ্ট হবে সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন করবার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা। প্রাণশক্তি জয়ী হবে বস্তুপুঞ্জের ওপর।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়