ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ : পরীমনির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসিরের ফের মামলা

আগের সংবাদ

কে কোথায় কুরবানি দিচ্ছেন

পরের সংবাদ

বানভাসিদের ঈদ আনন্দ

প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রকৃতি, নদী ও মানুষ- এসব এই ভাটি অঞ্চলে বিশেষ করে নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে পরস্পর তৈরি করেছে এক ‘নিরবধি সম্পর্ক’। এসব অনুষঙ্গ নিয়ে বাঙালি সাহিত্যজনেরা প্রাচীন যুগ থেকে অদ্যাবধি সাহিত্য রচনা করছেন। কবি চণ্ডিদাসের বিরহ বিধূরতা বর্ষার ঘন মেঘের মতো বেজে উঠেছে হৃদ-আসনে। তাই রচনা করলেন পদ। মৈথলী কবি বিদ্যাপতির রচনায়ও বিরহ বেদনা কম নয়। তিনিও যেন পেয়েছেন বর্ষার ঋতুতে মনের খোরাক। বুকের ভেতরে আগলে রাখা যাতনাকে তাই প্রকাশ করেছেন ভরা ভাদরের বেদনার্ত রূপের সঙ্গে মিল করে:
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।

চণ্ডিদাস, বিদ্যাপতি- দুজনই মধ্যযুগের কবি। দু’জনের হৃদয়ের ব্যথা কবিতায় পদ রচনের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের এই ভাটি বাংলায় ষড়ঋতুর মাধুর্যও তারা অবগাহন করেছেন, অনুভব করেছেন। উত্তর-আধুনিককালে প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ প্রকৃতির কাছে অসহায়, শক্তহীন, গৃহবন্দি। প্রকৃতির এই বহুরূপী খেলার শিকারি সবাই কবি নন, গল্পকারও নন। তারা কেবলই মানুষ, খেটে-খাওয়া মানুষ। তারা হয়েছেন সাহিত্যের উপাদান মাত্র।

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বর্ষার রূপকে দেখেছেন অপরূপ শক্তি হিসেবে, যেখানে প্রকৃতি ও মানব মিলেমিশে একাকার হয়েছে। এর সঙ্গে দেবতারাও ঘোষণা করেছেন একাত্বতা।

‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর,
উথলিল নদ নদী ধরণীর উপর।
রমণী রমন লয়ে, সুখে কেলি করে,
দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।’
বর্ষাকাল/মাইকেল মধুসূদন দত্ত

অন্যদিকে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা ঋতুকে বহুবাঁকে বহুপাকে উপস্থাপন করেছেন। বর্ষার বিচিত্র রূপ দিয়ে প্রকাশ করলেন দেবতার বন্দনাও।
‘মেঘের উপর মেঘ করেছে
রঙের উপর রঙ
মন্দিরেতে কাঁসর ঘণ্টা
বাজল ঠঙ ঠঙ।

বর্ষার এ সময়ের রূপের ভিন্নতাও যে থাকতে পারে, হিংস্রতাও হতে পারে, এর প্রমাণ বহুকাল ধরে আমরা পাচ্ছি জোয়ারে, প্লাবনে, বন্যাসহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে। সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, বানভাসি মানুষ, তারা গৃহপালিত পশু নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটাচ্ছেন। এমন সংকটকালে ঈদও উপস্থিত হচ্ছে। বর্ষাকালে নদীর পানি, পানির ঢলের অত্যাচারে মানুষ এই মুহূর্তে কীভাবে ঈদ উদযাপন করবে, তা ভাবার বিষয়ও বটে। শ্রেণি-সংগ্রাম, আর শ্রেণি-শোষণের সঙ্গে নিম্ন আয়ের মানুষ যে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করেও বেঁচে আছেন, তা কল্পনাতীত। তাও এটি তাদের অনেকটা সহনীয় হয়ে গেছে। পশ্চিম বাংলার কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় কিছুটা বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠেছে, কী যেন হারানোর ব্যথায় কাতর কবি! আশ্রয় চাইলেন বর্ষার বৃষ্টিকণায়…

‘আকাক্সক্ষা ছিল তোমাকে সাজাবো বৃষ্টিকণা
মনে হবে তুমি আকাশের মতো দূর বহুদূর
তখন জানি না বর্ষণে আছে কী যন্ত্রণা
বিচ্ছেদ আর লাগে না আমার তেমন মধুর’
বিচ্ছেদ/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীলের বরষায় বিচ্ছেদ বেদনা হয়তো রোমান্সধর্মী। তা ভাবতে হয়তো আনন্দও থাকতে পারে। কিন্তু বন্যায়, অতিবর্ষণে বানভাসী মানুষের ঈদ, আনন্দ বলতে কিছু থাকে? প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে আসা আমাদের বাংলাদেশি মানুষ এসব হয়তো সয়ে নিয়েছে। গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগি, ধান-চাল, মাছ-শাক-সবজি হারানোর বেদনায় তারা লীন। এরই মাঝে এসেছে ভোগের নয়, ত্যাগের ঈদ; গ্রহণ নয়, নিবেদনের ঈদ। নিজের প্রিয় পোষা প্রাণীকে কুরবানি করার মাঝে ত্যাগের যে শিক্ষা, তা এসব বানভাসী মানুষকে জীবন সংগ্রামে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহায্য করবে। কবি নজরুল তার ‘কুরবানী’ কবিতায় তেমন আবেগই ব্যক্ত করেছেন,

“ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।
দুর্বল! চুম রহো, ওহো খাম্খা ক্ষুব্ধমন!
ভীরু! ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,
আজিকার এ খুন কুরবানির!” কুরবানি/কাজী নজরুল ইসলাম

কবি নজরুল ঈদুল আজহাকে অভিহিত করেছেন শহীদী ঈদ, বকরীদ, ঈদুজ্জোহা, ছোট ঈদ নামে। কবিতায় তাই তিনি লিখলেন,

শহীদানদের ঈদ এলো বকরীদ!
অন্তরে চির নৌ-জোয়ান যে, তারি তরে এই ঈদ।
বকরীদ/কাজী নজরুল ইসলাম
কবি নজরুল পরম মমতায় ইসলামের বিজয় গাথা, আরবি-ফারসি গ্রন্থ অনুবাদ প্রভৃতির মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী মানবের কাছে প্রচার করেছেন। ঈদের আনন্দ প্রকাশ করতে তিনি ভুলে যাননি গ্রামের কৃষক, চাষা, ভুখা মানুষের কথা।

বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আশমানে
লুকাইআ আছ লজ্জার কোন মরুর গোরস্তানে!
হেরো ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত-কঙ্কাল
কসাইখানায় যাইতেছে দেখেছ শীর্ণ গোরুর পাল?
কৃষকের ঈদ/কাজী নজরুল ইসলাম

উত্তর আধুনিক কালের লেখক, প্রাবন্ধিক, কবিদের মাঝে দেখা যায়, ক্রুদ্ধ প্রকৃতির কাছে নিপীড়িত মানুষদের জন্য কলম ধরতে। প্রকৃতির খোলা আকাশের নিচে বাসকারী মানুষ, প্রাণিকুলের জন্য মঙ্গলপদ রচনা করতে। যদিও এই সংখ্যা আশাপদ নয়। এর সঙ্গে হতাশার বিষয় এই যে, বানবাসী মানুষকে নিয়ে উপন্যাস, ছোটগল্প এইকালে তেমন লক্ষ্য করা যায় না। সাংবাদিক কলাম লেখক স্বদেশ রায় লিখিত ‘ময়ফুলের মা’ উপন্যাসটি ব্যাপক পঠিত, প্রচারিত না হলেও বন্যা আক্রান্ত মানুষদের ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র এতে অংকিত হয়েছে। এ রকম অসংখ্য উপন্যাস, ছোটগল্প রচিত হতে পারে। এতে ঋদ্ধ হতে পারে শ্রমজীবী মানুষের সাহিত্য। জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার এক সাহিত্য সম্ভাষণে এমন ঈঙ্গিত করেছেন।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ- আমাদের এই ভাটি অঞ্চলকে নিয়ে রচিত অসংখ্য গানকে সুরকার, শিল্পীরা জনপ্রিয় করে তুলেছেন। যেগুলো ইতোমধ্যে কালোত্তীর্ণ হয়েছে, বাঙালির চিরদিনের গান হিসেবে আজীবন গীত হতে থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে গল্প, কবিতা, উপন্যাস রচিত হলে তা শ্রমজীবী, মাঝি, গাং, হাওরবাসীর হাতে না পৌঁছলে আমাদের বাঙালির ঐতিহ্যকে আরো ঋদ্ধ করবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ঈদের এই পূর্ব মুহূর্তে বানভাসি মানুষ কতটা অসহায়, আশ্রয়হীন, নিরন্ন তার পুনরোল্লেখ প্রয়োজন নেই। এই ত্যাগের, নিবেদনের ঈদে বানভাসি মানুষ আবার নিয়ত সংগ্রাম করার সাহস পাবে, দণ্ডায়মান হবে প্রকৃতির সামনে। বাংলার লোকগান আবার তাদের পুনরায় জাগরিত করবে। হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসে বানবাসে ঈদ আনন্দ নতুন কিছু নয়। গত শতাব্দীতেও অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছে ভয়াল থাবা নিয়ে, নিয়ে গেছে অগণিত প্রাণ। বাংলা সাহিত্যে যুগে যুগে কবিরা বর্ষা, প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে নিয়ত সাহিত্য সৃজন করছেন বহুমাত্রায়, ভিন্নরূপে। বানভাসির ঈদ হোক আনন্দময়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়