ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ : পরীমনির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসিরের ফের মামলা

আগের সংবাদ

কে কোথায় কুরবানি দিচ্ছেন

পরের সংবাদ

গল্পটা রূপকথার গল্প হতে পারে

প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পথের মোড়ে বুড়িমার সঙ্গে দেখা হয়। সামনে ভাঙা থালা। ছেঁড়া ধূলি ধূমায়িত শাড়ি তার পরনে। বুড়িমা ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। হাত থেকে কাতরস্বরে বলে, বাবা আমারে দুগা পয়সা দিয়া যাও। আমি খাওন পাই না বাবা। একদিন কৌতূহলী হয়ে বুড়িমার সামনে গেলাম। কী নাম তোমার?
হিরননেসা।
বয়স কত তোমার?
বয়স কি আর জানি?
বাবা! আমগো আবার বয়স।
তোমার পোলাপান নাই?
আছে
অরা তোমারে খাওন দেয় না?
বাবারে-
বলে বুড়ি মা কাঁদতে লাগল। ছেলের বউ তাকে ঘরছাড়া করেছে। সে এখন একা বস্তিতে থাকে। পাড়া পড়শিরা তার সেবা করে।
ছেলের বউ কী কাজ করে?
কাজ করে বাবা।
ছুটা বুয়ার কাজ করে।
রাস্তায় বইসা যে ভিক্ষা করো এতে তোমার দিন চলে?
চলে গো বাবা। এক পাও কবরে। যে কুনুদিন মইরা যামু। আমগো আবার দিন?
বুড়িমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কতো সহজ কথা। কতো গভীরভাবে বলে দিলেন। জীবনে তার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। ভিক্ষা করে। বেদনা যে আছে বলা যাবে না!
বুড়িমার কাছে আমার মাথানত হয়ে আসে।

দুই
ছেলেটার বয়স কতো? দশ? এগারো? বারো? সে ভ্যান গাড়ি চালায়। ভোরবেলা গাড়ি নিয়ে সে চলে যায় কাওরান বাজার। সঙ্গে রমজান থাকে। রমজান তার খালাত ভাই। টু পর্যন্ত সে ইস্কুলে গেছে। বাবা তার বেতনের টাকা দিতে পারেনি। গরিব রিকশাঅলা। একসাথে টাকা জমাতে পারেনি। তারপর কিছুদিন বাসায় বসে থাকল। পথে পথে ঘুরে বেড়ালো। কাশেমের জীবন কাহিনীও প্রায় একই রকম। বাবা সুদের টাকায় পুরানা ভ্যান কিনে দিয়েছে। চাকাগুলো শক্ত। জোরে প্যাডেল দিলে গাড়ি চলে। ছোট মানুষ ওরা। একজন প্যাডেল মারে একজন ঠেলা দেয়।
সারাদিন তারা ভ্যান নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। তরিতরকারি বিক্রি করে। ওরা খুব ছোট বলে ক্রেতারা ওদের ঠকাতে চায় না। ওদের ভ্যানে আলু-পিঁয়াজ, ফুলকপি, শিম, ঢেঁড়স, বরবটি, লাল শাক, পুঁইশাক, কলার মোচা কতোকিছু থাকে। এখন জলপাই উঠেছে খুব। ২০ টাকা কেজি কিনে ৪০ টাকায় বিক্রি করে। লাভের টাকা ওরা সন্ধ্যাবেলা ভাগ করে। তারপর খুশি মনে বাড়ি ফিরে যায়। কাশেম আর রমজান। ওরা রমিজ শেখের বাড়িতে থাকে। পাশাপাশি দুটো ঘর।
প্রতিদিন ওদের দেখি। কথা হয় না। আমি সাইকেল চালিয়ে কলেজে চলে যাই। ওদের সাথে কথা বলার সাহস হয় না। এতো ছোট বয়স। এখনই ওরা জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। কতো কষ্ট ওদের। স্কুলে যেতে পারেনি। কাশেম এক বছর মাদ্রাসায় পড়েছিল। মাদ্রাসায় অনেক খরচ। ওর বাবা টুকরি নিয়ে মাছ বিক্রি করে। কাশেমদের গল্প ওর বাবার কাছেই শুনেছি।
বাবার কোনো আক্ষেপ নাই। ছেলেটা যা করছে তাই ভালো। ওর আয় আছে বলেই দুইবেলা ভাত খেয়ে, তিনহাজার টাকা ঘর ভাড়া দিয়ে ওদের দিন কেটে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলে, ওদের লেখাপড়া করা দরকার। ওরা শিশু। ওরা শিশু শ্রমিক। বাংলাদেশে আইন আছে। শিশু অধিকারের আইন। শিশুদের শ্রমিক বানানো চলবে না।
কিন্তু অভাবের সংসারে বড় বড় কথা চলে না। কাজ করে খেতে হয়। নইলে পেটে ভাত জোটে না। খাবার আসবে কোথা থেকে?

তিন
ছোট্ট হোটেল। নাম মায়ের দোয়া। হয়তো মায়ের দোয়াতে এই হোটেল তৈরি হয়েছে। লালবাগের মোড়ে চা নাশতার এই হোটেল। ভোরবেলা হোটেলের ঝাঁপ খোলা হয়। মাঝরাতে হোটেল বন্ধ হয়। সারাদিন কাস্টমার আসে। হোটেলটা গমগম করে। কম দামে পেট ভরে খাওয়া যায় এই হোটেলে। শাহজাহান কাজ করে এই হোটেলে। রাতে হোটেলের খাবার টেবিলে শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে গভীর ঘুম আসে তার। মা বাবা থাকে চর নবীপুরে। যমুনার তীরে। নদীভাঙনের শব্দ শুনে শুনে বড় হয়েছে সে। নিজেদের ভিটে মাটি যমুনায় তলিয়ে গেছে। নদীর অপর পাড়ে আবার তারা গিয়ে বসতি গড়েছে। সংসারে সবসময় অভাব। চাষাবাদের জন্য তাদের নিজস্ব জমি নাই। শাহজাহানকে নিয়ে বাবা তিন চার বছর আগে ঢাকায় এসেছিলেন। উঠেছিল গোরারটেকে। তাদের এলাকার এক মামার কাছে। তিন বেলা খাবার জুটতো। কিন্তু মাস শেষে দিতে হবে তিন হাজার টাকা। বাবার পকেটে কোনো টাকা-পয়সা নাই। নিঃস্ব অবস্থায় তিনি ঢাকায় এসেছেন। কোনো কাম কাজ করে টাকা-পয়সা কামিয়ে আবার গাঁয়ে ফিরে যাবে।
কিন্তু কাজ কোথায়? দুচারদিন মন খারাপ করে বসে থাকে গহর আলী।
তারপর খোকন মামু একদিন তার হাতে একটা রিকশা ধরিয়ে দেয়। বেশি দূর যাইবা না মামু। কাছাকাছি খ্যাপ নিবা। দ্যাহো পারো কিনা?
প্রথম দিন ৩০০ টাকা আয় হলো। শহর আলী খুব খুশি। শীত বর্ষা নাই। সে প্রতিদিন রিকশা চালায়। তার স্বপ্ন একদিন সে অনেক টাকা কামাবে। গ্রামে ফিরে একটা পাকা বাড়ি তুলবে। শাহজাহান ঢাকায় থাকবে। লেখাপড়া করবে। এক দুর্ঘটনায় সব এলোমেলো হয়ে যায়। রিকশার ওপর চড়ে গেল একটি পিকআপ ভ্যান। শহর আলী ভাঙা পা নিয়ে গ্রামে ফিরে গেলেন।
পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে শাহজাহান মায়ের দোয়া হোটেলে চাকরি পেল। মালিক ওমর মিয়া খুব ভালো মানুষ। তিন বেলা খাবার ফ্রি। থাকা হোটেলেই। শাহজাহান খুব খুশি, পেট পুরে খাওয়া যায়। বেতন যা পায় সেটা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। গাঁয়ে ছোট্ট এক চিলতে একটু ভিটে আছে। বেড়ার ভাঙাচোরা ঘর। কোনোমতে মা সেই ঘরে থাকে। তাদের চাষের কোনো জমি নাই। পাশের বাড়ির খালারা মায়ের জন্য রান্না করে দেয়।
মা লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে দিনমান গাঁও গেরামে ঘুরে বেড়ায়। এতেই তার আনন্দ। ছেলেকে নিয়ে মায়ের চিন্তার কোনো শেষ নাই। অনেক চিন্তা।
শাহজাহান জানে। তার মা অনেক দুঃখী। তাকে নিয়ে খুব চিন্তা করে। রাতে হোটেলের মেঝেতে গামছা পেতে শুয়ে পড়ে শাহজাহান। ক্লান্ত শরীর। হাত পা যেন ভেঙে আসে। তখন সে স্বপ্ন দ্যাখে। একদিন সে মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। তাদের বেড়ার ঘরটা পাকা ঘরে পরিণত হবে। মা সেই পাকা ঘরের বারান্দায় বসে থাকবে। শীত সকালে রোদ পোহাবে। আর শাহজাহান অনেক টাকা পাঠাবে মাকে।
মায়ের কোনো অভাব থাকবে না। মায়ের মুখের হাসি পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দময় অভিজ্ঞতা। শত দুঃখের মাঝেও শাহজাহানের মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলে থাকে। ঘুমের আবেশে দুই চোখ বুজে আসে।

চার
মাস শেষে মালিক ওমর মিয়া শাহজাহানের হাতে কিছু টাকা দিলেন। যা দু-একদিন গেরাম থেইকা ঘুইরা আয়। মন ভালো থাকবো। শাহজাহানের মন মহাখুশিতে নেচে উঠল।
মায়ের মুখের হাসির জন্য তার এই সংগ্রাম। ঢাকা শহরে এসে সে এতো কষ্ট করছে। সেদিন ঘুমের ঘোরে নাকি কাঁদছিল শাহজাহান।
মাগো মা, কেমুন আছ তুমি? মা আমার মা।
ওর পাশে ঘুমিয়েছিলেন মহাজন ওমর আলী। পরদিন হাশেম মামাকে সব খুলে বলে। মামা সব শুনে চুপ থাকেন। মাকে ফেলে আসা এইসব ছেলেমেয়ে জীবন জীবিকার জন্য কত কষ্টই না করে থাকে। মনটা বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে যায় ওমর মিয়া। মায়ের দোয়া হোটেলের মাধ্যমে ওমর মিয়া শুধু যে ব্যবসা করেন তা নয়। গরিব ছেলেদের তিনি অনেক উপকার করেন। তার এখানে কাজ করে অনেকে লেখাপড়া শিখে এখন ভালো অবস্থায় আছে।
শাহজাহানের মাথায় হাত রেখে বললেন,
বাবা, মা বড় ধন। আমি মায়েরে পাইনি। ছোটবেলায় মারে হারাইছি। মায়ের দিকে খেয়াল রাখবি। তাইলে জীবনে উন্নতি হবে। শাহজাহানের সামনে তখন মায়ের মুখ। নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় সে।
চোখ ভিজে আসে। মহাজনের সামনে দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে শাহজাহান। কতোদিন পর তার মায়ের সাথে দেখা হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়