ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ : পরীমনির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসিরের ফের মামলা

আগের সংবাদ

কে কোথায় কুরবানি দিচ্ছেন

পরের সংবাদ

বাংলা ছোটগল্পে বর্ষা-বালাই

প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঋতু হিসেবে বর্ষা-বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে কম নয়। বর্ষা বাংলার নিজস্ব ঋতু। রবীন্দ্রনাথ একাই বর্ষার নানা রূপ-অঙ্কন করেছেন। সে রূপ কখনো রুদ্র কখনো পেলব। সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসের মেঘ মানুষের কথা বুঝতেন। মানুষের সুখ-দুঃখে উদ্দীপনায় সাড়া দিতেন। দূতালি হিসেবে মেঘের একটি ভূমিকা ছিল। বন্দি যক্ষের মনবেদনা, বিরহকাতর বাণী বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন উজ্জয়িনীপুরে। রামগিরি পর্বতকে আশ্রয় করে যে মেঘ ঘনীভূত হয়েছিল, সেই রামগিরি গুহায় বন্দি যক্ষ, তার মনোবেদনা মেঘ ছাড়া কে বুঝবে! আকাশে মেঘ করলে মানব মনের পরিবর্তন ঘটে। মেঘ দেখলে প্রিয়তমের কথা মনে পড়ে, বিরহবেদনা জেগে ওঠে। দক্ষিণ থেকে ভেসে আসা উত্তর-মেঘ দেখে উজ্জয়িনীর মনেও প্রিয় বেদনা জেগে।
রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘আমরা প্রত্যেকে নির্জন গিরিশৃঙ্গে একাকী দণ্ডায়মান হইয়া উত্তরমুখ চাহিয়া আছি- মাঝখানে আকাশ এবং মেঘ, এবং সুন্দরী পৃথিবীর রেবা-শিপ্রা, অবন্তী-উজ্জয়িনী, সুখ-সৌন্দর্য-ভোগ-ঐশ্বর্যের চিত্রলেখা, যাহাতে মনে করাইয়া দেয়, কাছে আসিতে দেয় না; আকাক্সক্ষার উদ্রেক করে, নিবৃত্তি করে না। দুটি মানুষের মধ্যে এতটা দূর।’ বর্ষার রূপগুণ সম্বন্ধে যা কিছু বক্তব্য সংস্কৃত সাহিত্যে, কালিদাস তার প্রায় সবখানি বলে গেছেন। যা বাকি ছিল তা আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বর্ষার ভীম মূর্তি ও কান্ত মূর্তি উভয় রবীন্দ্রনাথের চোখে ধরা পড়েছে। বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে মানব প্রকৃতির যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যে তার প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ নববর্ষার দিনে বিষয়-কর্মের ক্ষুদ্র সংসারকে যক্ষের মতো নির্বাসন হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তার মনে হয়েছে প্রভুর অভিশাপেই যেন আমরা এখানে বন্দি হয়ে আছি। বর্ষার মেঘ এসেই আমাদের বাইরে যাওয়ার আহ্বান জানায়।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প, রবীন্দ্রনাথের কবিতা এমনকি উপন্যাসেও বর্ষার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বিশ্বকবির জীবনের অনেকখানি সময় কেটেছে নদীতে, নৌকায়, পদ্মার বুকে যে কারণে বর্ষার সঙ্গে তার আলাদা সখ্য গড়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে বর্ষা ততটা পেলব না, যতটা কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের গল্প ‘পোস্টমাস্টার’। কলকাতার ছেলে পাড়াগাঁয়ে এসেছে পোস্টমাস্টারি করতে। রবীন্দ্রনাথ ঘোর বর্ষায় এ গল্পটি লিখেছিলেন তার প্রমাণ আছে। ১৮৯২ সালের ২৯ জুন তিনি সাজাদপুর থেকে লিখছেন, ‘যখন চিঠিতে লিখছিলাম কাল ৭ চ.গ’র সময় কবি কালিদাসের সঙ্গে একটা এনগেজমেন্ট করা যাবে। বাতিটি জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে মাস্টার এসে উপস্থিত… এই লোকটির সঙ্গে আমার একটু বিশেষ যোগ আছে। যখন আমাদের এই কুঠিবাড়ির এক তলাতেই পোস্ট অফিস ছিল এবং আমি একে প্রতিদিন দেখতে পেতুন, তখনি আমি একদিন দুপুরবেলায় এই দোতলায় বসেই পোস্টমাস্টারের গল্পটি লিখেছিলুম।’ পোস্টমাস্টারের যেমন একটি বাস্তবতা আছে, রতনেরও তেমন একটা বাস্তবতা আছে। সাজাদপুরের অনেকেই রতনের উত্তমপুরুষের খোঁজ দিয়ে থাকেন। গল্পের বাস্তবতা অত জরুরি নয়। রূপদক্ষ শিল্পীর হাতে কাহিনী পায় তার আপন স্ফূর্তি। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপ্রকৃতিকে এমন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং প্রকৃতির বিচার থেকেই তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক দার্শনিক চেতনা।
কলকাতার ছেলে পোস্টমাস্টার পাড়াগাঁয়ে এসে তার শরীর-মন টিকছিল না। এর মধ্যে বর্ষাকালে জ্বর বাধিয়ে বসল পোস্টমাস্টার। বিদেশ বিভূঁইয়ে রোগে-শোকে শুশ্রƒষা করার মতো কোনো আপনজন তার কাছে ছিল না। প্রিয়জন বলতে কেবল রতন নাম্নী লেখাপড়া না জানা পাড়াগাঁয়ের এক কিশোরী, যে পোস্টমাস্টারের প্রাত্যহিক কাজে সহযোগিতা করে থাকে। পোস্টমাস্টার অবসর সময়ে তাকে অক্ষর যুক্তাক্ষর শেখায়। সেই কিশোরী রতনই পোস্টমাস্টারের অসুস্থতার সময়ে তার প্রিয়জন ও মাতৃপদ অধিকার করে বসে। রতনের শুশ্রƒষায় পোস্টমাস্টর সেরে ওঠে। সেরে ওঠার পর পোস্টমাস্টার চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু বালিকা রতন পোস্টমাস্টারকে ভুলতে পারে না। এখানে পোস্টমাস্টার কহিলেন, রতন কালই আমি যাচ্ছি।
রতন : কোথায় যাচ্ছ, দাদাবাবু।
পোস্টমাস্টার : বাড়ি যাচ্ছি।
রতন : আবার কবে আসবে?
পোস্টমাস্টার : আর আসব না।
রতন আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না। পোস্টমাস্টার আপনিই তাহাকে বলিলেন, তিনি বদলির জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলেন, দরখাস্ত না মঞ্জুর হইয়াছে; তাই তিনি কাজে জবাব দিয়া বাড়ি যাইতেছেন। অনেকক্ষণ আর কেহ কথা কহিলেন না। মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং একস্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার ওপর টপটপ করিয়া বৃষ্টির জ্বল পড়িতে লাগিল।’
এখানে রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টি বালিকা রতনের মনের জীর্ণ অবস্থার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। ‘মাটির সরার ওপর বৃষ্টির জল টপটপ করিয়া পড়িতে লাগিল’। এরপর পাঠকের আলাদা করে রতনের চোখের জল দেখার আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। এ গল্পের শেষটাও একটু উদ্ধার করতে চাই-
পোস্টমাস্টার ‘যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষা বিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রæরাশির মতো চারিদিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন- একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুৎ সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি-কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে- নদী প্রবাহের ভাসমান পথিক উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কি। পৃথিবীতে কে কাহার।’
রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ কিংবা ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনে’র কথা পাঠকের মনে আছে। এসব গল্পের প্রকৃতিও বর্ষা। রবীন্দ্র মানসে বর্ষা একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল। সেই বর্ষা কেবল তার বাহ্যিক রূপ-বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলা সাহিত্যে প্রায় সর্বত্র আমরা বর্ষা দেখতে পাই। কিন্তু সে বর্ষা কেবল ঋতু বর্ণনার মধ্যে, বাহ্যিক সৌন্দর্য কিংবা দুর্ভোগ বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বর্ষা মানব প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। বর্ষাও আরেকটি চরিত্র পদ অধিকার করেছে।
অতিথি গল্পের কিশোর তারাপদ এক উদাসীন পথিক। ভব-সমুদ্রে কোনো মায়ার বাঁধন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াবার আগেই সে সব বন্ধন কেটে উদাসীন পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়ে। এমনকি স্নেহের বন্ধনও তার সয় না। তার জন্ম নক্ষত্রই তাকে গৃহহীন করে দিয়েছে। এক বর্ষার প্রমত্ত নদীতে কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিবাবু ও তার পরিবারের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছিল। এর আগে বহু দলের সঙ্গে তারাপদ ভিড়ে গিয়েছিল কিন্তু কেউ তাকে পুরোপুরি অধিকার করতে পারেনি। সংসারের পঙ্কিল জলের ওপর শুভ্রপক্ষ রাজহাঁসের মতো সাঁতার দিয়ে বেড়ানোই তার স্বভাব। নিত্যসচনা প্রকৃতির মতো সর্বদাই নিশ্চিন্ত উদাসীন। এই কিশোর তারাপদ জমিদার বাবুর মেয়ে চারুশশীসহ একদিন কাঁঠালিয়ার সমস্ত গ্রামখানির হৃদয় জয় করে ফেলল। জমিদার বাবু তার মেয়ে চারুশশীর সঙ্গে তারাপদের বিষয়ে আয়োজন করলো। কিন্তু বর্ষার দুষ্টগ্রহ তারাপদকে কোনো ঘাটেই নোঙ্গর করতে দিল না।
‘শ্রাবণ মাস বিবাহের দিন স্থির করিয়া মতিবাবু তারাপদের মা ও ভাইদের আনিতে পাঠাইলেন। আকাশে নববর্ষায় মেঘরাশি প্রকাণ্ড কালো পাল তুলিয়া দিয়া আকাশের মাঝখানে উঠিয়া পড়িল, চাঁদ আচ্ছন্ন হইল পূর্বে-বাতাস বেগে বহিতে লাগিল, মেঘের পশ্চাতে মেঘ ছুটিয়া চলিল, নদীর জল খলখল হাস্যে স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল- নদী-তীরবর্তী আন্দোলিত বনশ্রেণির মধ্যে অন্ধকারকে চিরিতে লাগিল। সম্মুখ আজ যেন সমস্ত জগতের রথযাত্রা-চাকা ঘুরিতেছে, ধ্বজা উড়িতেছে, পৃথিবী কাঁপিতেছে, মেঘ উড়িয়াছে, বাতাস ছুটিয়াছে, নদী বহিয়াছে, নৌকা চলিয়াছে, গান উঠিয়াছে; দেখিতে দেখিতে গুরুগুরু শব্দে মেঘ ডাকিয়া উঠিল, বিদ্যুৎ আকাশকে কাটিয়ে কাটিয়ে ঝলসিয়া উঠিল, সুদূর অন্ধকার হইতে মুঘলধারাবর্ষি বৃষ্টির শব্দ আসিতে লাগিল। কেবল নদীর এক তীরে একপার্শ্বে কাঁঠালিয়া গ্রাম আপন কুঠির দ্বারা বন্ধ করিয়া দীপ নিবাইয়া দিয়া নিঃশব্দে ঘুমাইতে লাগিল।… কিন্তু পরদিন তারাপদকে দেখা গেল না। স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্র বন্ধন তাহাকে চারিদিক হইতে সম্পূর্ণরূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরিয়া করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাক্ষণবালক আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে।’
খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন গল্পের আখ্যান বর্ণনার বর্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের বর্ষা রবীন্দ্রনাথকে উন্মাতাল করে তুলেছিল। বর্ষায় পদ্মার জলে খোকাবাবুর অন্তর্ধান আর রাইচরণের নিজের ছেলেকে খোকাবাবুর স্থলে অধিষ্ঠান-প্রকৃতির নির্মোহতার প্রমাণ। খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন থেকে কিছুটা উদ্ধার করা যাক।
‘বর্ষাকাল আসিল। ক্ষুধিত পদ্মা উদ্যান গ্রাম শসাক্ষেত্র এক এক গ্রাসে মুখে পুরিতে লাগিল। বালুচরের কাশবন ও ঝাউবন জলে ডুবিয়া গেল। পাড় ভাঙার অবিশ্রাম ঝুপঝাপ শব্দ এবং জলের গর্জনে দশদিক মুখরিত হইয়া উঠিল, এবং দ্রুতবেগে ধাবমান ফেনরাশি নদীর তীব্রগতিতে প্রত্যক্ষগোচর করিয়া তুলিল। …তাহাতে শিশুর মন কদম্বফুল হইতে প্রত্যাবৃত হইয়া সেই মুহূর্তে জলের দিকে ধাবিত হইল। দেখিল জল খলখল ছলছল করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে; যেন দুষ্টামি করিয়া কোন এক বৃহৎ রাইচরণের হাত এড়াইয়া এক লক্ষ শিশুর প্রবাহ সহাস্য কলম্বরে নিষিদ্ধ স্থানাভিমুখে দ্রুতবেগে পলায়ন করিতেছে।…দুরন্ত জলরাশি অস্ফুট কলভাষায় শিশুকে বারবার আপনাদের খেলাঘরে আহ্বান করিল। …একাবর ঝুপ করিয়া একটা শব্দ হইল, কিন্তু বর্ষার পদ্মার তীরে এমন শব্দ কত শোনা যায়।’
তবে রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পে বর্ষা সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে ধরা পড়েছে। যে সুরবালা একদিন গল্পের নায়কের ‘কি না হইতে পারিত’। সেই সুরবালাকে মাত্র একরাত্রির জন্য কাছে পেয়েছিলেন তিনি। এটিই তার জীবনের পরম পাওয়া আর এটি সম্ভব হয়েছিল ঝড় বৃষ্টির মহা দুর্যোগের রাতের বদান্যে। ঝড় বৃষ্টিই এখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। কেবল অনুঘটক নয় ঘটক বললেও কম বলা হয় না। সেদিন সোমবার। সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। বেলা ১০টা হতে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ যেন মহা-আয়োজনে আকাশময় আনাগোনা করতে লাগল। তার পরদিন বিকালের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি ওবং ঝড়ের বেগ বাড়তে লাগলো। তার মনে পড়লো এই দুর্যোগের রাত্রে সুরবালা একা আছে। রাত্রি যখন একটা দেড়টা। বানের ডাক শোনা গেল। ঘর থেকে বের হয়ে পুকুরের পাড়ের দিকে এগোতে থাকলো। বিপরীত দিক থেকে সুরবালাও বাধের দিকে এগিয়ে আসলো। ‘তখন প্রণয়কাল’ তখন আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গিয়াছে- তখন একটা কথা বলিলেও ক্ষতি ছিল না- কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেউ কাহাকেও একটা কুশল প্রশ্নও করলো না। কেবল দুইজনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিল। পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যু স্রোত গর্জন করিয়া ছুটিয়া চলিল।’ কালিদাসের মেঘ যক্ষকে সশরীরে উজ্জয়িনীর দ্বারপ্রান্তে নিতে পারেনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মেঘ মেদুর বর্ষা নায়ককে নায়িকার নিকটস্থ করতে পেরেছিল। বাংলার গ্রাম জীবন বর্ণনায় শরৎ সাহিত্যের জুড়ি মেলা ভার। শরৎ সাহিত্যের বিভিন্ন কন্দরে বৃষ্টির স্নিগ্ধতা লেগে আছে। এমনকি ইন্দ্রের সঙ্গে শ্রীকান্তের পরিচয় এবং মাছ চুরির ঘটনা এসবও ঘটেছিল বর্ষাকালে। ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে অসুস্থ মহিমকে একা ফেলে অচলাকে নিয়ে সুরেশ অন্য গন্তব্যে চলে গিয়েছিল সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিল। ‘অচলার দুই চোখে ঘুম তখনো জড়াইয়াছিল, কিন্তু তাহার মনে পড়িল, এলাহাবাদ স্টেশনে জব্বলপুরের গাড়ি বদল করিতে হইবে।….কিন্তু এত জলের মধ্যে তাকে নামাবে কী করে? এখানে পালকি টালকি কিছু পাওয়া যায় না? নইলে অসুখ যে বেড়ে যাবে সুরেশবাবু। সুরেশ কি যে জবাব দিল, জলের মধ্যে তাহা বুঝা গেল না। …আকাশের বৃষ্টি ছাড়া গাড়ির ছাদ হইতে জল ছিটাইয়া তাহার চোখে-মুখে সুচের মত বিঁধিতেছিল।’ শরতের নায়ক নায়িকারা অধিকাংশই গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে এসেছে। সুতরাং এই রূপদক্ষ শিল্পীর হাতে বর্ষার স্বাভাবিক বর্ণনা এক নবরূপে প্রতিভাত হয়েছে। বর্ষার গল্প হিসেবে তারাশঙ্করের তারিণী মাঝি এক অনবদ্য সৃষ্টি। এছাড়া নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোতে বর্ষার একটি স্বভাবিক চিত্র লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে, পদ্মা নদীর মাঝি, তিতাশ একটি নদীর নাম, নদী বক্ষে কিংবা কাশবনের কন্যা এসব উপন্যাসে বর্ষা একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে।
বাংলা সাহিত্যে বর্ষার কথা বললেই রবীন্দ্রনাথের পরে বিভূতিভূষণের কথা আসে। তবে বিভূতির বর্ষা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভয়ঙ্কর। ‘অনেক রাত্রে সর্বজায়ার ঘুম ভেঙে যায়-অপু ডাকিতেছে-মা, ওমা ওঠো- আমার গায়ে জল পড়ছে-সর্বজায়া উঠিয়া আলো জ্বালে-বাহিরে ভয়ানক বৃষ্টির শব্দ হইতেছে। ফুটা ছাদ দিয়া ঘর সর্বত্র জল পড়িতেছে। সে বিছানা সরাইয়া পাতিয়া দেয়। দুর্গা অঘোর জ্বরে ঘুমাইয়া আছে-তাহার মা গায়ে হাত দিয়া দ্যাখে তাহার গায়ের কাঁথা ভিজিয়া সপ সপ করিতেছে। …আতঙ্কে সর্বজায়া দোর বন্ধ করিয়া দিল’ ভয়াল রাতের সর্ব রকম দুশ্চিন্তা সর্বজায়ার মনে উঁকি দিতে লাগলো। দুর্গা অসুস্থ, অনেক দিন হলো হরিহর বাড়ি নেই, হাঁড়িতে চাল বাড়ন্ত। তার একার পক্ষে সবকিছু সামাল দেয়া কি করে সম্ভব। ‘জলের ছাটে ঘর ভাসিয়া যাইতেছে… হাত দিয়া দেখিল ঘুমন্ত। পুর গা জলে ভিজিয়া ন্যাতা হইয়া যাইতেছে…সে কী করে? আর কত রাত আছে? সে বিছানা হাতরাইয়া দেশলাই খুঁজিয়া কেরোসিনের ডিবাটা জ্বালায়। …অপুর মুখে উদ্বেগের চিহ্ন। বলিল, দিদি কী সব বকছিল জেঠামশাই। সর্বজায়া ভাসুর সম্পর্কের প্রবীণ প্রতিবেশীর ঘরের মধ্যে উপস্থিতি ভুলিয়া গিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল- ওগো কি হলো, মেয়ে ওমন করছে কেন? দুর্গা আর চাহিল না।’ বর্ষা বাঙালির নিজস্ব ঋতু হলেও এ ঋতু সব সময় আনন্দ বয়ে আনে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়