ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ : পরীমনির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসিরের ফের মামলা

আগের সংবাদ

কে কোথায় কুরবানি দিচ্ছেন

পরের সংবাদ

গাছের ছায়ায় গণকবর

প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভীষণ যুুদ্ধ চারদিকে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। গাঁয়ের মানুষেরা রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনেছে। পঁচিশের রাতের গণহত্যার খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে গ্রামবাসী। মেহেরুন্নেসা বাড়ির বাইরে এসে চারদিকে তাকায়। বুঝতে পারে শান্ত নিরিবিলি এই গ্রামে যুদ্ধের দামামা বাজবে। মানুষ স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রাখবে। মেহেরুন্নেসার কানে ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের শেষ লাইনটি, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ওহ, কত লম্বা একটা লাইন। সারাদেশের সমান। নিজেকে উৎফুল্ল করে ও। ভাবে, স্বাধীনতা দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
নিজের কপালে হাত রেখে বাবার কথা মনে করে। বাবা বেঁচে থাকলে যুদ্ধ করত। বাবা ঘরে বসে থাকত না। এই গ্রামের মানুষ ওর বাবাকে মান্য করতো। বলতো, হামিদ মিয়া এই গ্রামের গর্ব। এই গ্রামের মানুষের জন্য কত কিছু করে। যে বিপদে পড়ে তাকে সাহায্য করে।
মেহেরুন্নেসা রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ায়। মাছিমপুর গ্রামটি সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকায়। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায় বিশাল পাহাড়। সবুজ হয়ে আছে চারদিক। দৃষ্টি জুড়িয়ে যায় মেহেরুন্নেসার। ভাবে, একদিন ওই পাহাড়ে উঠতে যাবে। গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের বলবে, চল পাখিদের গ্রাম থেকে ঘুরে আসি। ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে বলবে, পাখিদের গ্রাম আবার কি?
-কেন ওই পাহাড়ের চূড়া।
-বাব্বা অত উঁচুতে উঠতে পারবি?
-কেন পারবো না? সঙ্গে গুড়-মুড়ি নিয়ে যাবো। পাহাড়ের গায়ে ঝর্ণা আছে। আঁজলা ভরে পানি খাব। ক্লান্ত হলে গাছের নিচে ঘুমিয়ে নেবো। পারবি না?
তখন ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলবে, খুব পারবো। পাখিদের বাড়িঘর কেমন রে মেহের?
-আমি তো দেখিনি। পাহাড়ে উঠলে ঠিকই দেখতে পারবো।
ছোটবেলায় পাহাড়ের ওঠার যে স্বপ্ন ছিল এখন আর সে স্বপ্ন নেই মেহেরুন্নেসার। তবে সে সময়ে ওরা ভারতের সীমান্ত পার হয়ে দৌড়ে ওপাশে চলে যেত। পাহাড়ের পাদদেশে কিছুক্ষণ দৌড়ঝাঁপ করে, বুনোফুল তুলে আবার ফিরে আসতো। মাঝে মাঝে সীমান্ত রক্ষীরা তাড়া করে ভয় দেখাতো। ওরা এক দৌড়ে নিজেদের মাটিতে এসে হাত নেড়ে ওদের বিদায় জানাতো। সৈনিকরা হাতের বন্দুক তুলে হাসিমুখে ওদের সঙ্গে মজা করতো। ও এখন বড় হয়েছে। সেইসব দিন আর নেই। পাহাড়ের দিকে তাকালে সেইসব দিন মনের পটে ভেসে ওঠে।
এখন এই এলাকাটাকে মৃত্যুপুরী মনে হয় ওর। চারদিকে যুদ্ধের ডামাডোল। মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে। মা ওদের নিয়ে ভয়ে চৌকির নিচে ঢুকিয়ে দেয়। এক সময় গোলাগুলি থামলে বেরিয়ে আসে। মর্টার আর গোলার শব্দে ঝমঝম করে চারদিক। মেহেরুন্নেসার মনে হয় এই একটি শব্দ ছাড়া এই গ্রামে এখন আর কোনো শব্দ নেই। পাখির ডাকও না। মানুষের হাসি-কান্নার শব্দও বুঝি নেই।
একদিন ওর বড়ভাই আক্কাস নৌকায় করে বাড়ি ফিরছিল। নৌকায় আট-দশ জন যাত্রী ছিল। মাঝিসহ এগারজন। নৌকা তীরে পৌঁছা মাত্রই গোলার শেল এসে পড়ে। সবাই মারা যায়। আশপাশের লোকজন ধরাধরি করে লাশ নিয়ে আসে বাড়িতে। আক্কাসকে ঠিকমতো চেনা যাচ্ছিল না। ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল বুক-পিঠ। উড়ে গিয়েছিল মাথার একাংশ। একটা পা’ও বিধ্বস্ত। মেহেরুন্নেসা ভাইয়ের শরীরের এই অবস্থা দেখে ভাবে, যুদ্ধ একটা দানব। তারপরও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য গ্রামের ছেলেরা দলে দলে সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছে। ও বুঝে গেছে যুদ্ধে মারা গেলে তাদেরকে শহীদ বলা হয়। কারণ তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে। স্বাধীনতা মানে বোঝার জন্য মেহেরুন্নেসা অনবরত নিজের সঙ্গে লেখাপড়া করে। সবার কাছ থেকে বুঝতে চায়। সবার কথা শুনে নিজের বোঝার সঙ্গে মেলায়। এভাবে যুদ্ধের সময় আলোকিত করে রাখে মেহেরুন্নেসাকে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ার পরে ওর আর পড়ালেখা করা হয়নি। বাবা অসুখে মারা যায়। মা বলে, দূরের স্কুলে পাঠাব না। ঘরের কাজকাম শেখ। ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দিব।
মেহেরুন্নেসা মাঝে মাঝে মন খারাপ করে, হায় বিয়া! এখন শুধু বিয়ার জন্য দিন গোনা। ও ঠিক করে এই যুদ্ধের সময় ও বিয়ের কথা ভাববে না। ও নিজেও যুদ্ধ করবে। অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করতে না পারলে সাহস দিয়ে যুদ্ধের কাজের সঙ্গে থাকবে। সেটাও হবে যুদ্ধ। এমন ভাবনায় মগ্ন হয়ে ও নিজেকে উৎফুল্ল করে। শক্তি পায় নিজের ভেতরে। ভাবে, ভাইসহ সবাইকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে সেই কবরে প্রতিদিন ফুল দেবে। একদিনও বাদ যাবে না। দেশের জন্য যারা জীবন দেয় তাদেরকে তো মনে রাখতে হয়।
গ্রামের তারা মিয়া বলেছে, তোর ভাই শহীদ হয়েছে। দেশের জন্য জীবন দিয়েছে।
-শহীদ? আমার ভাই শহীদের মৃত্যু-
-দেশ স্বাধীন হলে তোর পরিবার শহীদ পরিবার হবে। দেখিস তোর মাকে শহীদ জননী বলা হবে।
-ওহ, আল্লাহরে, আমার মায়ের জীবন ধন্য হবে।
তারা মিয়ার কথা শুনে মেহেরুন্নেসা নিজেকে উজাড় করে ভরে তোলে স্বাধীনতার স্বপ্নে। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তারা মিয়ার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, চাচা আমিও যুদ্ধে থাকব।
-হ্যাঁ থাকবিতো। সবাইকে যুদ্ধে থাকতে হবে। স্বাধীনতা পাওয়া কি সহজ কথা!
তারা মিয়া দুহাত উপরে তুলে বলে, সেদিন নৌকায় ছিল যারা সবাই জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে নদী মাতিয়ে তুলেছিল। ওরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল।
-আমরা আমাদের গ্রাম মাতিয়ে তুলব। কেউ আমাদেরকে বাধা দিতে পারবে না।
-তোরে আল্লাহ রহম করুক রে মাইয়া।
তারা মিয়া ওর মাথায় হাত রেখে চলে যায়।
বাড়ি ফিরে মেহেরুন্নেসা রান্নাঘরে ঢুকে মাকে বলে, আপনি আমাদের শহীদ জননী মাগো। আপনার ছেলে জয় বাংলা বলতে বলতে মরে গেছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে মাগো।
আশরাফুন্নেসা আঁচলে মুখ ঢাকে। ফোঁপাতে থাকে। শরীরে কাঁপুনি উঠলে মেহেরুন্নেসা মাকে হাত ধরে টেনে ওঠায়।
-বাইরে আসেন মাগো। চুলার ধারে থাকা লাগবে না।
বারান্দায় বসে চিৎকার করে কাঁদে আশরাফুন্নেসা। তোলপাড় ওঠে কান্নার শব্দে। চারদিক থেকে অনেকেই কাছে এসে দাঁড়ায়। ফারুক বলে, আক্কাস ভাই শহীদ হয়েছেন। আমিও যুদ্ধ করব। বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া চলে যাব। আপনি কাঁদবেন না চাচি। কান্না শুনলে আমাদের মন খারাপ হবে। আমরা সাহস হারিয়ে ফেলব।
মেহেরুন্নেসা চেঁচিয়ে উঠে, না, কখনো আমরা সাহস হারাব না। আমরা সবাই সাহসী ছেলেমেয়ে। সেøাগান দাও, জয় বাংলা।
চেঁচিয়ে ওঠে সবাই, জয় বাংলা।
-এবারের সংগ্রাম –
-স্বাধীনতার সংগ্রাম।
স্লোগানের শব্দ বুকে-মাথায় নিয়ে উঠে দাঁড়ায় আশরাফুন্নেসা। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলে, আমার ছেলের জন্য আমি যুদ্ধের সময়ে আর কাঁদব না। দেশ স্বাধীন হলে ছেলের জন্য কাঁদব। ওর জন্য দোয়া করব। আল্লাহ ওকে বেহেশতবাসী করবে।
-ওর জন্য আমরা সবসময় দোয়া করব মা। ও শহীদ হয়েছে এজন্য এখন আমরা দোয়া করব। সবাই বলবে এটা শহীদের বাড়ি।
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আশরাফুন্নেসা অবাক হয়। তারপর দুহাত তুলে দোয়া পড়তে শুরু করে। তার সঙ্গে অন্যরাও দোয়া পড়ে। ছোটরাও দুহাত তুলে রাখে। ওদের চোখে ভেসে ওঠে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া আক্কাস। পাশাপাশি বেঁচে থাকার সময়ের আক্কাস। তার দুই চেহারাই সবার সামনে ভেসে থাকে। মেহেরুন্নেসার কানে ভেসে আসে আক্কাসের কণ্ঠস্বর, মেহের আমি যুদ্ধে গেলে তুই মাকে দেখে রাখবি। মা যেন কষ্ট না পায়।
-মা তোমার জন্য কাঁদে ভাইয়া। এই কান্না শহীদ হওয়ার গর্বের কান্না।
ও যুদ্ধের গর্বে নিজেকে এভাবে ভরিয়ে তোলে। ভাই এখন যুদ্ধের স্মৃতি।
আস্তে আস্তে গ্রামের ছবি পাল্টে যায়। যুদ্ধের খবরের সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন সচেতন হয়ে ওঠে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার এক ধরনের প্রস্তুতি মানুষের মাঝে কাজ করে। মুরব্বিদের অনেকে যুদ্ধ-প্রস্তুতির কথা ভাবছে। ছেলেরা কীভাবে সীমান্ত পাড়ি দেবে সে ভাবনা ভাবছে। মেহেরুন্নেসা বুঝে যায় ওর সামনে নতুন সময়। এই সময় মোকাবিলা করার জন্য শক্তি চাই। ভয় একটাই- সেটা ওর বয়স। মুরব্বিরা বলে, গাঁয়ে বেশি হাঁটাহাঁটি করবি না। ঘরে থাকবি। কারো নজরে পড়লে তুলে নিয়ে যাবে।
-তার আগে লাত্থি মারব।
-মরার জন্য?
-হ্যাঁ, মরতে হলে তো মরবই। মেরে মরব। যুদ্ধ এমনই। আমি নিজেকে ছেড়ে দেব না কারো হাতে।
একজন বলে, সাবাস। এটাই আমাদের যুদ্ধের সময়।
আর একজন বলে, এটাই যুদ্ধ।
নানা উত্তেজনায় সময় কাটে। শহর থেকে দলে দলে মানুষ চলে আসতে থাকে। তারা ওদের বাড়ির কাছের সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে যায়। ওর মা এইসব মানুষকে সাহায্য করে। কেউ রাতে থাকতে চায়। কাউকে ভাত রেঁধে খাওয়াতে হয়। গাঁয়ের লোকজন সবাই মিলে সহযোগিতা দেয়। অনেকে মেহেরুন্নেসাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে একজন হিন্দু জমিদারের বউ ছিল। মেনকা দেখতে খুবই সুন্দর। মেহেরুন্নেসা হাঁ করে তাকে দেখে। মেনকা ওকে কাছে ডেকে আদর করে, নাম জিজ্ঞেস করে।
বলে, তোমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। পাহাড়-নদী-গাছপালা ভরা এমন গ্রাম আমার চোখে পড়েনি। আমিও তো গ্রামে থাকি। সেই গ্রাম তোমাদের গ্রামের মতো না।
-তাহলে আপনি আমাদের গ্রামে থেকে যান।
-পাগল। কেমন করে থাকবো আমার ঘরবাড়ি আছে না।
-না, মানে এই যুদ্ধের সময় থাকেন।
-না, আমি ইন্ডিয়া যাব। আমার সঙ্গে যারা এসেছে তারা তো যুদ্ধ করবে।
-আপনি কোথায় থাকবেন?
-শরণার্থী ক্যাম্পে। ক্যাম্পে থেকে যুদ্ধের জন্য যা যা করতে হবে তা করব।
-আমিও আপনার সঙ্গে যাব।
-সবাই গ্রাম খালি করে যাওয়া ঠিক হবে না। আমাদের নানাজনে আসবে যুদ্ধের নানা দরকারে। মুক্তিযোদ্ধারা আসবে। পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করবে।
-ও হ্যাঁ তাই তো। মেহেরুন্নেসা ঘাড় নাড়ে।
-আমি মা-বোনদের সঙ্গে গ্রামেই থাকব। যুদ্ধের খবর রাখব।
-ঠিক। সাহসের সঙ্গে থাকতে হবে। তোমার সাহস দেখে আমিও নিজে সাহস পাচ্ছি।
মেহেরুন্নেসা উজ্জ্বল হাসিতে ভরিয়ে দেয় চারদিক। মেনকা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। পাড়া-গাঁয়ে বাস করা একটি মেয়ে কী করে এমন সাহসী হয়! পরক্ষণে নিজে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ভগবানই ওকে এমন করে গড়েছে। পড়ালেখা ঠিকমতো না শিখতে পারলে কী হবে ওর মগজে পড়ালেখা আছে। সব ধরনের পড়ালেখা। মেনকা মুগ্ধ হয়ে বলে, ভালো থাকো সাহসী মেয়ে।
মেহেরুন্নেসা আবারও দীপ্ত হাসিতে নিজেকে উজ্জ্বল করে।
নিজের পোটলাটা থেকে খাবার বের করে ওকে খেতে দেয় মেনকা। বলে, দুদিন পরে আমার বাড়ি থেকে আরও কয়েকজন এলে আমরা সবাই সীমান্ত পার হব।

এর মধ্যে শুরু হয় কলেরা।
প্রথম রাতেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ওর ফুপু। পরপর আরও কয়েকজন। বাড়িতে কান্নার রোল উঠেছে। আক্রান্ত মেনকা মেহেরুন্নেসার মাকে বলে, আমার মুখে একটু ঘি দেবেন। দাহ তো হবে না বুঝতে পারছি।
আশরাফুন্নেসা বলে, দাহর কথা কেন বলছেন। আপনি ভালো হয়ে যাবেন।
-এখানে তো কোনো ডাক্তার নাই। ওষুধ নাই। যাক যা হবার হবে। আপনি আমার মুখে একটু ঘি দেন।
-আমার বাড়িতে ঘি নাই। দেখি কার বাড়িতে আছে।
আশরাফুন্নেসা অন্যের বাড়ি থেকে ঘি আনতে ছোটে। ঘি নিয়ে ফিরে এসে মুখে একটু ঘি দিতেই চোখ বুজে মেনকা।
যারা তাকে নিয়ে এসেছিল তাদের কান্নায় তোলপাড় করে বাড়ি। আশরাফুন্নেসা বোবার মতো বসে থাকে। বুঝতে পারে এটাও যুদ্ধের সময়ের মৃত্যু।
এই বয়সে এমন মৃত্যু দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় মেহেরুন্নেসা। বাড়িঘর এলোমেলো হয়ে আছে। রান্না খাওয়ার ঠিক নেই। কে কার খোঁজ রাখে। মানুষের ভিড় একটু কমতেই ওর মা বিছানা নেয়। তারপরও পালিয়ে আসা লোকদের আশ্রয় দিতে ওরা কখনো দ্বিধা করেনি। সবাই মিলে সব কিছু সামাল দিয়েছে। শুধু ভাইয়ের মৃত্যুর শোক পরিবারের ওপর পাথরের মতো চেপে আছে।

বর্ষা শুরু হয়েছে।
যখন-তখন বৃষ্টি নামে। মাঠঘাট পানিতে ভরে যায়। মায়ের শরীর খারাপ হয়েছে। ঠাণ্ডা-জ¦রে ভুগছে। মেহেরুন্নেসা বোনদের নিয়ে ঘর সামলায়। ওদের নিয়ে ভাইয়ের কবরে ফুল দিতে যায়। কবরটা গাছের নিচে হওয়াতে ফুল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ভাবে, ভাইয়া শান্তির শেষ ঘুম ঘুমাচ্ছে।
গ্রামের অনেক ছেলে যুুদ্ধে যোগ দিতে গেছে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ বাড়িতে আসে। ভাত খেয়ে চলে যায়। যাবার আগে ওদেরকে বলে, সাবধানে থাকবে। বাইরে বেশি ঘোরাঘুরি করবেনা। পাশের গ্রামে আর্মি ক্যাম্প করেছে। শয়তানগুলো মেয়েদের পেলে টেনে নিয়ে যায়।
-জানি। মরতে হলে লাত্থি দিয়ে মরব। তোমরা আমাকে কবরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলবে, আমাদের মেহের শহীদ হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য শহীদ।
-বলিস কিরে? তোর ইজ্জতের ভয় নাই?
-ঠিকই বলেছি। যুদ্ধের সময় আবার ইজ্জত কি? আমিতো শয়তান মেয়ে না যে ওদের কাছে ইজ্জত বেচতে যাব। এটাও যুদ্ধ।
-যাই। ক্যাম্পে গিয়ে বলব তোকে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে। তুই আমাদের বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা হবি।
-না, আমি ওই যুদ্ধে যাব না। আমি গ্রামের যুদ্ধে থাকব। তোমরা পাকিস্তানি ক্যাম্পটা আক্রমণ করবে না?
-করব তো। সেজন্য তো আমি রেকি করে এসেছি।
-সেইদিন আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব।
-ঠিক আছে থাকবি। আমি তোকে খবর পাঠাব। যাই।
চলে যায় মুক্তিযোদ্ধা শরীফ। নিজের তিন বোনসহ শরীফের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে মেহেরুন্নেসা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে গণকবর। সেদিন যারা শহীদ হয়েছিল তাদেরকে গাছের নিচে গণকবর দেয়া হয়েছিল। দূরের দিকে তাকিয়ে সবার ছোট কামরুন্নেসা বলে, আমি ভাইয়ার কাছে যাব।
-হ্যাঁ, আমরা সবাই যাব। চল, গাছগুলোর গোড়ায় পানি ঢেলে আসি।
-কেন, পানি ঢালব কেন?
-গাছগুলো সতেজ থাকবে। গণকবরে ছায়া দেবে। আমাদের শহীদেরা শান্তির ঘুম ঘুমাবে।
-হ্যাঁ, চলো চলো। আমরা যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন ওই গাছের গোড়ায় পানি দেব। গাছগুলো শহীদদেরকে ছায়া দেবে।
মেহেরুন্নেসা বোনদের নিয়ে বাড়িতে যায়। শুনতে পায় মায়ের কান্না। বারান্দার খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে কাঁদছে। তিনজনে কাছে গিয়ে বসে।
-মাগো, কাঁদবেন না।
মেহেরুন্নেসা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে। মায়ের কান্না থামে না। মা আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি দিয়ে ভেজাতে থাকে নিজেকে।
-আপনার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে মাগো।
মা মেয়েদের বুকে টেনে বলে, তোরা যতদিন বাঁচবি ততদিন-
-মাগো আমাদেরকে বলতে হবে না। আমরা যতদিন বাঁচব ততদিন স্বাধীনতার জন্য পরাণ দেয়া মানুষকে মনের মণিকোঠায় রাখব। ছোটদেরও শেখাব শহীদের কথা মনে রাখতে হবে। তাদেরকে সম্মান দেখাতে হবে।
মেহেরুন্নেসা দেখতে পায় ওর কথা শুনে মায়ের চোখের পানি কমেছে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছছে। সেই সময় দুজন মুক্তিযোদ্ধা ঢোকে বাড়িতে। দ্রুত ঘরে ঢুকে চৌকির নিচে হাতের অস্ত্র ঠেলে দিয়ে বলে, আজ রাতে আমাদেরকে এখানে থাকতে হবে। কালকে মিলিটারির ক্যাম্প আক্রমণ করবে মুক্তিবাহিনী।
-ওহ, আল্লাহরে, আয় আমার বুকে আয় সোনার ছেলেরা।
আশরাফুন্নেসা ছেলেদের জড়িয়ে ধরে। মনে হয় এই জীবনে যা কিছু পাওয়া হয়নি এই ছেলেরা সেই জায়গা পূর্ণ করে দিচ্ছে। এমন শান্তি ওর বুকে এসে জমে। মেয়েদেরকে বলে, রান্নাঘরে যাও মেয়েরা ওদের জন্য ভাত বসাও।
তিন বোন দৌড়ে রান্নাঘরে ঢোকে। মেহেরুন্নেসা একা দাঁড়িয়ে থাকে। মাকে বলে, যোদ্ধা ভাইয়েরা এখন কি করবে?
-বিশ্রাম নেবে। বাবারা ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখ। দুজনে গ্রেনেডের ঝোলাটা চৌকির নিচে রেখে পা গুটিয়ে বসে থাকে। আশরাফুন্নেসা দরজা টেনে রেখে নেমে যায় উঠোনে।
মেহেরুন্নেসা দরজা ফাঁক করে বলে, আমাদের গ্রামটা শহীদের গ্রাম। এবার যুদ্ধের গ্রাম হবে। তাই না?
-হ্যাঁ, তাই। আপনারাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন। আমাদের যুদ্ধ সবার যুদ্ধ। শুধু রণক্ষেত্র আর পাক-সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণই যুদ্ধ না।
-ঠিক বলেছেন। আপানাদেরকে হাজার সালাম। কি খাবেন আপনারা?
-ঘরে যা আছে তাই খাব। আলাদা করে কোনো কিছু করতে হবে না।
-রান্না হতে হতে মুড়ি মাখিয়ে দেই?
-হ্যাঁ, দেন। খাব।
-আপনাদের নাম জানতে চাই।
-আমি শুকুর। ও অর্জুন।
-আপনাদেরকে এখানে কে পাঠিয়েছে?
-গফুর চাচা। বলেছে শহীদের বাড়িতে যাও। উনি পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।
-কতজন আছে আপনাদের সঙ্গে?
-পনের জন। বিভিন্ন জন এই গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় আছে। সন্ধ্যার পরে আমরা এক জায়গায় জড়ো হবো। তারপর শুরু হবে আক্রমণ।
-আল্লাহ আমাদের সহায় হোক। আমি যাই মুড়ি আনি।
মেহেরুন্নেসা চলে গেলে শুকুর আর অর্জুন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বলে, বেশ বুঝদার মেয়ে। যুদ্ধের সময়কে বোঝে। নিজের দায়িত্বও বোঝে। আমরা এই যুদ্ধে জিতবই।
হা-হা করে হাসতে হাসতে দুজনেই বলে, স্বাধীনতা স্বাধীনতা।
-বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কি তোর মনে আছে অর্জুন?
-বিভিন্ন লাইন তো অবশ্যই মনে আছে- এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।
দুজনেই সেøাগানের মতো কয়েকবার বললে অর্জুন বলে, এই কথাই আমাদের সাহস, আমাদের শক্তি। আমাদেরকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
দরজা খুলে দুজনকে দেখে থমকে দাঁড়ায় মেহেরুন্নেসা।
-মুড়ি এনেছেন? আসেন।
বোনদের নিয়ে ঢোকে মেহেরুন্নেসা। পেছনে ওদের মা দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ঘরে ঢুকলে আশরাফুন্নেসা একটি পাটি বিছিয়ে দিয়ে বলে, সবাই এখানে বস। মুড়ির গামলা মাঝখানে রাখলাম।
-আপনিও বসেন চাচী।
-হ্যাঁ, তোমাদের কথা শোনার জন্য আমিও থাকব। সবাই মিলে মুড়ি খাও।
গোল হয়ে বসে সবাই গামলা থেকে মুঠি ভরে মুড়ি নেয়।
-আপনারা স্লোগান দিচ্ছিলেন?
-দিচ্ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে সেøাগান।
-তোমরা কখন কীভাবে ক্যাম্প আক্রমণ করবে তা আমাকে বলো বাবারা।
-আমরা অপারেশন করার জন্য রেকি করেছি। রাত আটটায় আক্রমণের সময় ঠিক করা আছে। তখন ওরা রাতের খাবার খেতে বসে। আমাদের হাতে কার কাছে কি অস্ত্র থাকবে সেটাও গ্রুপ লিডার ঠিক করে দিয়েছে।
-তোমরা কখন যাবে বাড়ি থেকে?
-আমরা সন্ধ্যা ছয়টায় সবাই এক জায়গায় জড়ো হবো। আমাদের বেশ খানিকটা পথ হেঁটে যেতে হবে।
-তাহলে তোমাদেরকে ছয়টার আগে ভাত খাইয়ে দেব। তোমরা ঘড়ি দেখে আমাকে সময় জানিও। আমি রান্নাঘরে গেলাম।
-বেশি কিছু রাঁধতে হবে না চাচি। ডাল আর ডিম ভাজি হলেই হবে।
-আচ্ছা আমি দেখি।
বেরিয়ে যায় আশরাফুন্নেসা। সবাই মুড়ি খেতে খেতে হইচই করে। বন্ধ ঘরের ভেতরে বসে সেøাগান দেয় অর্জুন, জয় বাংলা।
সবাই মিলে একসঙ্গে বলতে গেলে বাধা দেয় শুকুর।
-আস্তে। একসঙ্গে কথা বলা যাবে না।
-ঠিক আছে, আমরা বাইরে যাচ্ছি। আপনারা পাক-সেনাদের আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। লাগলে দরজা ফাঁক করে ডাকবেন। আমরা বারান্দায় বসে থাকব। আপনাদেরকে পাহারা দেব।
ওরা কিছু বলার আগেই দরজা বন্ধ করে দেয় মেহেরুন্নেসা। দুজনে পাটির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের উপর হাত জড়ো করে রাখে। দৃষ্টি ছাদে আটকে থাকে। দুজনে একইসঙ্গে ভাবে, বাঙ্কারের ডিউটি সেন্ট্রিকে উড়িয়ে দিয়ে অপারেশনের রণদামামা আমি বাজাব।
নিস্তব্ধ ঘরে শব্দ নেই। বাইরেও না। পাহাড়ি এলাকার নিরিবিলি গ্রামটি আজ রাতে মুক্তিবাহিনীর সাহসী যোদ্ধারা কাঁপিয়ে দেবে।
নির্দিষ্ট সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী জায়গামতো পৌঁছে যায়। নির্ধারিত সময়ে শুরু হয় আক্রমণ। পাশের গ্রাম হলেও গোলাবারুদের শব্দ পৌঁছে যায় আশপাশে। মেহেরুন্নেসা বারান্দায় বসে শব্দ শোনে। কখনো উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। মায়ের ডাকে ঘরে এসে বসে। মা বলে, রাজাকাররা ঘোরাঘুরি করে। তোকে ঘরের বাইরে দেখলে-
-বুঝেছি মা। এখন ঘরের ভেতরে থাকব।
-আমাদের ছেলেরা জিতবে। আমি ওদের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করব। তোরা শুয়ে থাক।
রাত জেগে বসে থাকে মেহেরুন্নেসা। ভোর হয়। দরজা খুলে বের হলে টের পায় প্রবল নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে গ্রাম। দুপুরের দিকেই খবর আসতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ক্যাম্প ধ্বংস করে নিরাপদে চলে গেছে। কেউ হতাহত হয়নি। সেনাদের লাশ পড়ে আছে ক্যাম্পের পাশে।
-ওহ্ আল্লাহ, হাজার শোকর। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জয় হোক। স্বাধীনতা-স্বাধীনতা।
মেহেরুন্নেসা বোনদের নিয়ে ঘরের মধ্যে লাফালাফি করে। মাকে জড়িয়ে ধরে। কোলে নেয়। মাথার উপর তুলে ধরে। আনন্দের উচ্ছ¡াসে আশরাফুন্নেসা মেয়েদের কিছু বলতে পারে না।
বিকেলে পাকসেনারা কাছাকাছি কোথাও থেকে তিন-চারটে জিপে করে গোলাগুলি ছুড়তে ছুড়তে আসে। মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে আসে জিপ। যাকে সামনে পায় তাকেই গুলিবিদ্ধ করে। চারপাশের বাড়িঘরে গোলা ছোঁড়ে। কোনো বাড়িঘর রেহাই দেয় না।
প্রবল তাণ্ডবে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় গ্রাম।
মাছিমপুর গ্রামেও মিলিটারির জিপ ঢোকে। মানুষজন শূন্য হয়ে গেছে পথঘাট। সেজন্য ওদের আক্রমণ ঘরবাড়ির উপর চলতে থাকে। গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মেহেরুন্নেসাদের বাড়ি। দাউদাউ জ¦লে ওঠে খড়ের চাল। বাঁশের বেড়া।
মায়ের বুকে পুড়ে অঙ্গার হয় মেয়েরা।
শহীদ জননীর বাড়ি গণকবর হয়ে যায়। মেঝে ফেটে চৌচির হলে মাটির ফাঁকে আটকে থাকে মা-মেয়েদের লাশ। বড় গাছের নিচে পুড়ে যাওয়া বাড়িতে গণকবরের দৃশ্যমানপটে ওরা স্বাধীনতার জন্য জীবনদানকারী শহীদ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়