সেন্ট লুসিয়ায় ধীরে এগুগোচ্ছে উইন্ডিজ

আগের সংবাদ

বিধ্বস্ত শহরে ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা : আদালতের নিয়মিত বিচারকাজ বন্ধ > অফিসপাড়া নিথর > বন্ধ হাসন রাজা মিউজিয়াম > পথে পথে ক্ষতচিহ্ন

পরের সংবাদ

সেতু ঘিরে উচ্ছ্বাসের ঢেউ

প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৭, ২০২২ , ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ

** দর্শনার্থীদের ভিড়, ছবি তোলার ধুম ** বাইক রাইডারদের পোয়াবারো **
ইমরান রহমান, পদ্মা সেতু থেকে ফিরে : বেলা ১১টা। বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা ও আবেগের সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। হেঁটে সেতুতে ওঠার অনুমতি না থাকায় কেউ বাসে ওঠার চেষ্টা করছেন, কেউ আবার বাইক রাইডারদের খুঁজছেন। কেউ কেউ কিছুই না পেয়ে পাশেই হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আবার অনেকে মোটরসাইকেলে কিংবা বাস, পিকআপ, মাইক্রোবাস ভাড়া করে এসে উল্লাস করতে করতে টোল প্লাজা অতিক্রম করছেন। সবার হাতে মোবাইল, চোখেমুখে যেন রাজ্য জয়ের উচ্ছাস। পদ্মা সেতুতে প্রবেশ করতেই দেখা যায় সেতুর দুই প্রান্তে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা দর্শনার্থীদের ভিড়। সবার মধ্যেই লেগেছে স্বপ্ন জয়ের উচ্ছ¡াসের ঢেউ।
তাইতো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে ছবি তোলার ধুম সেতুজুড়ে। কেউ পরিবারসহ এসেছেন, কেউবা এসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে। যে সেতুর জন্য এত দীর্ঘ অপেক্ষা, সেটির ওপর দাঁড়িয়ে অনেকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন পুরনো ফেরিঘাটের দিকে। অনেকে বলেই ফেলছেন, ফেরিঘাটের ভোগান্তি থেকে চিরমুক্তি। ফেরি না পেয়ে আর হয়তো মারা যাবে না কারো স্বজন, স্বজনের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না কাউকে, চাকরির পরীক্ষা মিস করতে হবে না কোনো শিক্ষার্থীকে। এদিকে হেঁটে সেতুতে উঠতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। তাদের দাবি, অন্তত একদিন জনসাধারণকে স্বপ্ন ছোঁয়ার সুযোগ করে দেয়া উচিত ছিল। কেননা বাস ও মোটরসাইকেল রাইডাররা যে পরিমাণে ভাড়া চাচ্ছেন, সেই টাকা দিয়ে অনেকের পক্ষে সেতু দেখা সম্ভব হচ্ছে না।
সরজমিন পদ্মা সেতুর মাওয়া টোল প্লাজা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে গাড়ির চাপ থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। টোল প্লাজার বাইরে মূল সেতুতে হেঁটে ওঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় অনেককে। তাদেরই একজন শাহনাজ বেগম। ছোট মেয়ে জেসমিনকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের দেলপাড়া এলাকা থেকে পদ্মা সেতু দেখতে এসেছেন। কিন্তু বাস ও মোটরসাইকেলে শুধু সেতু পার করতে জনপ্রতি ২০০ টাকা চাওয়ায় দেখতে পারেননি। কারণ ফিরতেও ২০০ টাকা করে দেয়া লাগবে। একই কারণে সেতু না দেখে বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফিরে যায় সরকারি লৌহজং ইউনিভার্সিটি কলেজের শিক্ষার্থী কিয়াস শেখ।
টোল প্লাজা পার হলে মনের মধ্যে অন্য রকম শিহরণ কাজ করতে থাকে। মনে হয়, এইতো সেই শুভক্ষণ। যার জন্য এত অপেক্ষা। সেতুতে ওঠার শুরুতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুরাল। এরপর থেকে চোখে পড়বে পদ্মা সেতু দেখতে পারার আনন্দে উজ্জ্বল দর্শনার্থীদের।
তাদেরই একজন যশোরের শার্শা এলাকার একটি অটো রাইসমিলের মালিক মো. আবদুর রশিদ চৌধুরী। ছেলে, ছেলের বউ ও মেয়ের জামাইকে নিয়ে দেখতে এসেছেন পদ্মা সেতু। মো. আবদুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ছোটবেলা থেকে এমন একটা দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। এজন্য আর তর সইল না। শার্শা থেকে আরিচা হয়ে ঢাকায় এসে ওদের (স্বজন) নিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে এলাম। এটি শুধু সেতু নয়, আমাদের আবেগ। মৃত্যুর আগে পদ্মা সেতু দেখার সাক্ষী হতে পারব, কখনোই ভাবিনি। আশা করি দক্ষিণবঙ্গের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন হবে।
দুই ভাগ্নিকে নিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে আসা কৈশব বিশ্বাস বলেন, গ্রামের বাড়ি শিবচর হলেও কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া লাগত। সেখান থেকে আরিচা হয়ে ঢাকায়ও নিয়েছি কয়েকবার। এখন আর ওই বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। সেতুর ওপর দিয়ে ১০ মিনিটে নদী পার হতে পারায়, মাত্র ১ ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছাতে পারব। পাশে থাকা তার বড় ভাগ্নি প্রিয়ন্তী সমাদ্দার বলে উঠলেন, মামা ঢাকায় অনার্সে ভর্তি হবা। এখনতো না করতে পারবা না। জানতে চাইলে প্রিয়ন্তী বলেন, মামা বাড়ি থেকেই পড়াশোনা করেন। এ বছর এইচএসসি পাস করেছেন। এখন মামা বাড়ি থেকেই ঢাকায় পড়াশোনা করতে পারবেন।
উল্টোবেলায় কলকাতা ফিরতে পারব : বাংলাদেশে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করেন ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার ধুবগুড়ি এলাকার বাসিন্দা স্বপন কুমার দত্ত। বিস্ময়কর পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে শুনে ১৫ দিন আগে কাজ শেষ হলেও দেশে ফেরেননি তিনি। যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার প্রথম দিনই ছুটে এসেছেন সেতু দেখতে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন পূর্বপুরুষের সূত্রে বাংলাদেশে অবস্থান করা বেশ কয়েকজন স্বজনকেও। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে উচ্ছ¡াস, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেটি আর দেখা যায়নি। আশা করি, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা এনে দেবে। স্বপন কুমার দত্ত আরো বলেন, আমার মা বসুমতি দত্তের কাছে এই পদ্মার অনেক গল্প শুনেছি। অনেক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই নদী। এখন আর সেটি হবে না। এখন মানুষ কলকাতা থেকে ঢাকা এসে কাজ শেষ করে উল্টোবেলায় কলকাতা ফিরে যেতে পারবে।
ভিক্ষার টাকায় দিনাজপুর থেকে পদ্মার পাড়ে : শারীরিক প্রতিবন্ধী ফজলুর রহমানের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। ভিক্ষা করে সংসার চলে। টিভিতে দেখেছেন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে। আর বসে থাকতে পারেননি। চলে এসেছেন পদ্মা পাড়ে। কিন্তু হেঁটে পদ্মা সেতুতে উঠতে না দেয়ায় রাগে বসে থাকেন টোল প্লাজার পাশে। এক পর্যায়ে গ্রামের বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ফজলুর রহমান বলেন, টিভিতে দেখছি পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে। আর বসে থাকতে পারি নাই। ট্রেনে ভিক্ষা করতে করতে ঢাকা আসছি গত শনিবার রাতে। সারা রাত কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিলাম। সকালে গুলিস্তান থেকে ৫০ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে এখানে নামছি। কিন্তু সেতুতো দেখতে দেয় না। বাসওয়ালারা অনেক টাকা ভাড়া চায়। এবার আর সেতু দেখা হইল না। ট্রেন চালু হইলে আবার আসব। সেতু দেখে কলিজা জুড়াব।
মনে কষ্ট নেই ফেরিঘাটের হকারদের : আগে যেসব হকার ফেরিঘাটে ব্যস্ত সময় পার করতেন, তাদের অনেকেই মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে হকারি শুরু করেছেন। আইসক্রিম বিক্রেতা বকুল দাশ বলেন, অনেক বছর ধরে ফেরিঘাটে আইসক্রিম বিক্রি করেছি। লাখ লাখ মানুষের ভোগান্তি আর কষ্ট দেখতে ভালো লাগত না। এখন আর তা দেখা লাগবে না। এতেই আমরা খুশি। আয় কমে গেলে সংসার চলবে কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রিজিকতো কারো হাতে নেই, যেভাবেই হোক চলবেই। শরবত বিক্রেতা হান্নান বলেন, প্রয়োজনে ব্যবসা পরিবর্তন করব। তাও আমাদের প্রাণের চাওয়া পদ্মা সেতু হইছে, তাতেই আমরা সবাই খুশি।
বাইক রাইডাররা পোয়াবারো : পদ্মা সেতুতে হেঁটে উঠতে না দেয়ার সুযোগে দুই পাড়ের বাইক রাইডারদের পোয়াবারো। বাইকে নিয়মবহির্ভূতভাবে দুজন যাত্রী পরিবহন করছেন। শুধু পার করে দিয়ে প্রতিজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন ২০০ টাকা। অনেক রাইডার ৩০০ টাকা করেও নিয়েছেন দর্শনার্থীদের কাছ থেকে। সরজমিন দুই পাড়েই শতাধিক বাইক দেখা যায়, যেগুলো যাত্রীদের সেতু দেখাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মোটরসাইকেলগুলোয় ব্যবহার করা হচ্ছে না কোনো হেলমেট। হাইওয়ে পুলিশ শুধু সচেতন করে তাদের টোলপ্লাজা দিয়ে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে।
জানতে চাইলে মোটরসাইকেল চালক আলমগীর বলেন, ৩ ঘণ্টায় সাতটি ট্রিপ মেরেছি। প্রতি ট্রিপে দুজন করে যাত্রী ছিল। প্রত্যেকের কাছ থেকে সব চালকই ২০০ করে নিচ্ছে। আমিও নিচ্ছি। একবার পার করলে ১০০ টাকা টোল বাদ দিয়ে ৩০০ টাকা থাকছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাইডার সুজন বলেন, আমি ৬০০ টাকা ছাড়া পার করছি না।
টোল প্লাজায় দায়িত্ব পালন করতে থাকা চাষারা হাইওয়ে থানার সার্জেন্ট বাহারুল বলেন, অনেকেই হেলমেট ছাড়া আসছেন। প্রথম দিন বলে তাদের কিছুটা ছাড় দেয়া হচ্ছে। তবে তাদেরকে বলে দেয়া হচ্ছে, এরপর আর এই সুযোগ দেয়া হবে না। টোলপ্লাজার নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, সামগ্রিক নিরাপত্তা খুবই ভালো। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে টোল পরিশোধ করে সেতু পার হচ্ছেন। এদিকে সেতু কর্তৃপক্ষের টহল গাড়িকে কিছুক্ষণ পরপর দর্শনার্থীদের অনুরোধ করে সেতু থেকে সরিয়ে দিতে দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গত শনিবার স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রবিবার সকাল ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ও আবেগের পদ্মা সেতু।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়