কিউআর কোডযুক্ত : ২ লাখ রিকশার নিবন্ধন দেবে ডিএনসিসি

আগের সংবাদ

সড়কে যেন অনিয়মই নিয়ম : মালিক-শ্রমিকদের বাধায় আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি

পরের সংবাদ

আমার রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমার মনোদৈহিক যে কোনো বেদনা আপাত উপশম করার প্রধান অনুপ্রাণ রবীন্দ্রসংগীত; আমার চিন্তার জট খুলতে প্রধান অনুষঙ্গ রবীন্দ্রনাথের গদ্য-গল্প-উপন্যাস; আমার দায়বোধের দিশাহীনতায় প্রধান আলোর দিশারী রবীন্দ্রনাথের নাটক; আমার নির্বাণ লাভের প্রধান আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ। ধারণা করি, এ উচ্চারণ শুনে কেউ কেউ হয়তো চমকে উঠবেন; কিন্তু যা সত্য আমি তাই অকপট উচ্চারণ করলাম।
আমার শৈশব-কৈশোর ছিল খুবই নিরীহস্বভাব। দুরন্ত বলতে যা বোঝায় আক্ষরিক অর্থেই আমি তা ছিলাম না। কিন্তু লোকপ্রবচনের ‘মিরমিরা ঘুড়া কালাই খাওয়ার যম’ যে অর্থে প্রযোজ্য তার শতভাগ ছিল আমার মধ্যে। আর আমার প্রথম যৌবন ছিল কাব্যাক্রান্ত-নাট্যচর্চার ঘোরগ্রস্ত। যুবকদের মধ্যে যে চাঞ্চল্য-যে উন্মাদনা থাকে আমার সে অবকাশ ছিল না মোটেই; কারণ আমাকে নাটক করতে গিয়ে ‘টিমওয়ার্কের’ বিষয়টিকে আমলে আনতেই হতো। তারপরও নিজের ভেতর যে ‘মিরমিরা ঘোড়াটি’ ছিল তার প্রভাবে আমার বিপন্ন তারুণ্য হিসেবে বিকশিত হবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম আমার মায়ের কারণে। আমার মা শৈশব-কৈশোরেই আমার ভেতরে কতিপয় বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। বীজ অঙ্কুরিত হয়ে সেসব বৃক্ষ নিজের ভেতর এতটাই পল্লবিত হয়েছিল, ওরা এতটাই প্রথিত ছিল মৃত্তিকার গভীরে, যে জীবনের নানান বাঁকে যত দুর্বৃত্ত ঝড় বয়ে গেছে নিজের ওপর, সবাইকে ফিরিয়ে দিয়ে মা’র পুঁতে দেয়া শৈশব-কৈশোরের মূল্যবোধের চেতনার সাথে অনড় থেকে গেছি আজীবন। মা আমার বুকে চেতনার যে বীজগুলো বপন করেছিলেন, তাদেরই একজন রবীন্দ্রনাথ; আমার মায়ের দেয়া মহার্ঘ্য উপহার ‘বোধিবৃক্ষরাজি’।
মা আমাকে সৎ থাকতে শিখিয়েছিলেন; আশ্রয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাথে। মা নিজে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ-নামাজি, তিনি আমাকে কুরআন শিক্ষাও দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘ধর্ম বিষয়টাকে জেনে বুঝে নিজের প্রজ্ঞায় দ্যুতিময় করে সিদ্ধান্ত নিবি অসুবিধা নেই কিন্তু যখন নিজেকে অসহায় মনে হবে তখন রবীন্দ্রবৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নিবি, দেখবি তিনি তোকে আলোকিত পথের দিশা দিবেন।’ আমি কেবল ভাবতাম, ‘কী বলছে আমার মা- ডা. ফকির মুন্সির কালো কন্যা?’ আজ বুঝতে পারি আমার কালো মায়ের অন্তরের আলোকদ্যুতি কতটা উজ্জ্বল ছিল। মা’র হাতে রোপিত বৃক্ষরাজির সাথে কাটিয়ে জীবন সংগ্রামের অনেক বাঁকে হোঁচট খেয়েছি বারবার, বারবার রক্তাক্ত হয়েছি; কিন্তু মনের শান্তি খোয়া যায়নি কখনো।
আমার অন্তরে যে শান্তির প্রস্রবনধারা, তার উদগাতা আমার মা; আর আমার আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের ব্যাপারে আশাবাদ উচ্চারণ করে বলেছিলেন, তাঁর গানকে বাঙালি কোনোদিন পাশ কেটে যেতে পারবে না। কবিগুরুর আশাবাদ যে মিথ্যে নয় ইতোমধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আমাদের আনন্দ-বেদনায়, উৎসবে-অনুষ্ঠানে এবং প্রাত্যহিকতায় নিত্য রবীন্দ্রসংগীতের সুরমূর্ছনায় অবগাহন করছি। শতবর্ষের বহুল ব্যবহারে কখনো তিনি মলিন হয়ে যাননি। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী প্রতিদিন আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে; কখনো আমাদের পবিত্র করেছে, কখনো একাকিত্বে সঙ্গী হয়ে শুশ্রƒষা দিয়েছে, কখনো প্রণয়ে নিবিড় করেছে, কখনো ভ্রমণজনিত ক্লান্তি দূর করেছে, দেশপ্রেমে আকুল করেছে, আবার কখনো সত্য-সুন্দর-কল্যাণের পথে চলতে সাহস জুগিয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া শিষ্ট বাঙালির সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা কি একদিনের জন্যে-এক মুহূর্তের জন্যও সচল থেকেছে? থাকেনি। এ সত্য উচ্চারণের স্পর্ধার রহস্য উন্মোচনের সূত্র হিসেবে রবীন্দ্র সংগীতের সর্বব্যাপী বিস্তৃতির শক্তিকেই আশ্রয় করতে চাই।
রবীন্দ্র সংগীতের ভুবনবিস্তারী বাণী যখন উচ্চারিত হয়, যখন গীত হয়-
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে \
তখন আমরা যেমন আত্মনিবেদনের জন্যে তাঁর বাণীর ঋদ্ধিতে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পারি, একই সাথে পরিপার্শ্বকে দিতে পারি আলোকদ্যুতির সন্ধান। আমাদের প্রাত্যহিকতায় দিশা দিতে এমনি অসংখ্য গানের উল্লেখ করতেই পারি। রবীন্দ্রনাথ হয়ে থাকেন আমাদের প্রতিদিন প্রত্যুষের-দিবস-রজনীর প্রণম্য মহাপুরুষ।
শৈশবে যখন মা’র কণ্ঠে শুনতাম-
এসো হে বৈশাখ এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক
এসো এসো \
আমার মাকে তাঁর জীবনে এই একটি গান ছাড়া কোন গান গাইতে শুনিনি। প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তির দিন মা ঘর-দোর-আঙিনা ঝাড়-পোছ করতে করতে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের অমর এ গান; আর আমি আমার শৈশব থেকে ক্রমশ রবীন্দ্রনাথে নিমজ্জিত হতে থাকতাম। সেই নিমজ্জন কখন যেনো রবীন্দ্রনাথকে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ করে তোলে।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে যখন পূর্ববাংলায় সামরিক শাসন চলছে, অথবা সামরিক শাসনের কড়াকড়ি অতিক্রম করে মৌলিক গণতন্ত্রের ছত্রছায়ায় উন্নয়নের (?) জোয়ার বইছে সর্বত্র, একই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির মস্তক থেকে বিতাড়ণের অশুভ পায়তারা ক্রিয়াশীল; ঠিক সে সময়ের প্রেক্ষাপটেই এমন একাধিক মানুষের নাম উচ্চারণ করতে
পারি যাঁরা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে দিন শুরুর প্রাক্কালে রবীন্দ্রনাথের অন্তত একটি কবিতা অথবা গান উচ্চারণ করতেন। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে রাতে ঘুমাতে যেতেন প্রতিদিন এবং এঁদের কেউ-ই রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নন; তবে রবীন্দ্র-ভক্ত অবশ্যই। সেই ভক্তদের তালিকায় বিদগ্ধ-প্রাজ্ঞজন যেমন ছিলেন তেমনি সাধারণ মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ষাটের দশক বাংলাদেশের মানুষের জন্য, বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সবাই জানি। ষাটের দশক শুরু হয়েছে কবি রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ দিয়ে। শতবর্ষের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ নবরূপে আবির্ভূত হয়েছেন বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিতে।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির ইতিহাসে সেই মনীষী যিনি তাঁর জীবনে মানুষের জন্য শিষ্ট সংস্কৃতির একটা ‘মান’ (ঝঃধহফধৎফ) রচনা করে গেছেন। যে মান বাংলার মাটি ও মানুষ, বাংলার জলবায়ু ও প্রকৃতি এবং সর্বপোরি বাঙালির মনোজগতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; যে মানকে অস্বীকার করে বাঙালির পক্ষে সুসভ্য থাকা আক্ষরিক অর্থেই দুরূহ। বর্তমান সময়ে এমনকি কবিরাও অনেকে রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করে দিয়ে নিজের গৌরব বৃদ্ধির প্রয়াশ পান। রাজনৈতিক প্রয়োজনে যারা বাতিল করেন তাদের স্থুলতা-কূপমণ্ডূকতা অথবা প্রবঞ্চনার কারণ বোঝা যায়, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষেরা যখন একই আচরণ করেন, তখন যে কারো মনে সংশয় জাগা অসঙ্গত নয়। আর সাধারণের রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সামর্থ্য কোথায়? তারা যেটা করে তার সামান্য বিদগ্ধজনের মুখে শুনে, কিছুটা রবীন্দ্র-বাণীর প্রেমে আর সিংহভাগ সবার দেখাদেখি। তাই বলে সাধারণের আবেগে কোন কৃত্রিমতা নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথ একান্তই আমাদের এবং রবীন্দ্রনাথ আমাদের অহংকারের আশ্রয়ও বটে। বড় বড় বিষয়ের সাথে সাধারণের তেমন কোনো যোগ নেই। সাধারণের বিবেচনায় কবি রবীন্দ্রনাথ গীতিকার-সুরকার, রবীন্দ্রনাথ নাট্যকার-গল্পকার-ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিক-অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ, বড়জোর সমাজতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ এবং সবমিলিয়ে দার্শনিক-ঋষি রবীন্দ্রনাথ। যে রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর বিস্তৃতি কখনো কখনো সাধারণের কাছে অবিশ্বাস্য- কখনো প্রশ্নবিদ্ধ আবার কখনো ভক্তি-আপ্লুতিতে আচ্ছন্ন। তাই তো কারো কারো কাছে রবীন্দ্রনাথ প্রায় দেবতার সমতুল্য- এবং প্রাতঃস্মরণীয়-পুজনীয়।
সাধারণ পাঠক জানেন রবীন্দ্রনাথ রাজনীতিক ছিলেন না কিন্তু রাজনীতিমনষ্ক ছিলেন। স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ১৯০৫-এ রবীন্দ্রনাথ দেশপ্রেমের যে গানগুলো রচনা করেছিলেন সেসব গান কেবল সে সময় নয় আজো বাঙালি জাতির প্রাণে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর সমগ্র জাতি যখন হতবাক-কিংকর্তব্যবিমূঢ়- জাতীয় নেতৃত্ব যখন দিশেহারা তখন রবীন্দ্রনাথ ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করে দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধা এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করেছিলেন তা তাঁকে অনন্য এক উচ্চতায় অধিষ্ঠান দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর গানে- কবিতায় চিন্তা ও মননে আমাদের জন্য শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা এবং জীবনচর্চার যে ‘মান’ সৃষ্টি করে গেছেন তা আজকের প্রেক্ষাপটেও প্রাসঙ্গিক হবে তেমন চিন্তার সুযোগ নেই, এ কথা যেমন সত্য; পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ আজো আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনচর্চায় অনিবার্য সে কথাও বাস্তব। অন্যভাবে বলতে পারি যে ‘মান’ রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য দিয়ে গেছেন তাকে অতিক্রম করে ভিন্ন কোনো ‘মান’ কেউ আমাদের জন্য আজো দিতে পারেননি। যাঁরাই যা কিছু দিয়েছেন তা রবীন্দ্রনাথেরই সম্প্রসারণ মাত্র। তাই রবীন্দ্রনাথ রচিত বাঙালির শিষ্ট সংস্কৃতির ‘মান’ আজো অলঙ্ঘ।
কবিরা কবিতা লিখে চোখের পলকে মানবতাশূন্য পরিপার্শ্বের পাশবিকতা থেকে সমাজকে মুক্ত করে দেবেন এবং দুরাচার-পাপাচার-অনাচারের নিমগ্নতা থেকে মুক্তি দিয়ে বিপন্ন মানুষকে পরিতৃপ্তির স্বাদ দেবেন পলকের কারিশমায়, তেমনটি বিবেচনা করার কারণ নেই; কিন্তু সময় পরিপার্শ্ব আর নিমজ্জিত সময়ের বাস্তবতাকে আরোগ্য নিকেতনের পথ দেখাতে পারেন কবিরাই। যখন ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে, সে সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতার শরণাপন্ন হলে এবং কবিতাকে অন্তরে ধারণ করলে মুক্তি আসবে।
ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে-
তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’; বলে গেল ‘ভালোবাসো-
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’।
বরণীয় তারা স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।
আমি যে দেখেছি- প্রতিকারহীন, শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে।
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রæজলে-
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

(প্রশ্ন : ১৩৩৮)
রবীন্দ্র-কাব্যের এই প্রশ্ন পর্যন্ত পড়ে থেমে গেলে চলবে না বরং কবিতাটির মর্ম উপলব্ধি করে অশুভ জগদ্দল পাথর সরিয়ে মুক্তির জন্য প্রয়োজন নিজেকে পরিপূর্ণ প্রস্তুত করে নেয়া, প্রয়োজন নিবিড় রবীন্দ্রপাঠ।
বাংলার প্রকৃতির লীলা, প্রকৃতির সমস্ত শোভার চিত্ররূপ যেন আমরা দেখতে পাই তাঁর বাণীর তরঙ্গায়িত ছত্রে; সে সৌন্দর্য আমাদের খুব চেনা; কিন্তু অনাবিষ্কৃত যেন। হয়তো তাই এত চমক- তাই এমন আলোড়ন। প্রকৃতিকে তিনি যেনো টেনে এনে প্রাণের উৎসবে যুক্ত করেন অনিন্দ্য রূপমাধুর্য দিয়ে; এভাবেই জন্ম নেয় আমাদের ঋতুভিত্তিক উৎসব। রবীন্দ্রনাথের এই নির্মলানন্দ পাঠের পরও যখন আমার রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘বিসর্জন’ অথবা ‘রথের রশি’ সেখানে দেখি রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত বিশ্বাস ভেঙে দাঁড়িয়েছেন ধর্মীয় অন্ধতার বিরুদ্ধে। রথ যখন থেমে পড়ে, সে রথ চালুর জন্য রবীন্দ্রনাথ কুলীন-উচ্চবর্ণের শরণাপন্ন হননি; শরণাপন্ন হলেন নি¤œবর্ণের অচ্ছুত মানুষের কাছে; এ সত্যি উচ্চারণের স্পর্ধা তাঁর সময়ে ক’জনের ছিল? সেই রবীন্দ্রনাথ আমার রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য যা দিয়ে গেছেন, তা এক কথায় প্রকাশ করা সহজ নয়। বহুমুখী প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো যে সম্পদের ঋদ্ধি রেখে গেছেন তা বিশ্ব-প্রেক্ষাপটেই বাঙালির অহংকারের ধন। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কেবল মান (ঝঃধহফধৎফ) নয়, সংগীতে দিয়েছেন বাণী আর লয়ের ঐশ্বর্য, তেমনি নাটকের ক্ষেত্রে পরিমিতি ও পূর্ণতা।
সর্বসাকুল্যে রবীন্দ্রনাথ প্রায় ষাটের কাছাকাছি নাটক রচনা করে কেবল আমাদের নাট্যসাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেননি বরং বাংলা নাটকের ভাঁড়ারে যোগ করেছেন বিপুল ঐশর্য। রবীন্দ্র-নাট্য ঐশ্বর্যেরই দুই হীরক খণ্ড ‘রক্তকরবী’ ও ‘অচলায়তন’। বর্তমান আলোচনায় এ দুটি নাটক নিয়েও সামান্য কথা হবে। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে নাটক দুটি নানা করণে যথেষ্ট আলোচিত, আলোকিত ও প্রশংসিত। আলোচিত- আলোকিত এবং প্রশংসিত বলে নয় বরং নাটকের মেধাবিচারেও রবীন্দ্রনাথের এ দুটি নাটক তাঁর নাটকের মান বিচারে নয় বরং সমগ্র বাংলা নাটকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শুধু এ দুটি নাটক রচনার জন্যও তিনি অমরত্ব পেতে পারেন। যেমন সংলাপে- তেমনি গাঁথুনিতে অথবা প্রকরণে এবং অবশ্যই স্বকীয়তায়; সব বিবেচনায়ই ‘অচলায়তন’ ও ‘রক্তকরবী’ নাটক দুটি অগ্রগামী। সমস্ত কাহিনী-গল্প-চরিত্র এবং সংলাপকে রক্তকরবী নাটকে রবীন্দ্রনাথ এক দৃশ্যপটে সমন্বয় করে নাট্যবোদ্ধাদের চমকে দিয়েছেন আর অচলায়তনে একাধিক দৃশ্যপটের ব্যবহার থাকলেও তা কিন্তু সংঘটনের জন্য বিপজ্জনক নয় কিছুতেই।
আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন পূরণের গল্প খুঁজতে এবার স্মরণ করবো রক্তকরবীর নন্দিনী ও অধ্যাপকের দুটি সংলাপ:-
নন্দিনী : যখন রঞ্জন আসবে তখন দেখিয়ে দেব উড়ো খবর কেমন করে মাটিতে এসে পৌঁছাল।
অধ্যাপক : রঞ্জনের কথা উঠলে নন্দিনীর মুখ আর থামতে চায় না। (খানিকটা গিয়ে ফিরে এসে) নন্দিনী, একটা কথা
তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, য²পুরীকে তোমার ভয় করছে না?
নন্দিনী : ভয় করবে কেন!
অধ্যাপক : গ্রহণের সূর্যকে জন্তুরা ভয় করে, পূর্ণসূর্যকে ভয় করে না। য²পুরী গ্রহণলাগাপুরী। সোনার গর্তের রাহুতে
ওকে খাবলে খেয়েছে। ও নিজে আস্ত নয়, কাউকে আস্ত রাখতে চায় না- আমি তোমাকে বলছি, এখানে থেকো না। তুমি চলে গেলে ওই গর্তগুলো আমাদের সামনে আরো হাঁ করে উঠবে; তবু বলছি, পালাও। যেখানকার লোকে দস্যুবৃত্তি করে মা বসুন্ধরার আঁচলকে টুকরো টুকরো করে ছেঁড়ে না, সেইখানে রঞ্জনকে নিয়ে সুখে থাক গে। (কিছুদূর গিয়ে ফিরে এসে) তোমার ডান হাতে ওই যে রক্তকরবীর কঙ্কন, ওর থেকে একটি ফুল খসিয়ে দেবে?
নন্দিনী পালিয়ে যায়নি। রক্তকরবীর কঙ্কন কব্জিতে জড়িয়ে অচলায়তন ভাঙার স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে নন্দিনী এবং বঞ্চিত মানুষেরা সবাই। নন্দিনীর স্বপ্ন মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় পাঠকের অন্তরে- দর্শকের চেতনায়। অচলায়তনের পঞ্চকের স্বপ্নও তাই। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ জাগিয়ে রাখেন আমাদের বঞ্চিত-শোষিত মানুষের পক্ষে। রবীন্দ্রনাথের নাটক রচনার মুন্সিআনায় রক্তকরবীর রক্তিমাভা অবলোকন করে- পঞ্চকের অচলায়তন ভাঙার দুঃসাহস পড়ে যে কোনো বিদগ্ধ পাঠক- সচেতন দর্শক স্বীকার করবেন বাংলা নাটকের দুশো বছরের পরম্পরায় রবীন্দ্রনাথ আজো সমকালীন- আজো আধুনিক। আমার রবীন্দ্রনাথ এভাবেই তার নাট্যালোকে আমায় দিশা দিয়ে দায়মুক্ত হবার পথ দেখান। আমার রবীন্দ্রনাথকে তাই আমি নিবেদন করি নৈবেদ্য-নিত্য অর্ঘ্য।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়