ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ : পরীমনির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসিরের ফের মামলা

আগের সংবাদ

কে কোথায় কুরবানি দিচ্ছেন

পরের সংবাদ

বাঙালির জীবনসংগ্রাম ও উৎসব

প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জাতি এমন এক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যখন দেশের বিভিন্ন জনপদ জলমগ্ন, কোথাও কোথাও বন্যার পানি সরে যাচ্ছে, কিন্তু হতদরিদ্র মানুষের জীবনে স্বস্তি নেই; নানান ব্যাধির সংক্রমণ হচ্ছে চারদিকে, অন্যদিকে আছে মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এবং চিকিৎসা সংকট; মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলো হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। এমন দুঃসময়ে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ আর ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি’ হয়ে দেশে করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি নতুন করে আবার শঙ্কায় আচ্ছন্ন করে তুলছে জাতির চিন্তাশীল মানুষকে। এক অর্থে উদ্বেগে তারা সবাই দিশাহারা; কিন্তু জনপদের বাস্তব চিত্রটা কী? পথে বেরুলে কি কেউ বুঝতে পারি, করোনা সংক্রমণ ভয়াবহতার দিকে মোড় নিচ্ছে? সহজ উত্তর- না। নিঃশঙ্ক সাধারণ মানুষ, আর উদ্বেগে রাতের ঘুম নষ্ট হওয়ার জোগাড়। সংবেদনশীল মানুষের এমন দিশাহারা মুহূর্তে সমাসন্ন দেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম সমাজের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ‘ঈদুল আজহা’। অতঃপর পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেই নিয়ে বিদ্যজনের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই! নিশ্চয়ই যার যার দুশ্চিন্তা নিরসনে প্রত্যেকে ভাববেন আর একটা মীমাংসায় পৌঁছাতে চাইবেন; বিদগ্ধজনের দুশ্চিন্তা নিয়ে আমার মতো অজ্ঞজন ভেবে কী লাভ হবে? তার চেয়ে আমি আমার দুশ্চিন্তাটি নিরসনের পথ খোঁজার চেষ্টা করি; আমার এই মুহূর্তের দুশ্চিন্তা দুঃখী মানুষের সংকটকালে আনন্দোৎসবকে কোন বিবেচনায় সমন্বয় করে সবার জন্য স্বস্তির বাতাবরণ উপস্থাপন করা যায়, সে পথ আবিষ্কারের চেষ্টা করা।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় যখন সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ কার্যক্রম চলছে, নানান জায়গায় সরকারি ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় গাফিলতি দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে; অন্যদিকে সরকারি প্রচার মাধ্যমে সরকারের নানান কার্যকর উদ্যোগের কথা শুনছি; এবং এসব বাস্তবতা আমাদের জীবনে নতুন কোনো ঘটনা নয়- সবাই জানি; আমি কিন্তু পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন মহলের বাদানুবাদে ঢুকতে চাইছি না; কিন্তু যখন শুনি, সংস্কৃতিকর্মীরাও না-কি ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে অনাচারে লিপ্ত; তখন আমি শঙ্কিত হই। কারণ আমার তখন মনে হয় জাতি আজ কতটা অধঃপতিত! সামাজিক মূল্যবোধের অধঃপতন যখন সংস্কৃতজনকেও গ্রাস করে, তখন পরিত্রাণের আলো কোন পথে আসবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় বৈকি! কেউ হয়তো আমার কথা শুনে কিছুটা বিচলিত, কেউ হয়তো বা ক্ষুব্ধ; কিন্তু আমি কোনো দুরভিসন্ধি নিয়ে কথাটা বলিনি; বরং লজ্জায় অধোবদন হয়ে বলছি, কিছু উৎসাহী তরুণ দুর্গত অঞ্চলে ত্রাণ দিতে গেছে, দেশের একটি প্রাগ্রসর সাংস্কৃতিক মোর্চার কতিপয় তরুণ হঠাৎ ঝোলা থেকে নিজেদের মোর্চার একটা ব্যানার বের করে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিলেন; নিজেদের ত্রাণ কার্যক্রম প্রচারের জন্য! কতটা অধঃপতন হলে একজন সাংস্কৃতিককর্মী এ ধরনের ন্যক্কারজনক ভূমিকায় লিপ্ত হতে পারে? প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি আমাকে যতটা বিচলিত করে; তার চেয়ে অনেক বেশি বিচলিত করে যখন সমাজের প্রাগ্রসরজনরা লোভ-মোহ-দলান্ধতা আর স্বার্থান্ধতায় নিমজ্জিত হয় তখন। কিন্তু বিচলিত হওয়ার পরক্ষণেই আমার বোধোদয় হয়, এ নিমজ্জনের বার্তাই শেষ কথা নয়। মনে হয় এ জাতির ছেলেরাই তো ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষার সম্মান রাখতে রাজপথ রঞ্জিত করেছে বুকের রক্ত দিয়ে; এই বাঙালিই তো ১৯৬৯-এ প্রত্যাখ্যান করেছে আইয়ুবের দুঃশাসনকে। এই জাতিই তো ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে, বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হতে জানে! ১৯৭১-এ এই বাঙালি জাতিরই ৩০ লাখ প্রাণ বুকের রক্ত দিয়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা! এই বাঙালি জাতি কি ১৯৮৮, ১৯৯৮-এ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা করেনি! বিশ্ব কি শোনেনি বাঙালির সংশপ্তক বীরের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনি, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’ যাঁর এক তর্জনীর মাথায় ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষ। বিশ্ব কি প্রত্যক্ষ করেনি ১৯৭৪-এ একজন দেশপ্রেমিক নেতা জাতিসংঘের সাধারণ সভায় মাতৃভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, কীভাবে স্বকীয়তা প্রদর্শন করতে হয়! আমি জানি নানান কৌশলে দুর্বৃত্তের অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে শুদ্ধতার আঙিনায়। স্বার্থলিপ্সায় তারা ব্যাধি ছড়াচ্ছে সমাজের সর্বত্র! তারা তৎপর থাকছে ঘোলাজলে মাছ শিকারে-
যাকে যেখানে মানায় সেখানে সে থাকে কই বল্?
থাকে না মানে কী?
আসলে সেখানে চলে তার উচ্ছেদের যত ছল!
যারা গাছেরও খায় তলার কুড়ায়
তাদের তো ছালাশুদ্ধো আম চাই হাতে
ভাগ-বাটোয়ারা যাই হোক মাছের মুড়োটা চাই পাতে;
স্বঘোষিত নির্বাসিত অর্থশাস্ত্রবিদ থেকে গুম-কলা বিদ্যায় পণ্ডিত
মুখে ফ্যানা তুলে তুখোড় বক্তিমা দিয়ে দীর্ঘকাল যারা করেছেন হিত,
গলার দাপট আর মূর্খ করতালি পেয়ে শূন্য পোস্টে করে গোল
এবং তাদের পকেটে রয়েছে কতিপয় অন্ধ হট্টগোল।
তাত্ত্বিক-ভঙ্গিতে সারাক্ষণ প্রলেতারিয়েতের সপক্ষে বলে
সুযোগ পেলেই দরিদ্রের রক্ত চোষে সুকৌশলে।

সত্যি সেলুকাস, চেয়ে দেখো জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার’
অন্ধেরা প্রজ্ঞার আলো ক’রে চলে নির্বিঘেœ পাচার,
মূর্খের জিহ্বায় প্রাজ্ঞজন শোনে অসভ্য-অশ্লীল আস্ফালন
পর্দার আড়ালে মাংসের সুরুয়া-রুটি খেয়ে প্রকাশ্যে শোনায় গণ-অনশন;
অতঃপর বন্ধু গোলাম হোসেন নতুন যুদ্ধের সবাই প্রস্তুতি চায়
যদিও মীরজাফর-উমিচাঁদ-জগৎশেঠ-রায় দুর্লভ জন্মাবে এ বাংলায়
অর্থশাস্ত্রবিদ বঙ্গীয়-পণ্ডিত কিংবা নিরালোক মাদ্রাসায়।
বানরের পিঠাভাগে-প্রতারণা বারবার মুক্তিরাকাক্সক্ষা সুদূরে মিলায়!
(ঘোলাজলে মৎস্য শিকার \ ফরিদ আহমদ দুলাল)

আমাদের সরলতা আর বিশ্বাসের মাথায় পা দিয়ে নানান কৌশলে তারা ছড়াচ্ছে বিদ্বেষ! নষ্ট করতে চাইছে সম্প্রীতি! মুখোশের আড়ালে দুর্বৃত্ত মুখটা লুকিয়ে ওরা হয়ে উঠতে চায় সংস্কৃতিকর্মী! তারা ভুলে যায় এ দেশ লোকসংস্কৃতি আর লোকগানের দেশ। এ দেশের কবিই বলতে পারেন-
‘নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত!’
এই বাংলার কবিই উচ্চারণ করতে পারেন- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ তাই তো বাংলার সাধক লালন বলেন- ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি…’ আমরা জানি ওইসব দুর্বৃত্ত সংস্কৃতিকর্মীর মুখোশ পরে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়াবার চেষ্টায় আছে।
শাশ্বত বাংলার লোকসংস্কৃতি কী? বাঙালি আনন্দে গান গায়, বিষাদে সুর করে কাঁদে, উৎসবে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করে গানে গানে। আসুন তাকিয়ে দেখি বাংলার লোকউৎসবের দিকে-
বঙ্গজনপদে গানের প্রধান অনুষঙ্গ লোকসংগীত; আর বিশ্বসংগীত বিবেচনায় গানের আশ্রয় ধ্রæপদ সংগীত। আধুনিক গান লোকগানের কথা ও সুরের সঙ্গে ধ্রæপদের ছোঁয়া নিয়ে জনসমক্ষে উপস্থাপিত হয়। লোকজীবনের সঙ্গে লোকসংগীতের ঘনিষ্ঠ সংযোগের কারণেই হয়তো দেখতে পাই, আজো আমাদের গানে লোকসংগীতের প্রবল প্রভাব। বাংলাদেশে প্রচলিত লোকসংগীতের সবক’টি ধারা দেশের সর্বত্র প্রচলিত নয়; আবার একই আঙ্গিকের গান বিভিন্ন অঞ্চলে হয়তো ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে গীত হয়। তবে কিছু কিছু গান কোন কোন অঞ্চলকেই প্রতিনিধিত্ব করে; যেমন ঘাটুগান-গাইনের গীত-সঙযাত্রা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল, ভাওয়াইয়া গান বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল, গম্ভীরা গান রাজশাহী অঞ্চলের কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রচলিত লোকসংগীতের প্রতিটি শাখাই ভাব, বিষয়, উপস্থাপনা এবং লোকপ্রিয়তায় অনন্য হওয়ার পরও আজকের স্যাটেলাইট সংস্কৃতির আগ্রাসী বিস্তার এবং জীবনযাপনের নানা টানাপড়েনে লোকসংগীতের বেশকিছু শাখাই আজ বিলুপ্ত এবং অধিকাংশ শাখাই বিপন্ন প্রায়। বঙ্গজনপদের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত লোকসংগীতগুলোর অন্যতম-
বাউলগান, ভাটিয়ালী, কিস্সাপালা, কবিগান, কীর্তন, ঘাটুগান, জারিগান, সারিগান, মুর্শিদি, ধামাইল গান, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, ঢপযাত্রা, সঙযাত্রা, বিয়ের গান, মেয়েলীগান, বিচ্ছেদী গান, বারমাসী, পুঁথিগান, পালকির গান, ধামাইল গান, ধানকাটার গান, ধানভানার গান, হাইট্টারা গান, গাইনের গীত, বৃষ্টির গান, ধোয়া গান, শিবগৌরীর নৃত্য-গীত, গাজীর গান, পটগান, আদিবাসীদের গান ইত্যাদি। লক্ষ করলেই দেখা যাবে বাংলার এসব লোকগানের অধিকাংশই দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। এ আলোচনা দীর্ঘায়িত না করে এক কথায় বলতে চাই, বাঙালি আনন্দে যেমন গাইতে জানে, বিষাদেও গাইতে জানে; উৎসবে যেমন গাইতে জানে, তেমনি বেদনায় ডুবেও উৎসব করতে জানে। সমস্ত দুর্যোগে বাঙালি সংগ্রাম করতে জানে।
‘অবাক পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ তবু মাথা নোয়াবার নয়!’
বাঙালি মাথা নোয়ায় না, সে কথা বারবার প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ। সুনামিতে সব তছনছ হয়ে গেছে, জীবনের চিহ্ন সব মুছে দিয়ে গেছে সুনামি, তারপরও ঘুরে দঁাঁড়িয়েছে বাঙালি। এই তো সেদিন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে; বাঙালির নেতা দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন- ‘আমরা নিজের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবো!’ আজ দৃশ্যমান পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুর ওপর গাড়ি চলছে।
আমি জানি আজ সমস্ত দুর্যোগের মধ্যেও সংগ্রামী বাঙালি নিজেদের উৎসব পালন করবে নিজেদের মতো করে! নিজেদের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। নাগরিক সুশীল সমাজ গ্রামবাংলার মানুষকে অজ্ঞ-অযোগ্য ভাবতে পারেন; কিন্তু আমরা যেন এটা ভুলে না যাই, লোকবাংলার মানুষে লোকজ্ঞান আর জীবন-প্রকৃতি পাঠের যে প্রজ্ঞা, তা স্বতন্ত্র; প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলেও অনেকেই জানে না প্রকৃতির বাস্তবতা কী; সুতরাং প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর সংকটে বাংলার মানুষ সাহস নিয়ে, বুক পেতে দাঁড়াতে জানে। এ সাহস বাঙালি অর্জন করেছে জীবন সংগ্রাম থেকে; আর বাঙালির সেই সাহসকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছে ১৯৭১-এর যুদ্ধ। সরকার-প্রশাসন আর সচেতন মানুষ লক্ষ রাখবেন, স্বার্থান্ধ ষড়যন্ত্রকারীরা যেন কোনোভাবেই ঘোলা পানিতে মাছ ধরার সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারে; যারা সংকটে আছেন তাদের জন্য বরাদ্দ যেন তছরুপ না হয়ে যায়। যারা দুর্ভাবনায় আছেন বন্যা আর করোনা নিয়ে, তারা নিশ্চিত জানবেন, সব বাধাই ডিঙিয়ে যাবে বাঙালি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়