স্বপ্নজয়ের পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

আগের সংবাদ

হাওর জনপদে স্বাস্থ্যসেবা ‘নেই’

পরের সংবাদ

বিয়ানীবাজার-জকিগঞ্জ কার্যত অচল

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও ফারুক আহমদ, সিলেটের বন্যাদুর্গত এলাকা ঘুরে : সিলেট থেকে বেরিয়ে পূর্বদিকে অনেকটা পথ গিয়ে গোলাপগঞ্জ উপজেলাকে বাঁয়ে রেখে ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক ধরে সামনে যেতেই দেখা গেল দক্ষিণ সুরমা উপজেলা কমপ্লেক্সের বেশ কয়েকটি সরকারি অফিস এখনো পানিবন্দি। আরো সামনে গিয়ে দেখা গেল জলমগ্ন উত্তর কুশিয়ারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুটো ভবনের দুই ও তিনতলা পুরোটাই আশ্রয় কেন্দ্র। শুকনো খাবারই এখানে ভরসা। গত ৬ দিন ধরে এখানে পূর্বপাড়া, বিনপুর, সোনাপাড়া, টিলপাড়া, মাঝপাড়া, দণ্ডিপাড়া এলাকার লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন।
এই আশ্রয় কেন্দ্রকে পেছনে রেখে একই সড়ক ধরে সামনে যেতেই পাওয়া গেল নৌকা দিয়ে বস্তাভর্তি ধান এনে উঁচু সড়কে স্তূপ করে রাখছেন। ধান সড়কে এনে স্তূপ করে রাখার কারণ সম্পর্কে মহিদপুর গ্রামের বদরুল আলম বলেন, বন্যার পানিতে সব ভিজে গেছে। এই ধানগুলোকে কোনো রকম পানি থেকে বাঁচাতে পেরেছিলাম। কিন্তু এখন আর রাখার জায়গা নেই। সব জায়গায় পানি, এজন্য অনেকটা কম দামে ধানগুলো বেচে দিয়েছি। পাশেই ফখরুল নামের একজন বলেন, বৃহস্পতিবার প্রায় দেড় লাখ টাকা দামের একটি ষাঁড় ও একটি গাভী ৮৫ হাজার টাকায় বেচে দিয়েছি। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এই টাকাই এখন আমাদের সম্বল। এরপর কোমর পানি ভেঙে ডুবন্ত রাস্তায় ইলাশপুর অতিক্রম করে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের দিকে যেতে চোখে পড়ল শুধু পানি আর পানি। উপজেলা সদরের প্রকৌশল অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন, বাজার- সবই পানির নিচে। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী মদরিছ মিয়া বলেন, আমাদের এখানে আগে পানি ছিল না। গত তিন দিন ধরে পানি বাড়ছে। বাজারে পানি ঢুকে অনেক দোকান তলিয়ে গেছে। মূল রাস্তা থেকে ভেতরের দিকের পরিস্থিতি শোচনীয়। একের পর এক গ্রাম পানির তলায়। সরজমিন দেখা গেছে, শুধু ফেঞ্চুগঞ্জ কিংবা দক্ষিণ সুরমা নয়, বন্যায় এমন পরিস্থিতির শিকার সিলেটের কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী ছয় উপজেলার মানুষ। পানি বাড়ায় জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, দক্ষিণ সুরমায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সবই পানির নিচে। অনেকেই সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। সড়কের একদিকে মানুষ, অন্যদিকে গবাদিপশু থাকছে। প্রায় ৯ দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় বানভাসিদের মধ্যে দুর্ভোগ বেড়েই চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, ভারতের আসাম, শিলচর, মনিপুরে পাহাড়ি এলাকায় ভারি বর্ষণে কুশিয়ারা ও সোনাই নদীর পানি বাড়ছে। এর ফলে নদী দুটির কোথাও বাঁধ ভেঙে পানি আসছে, আবার কোথাও বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকছে। এতে শহর-গ্রাম সব জায়গায়ই পানি উঠেছে। এছাড়া মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ভারত থেকে আসা ফানাই-আনফানাই, কন্টিনালা ও জুড়ী নদী দিয়ে পানির ঢল নামছে হাকালুকি হাওরে। এর ফলে হাওরের পার্শ্ববর্তী

গ্রামগুলোও পানিতে ডুবে গেছে। রাস্তাঘাট ডুবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্ট পর্যটন কেন্দ্রও পানিতে তলিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের ৬০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে চলে গেছে। বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিয়ানীবাজার-সিলেট সড়ক যোগাযোগ। পাশাপাশি সিলেট থেকে বিয়ানীবাজার হয়ে জকিগঞ্জের সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। সিলেটের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা কমর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে বিয়ানীবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবিয়ে দিয়েছে। এর ফলে চারখাই, আলীনগর, শেওলা, দুবাগ, কুড়ারবাজার ও থানাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বালাগঞ্জ-খছরুপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানি বাড়ায় ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার, তাজপুর, দয়ামীর, বুরুঙ্গা, সাদিপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, উসমানপুর ও উমরপুর ইউনিয়নের পুরোটাই পানিতে তলিয়েছে।
সরজমিন দেখা গেছে, সিলেটের সুরমা তীরবর্তী এলাকার পানি ধীরে ধীরে নামলেও সিলেট মহানগরীর শেখঘাট, ঘাসিটুলা, কলাপাড়া, মনিকা রোড, নওয়াব রোড এবং শাহজালাল উপশহরের কিছু এলাকা এখনো পানিবন্দি রয়েছে। সিলেট মহানগরীর শাহজালাল উপশহরের উমর শাহ তেররতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গত ৯ দিনের মধ্যে শুধু একদিন ২৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের নেতৃত্বে চিড়া-মুড়ি দেয়া হয়েছিল। এরপর তারা গতকাল শনিবার পর্যন্ত সরকারি কোনো ত্রাণ পাননি। তবে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় তারা দিনাতিপাত করছেন।
সিলেট বিভাগের যেসব এলাকায় পানি কমে গেছে সেসব এলাকার বাসিন্দারা এখন নতুন আরেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। ঘরের পর জীবিকা নির্বাহের একমাত্র ভরসা গরু ছাগল, গোলা ভরা ধান হারিয়ে আবার নতুন করে নামবেন জীবনের মাঠে। শুরু হবে টিকে থাকার আরেক লড়াই। পানি কমায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন বন্যার্তরা। নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন।
সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের জইকার কান্দিগ্রামের আক্কাস আলীর ঘর চুরমার করে দিয়েছে বানের পানি। ঘরের ভিটে ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। পানি কমায় গত বৃহস্পতিবার আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরে এই অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েন তিনি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঘরের চালের টিন কুড়াতে কুড়াতে তিনি বলেন, পানি তো নামছে। কিন্তু আমাদের সব নিয়া গেছে। পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। এখন ঘর মেরামত করব কী করে? ঘর ভেঙে যাওয়ায় পরিবারের অন্য সদস্যদের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে আনতে পারছেন না বলে জানান তিনি।
একই ইউনিয়নের পশ্চিম দর্শা গ্রামের শামছুননাহার নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয় বন্যার সময়। মৃত্যুর পর পারিবারিক কবরস্থানে কবর খনন করা হয়, কিন্তু মাটি দেয়া সম্ভব হয়নি। বন্যার কারণে কবর বারবার পানিতে ভরে যাচ্ছিল। উপায় না দেখে স্বজনরা মরদেহ সিলেট শহরের মানিকপীর (রহ.) গোরস্থানে নিয়ে জানাজা শেষে দাফন করেন। পুরো সিলেটজুড়ে এ রকম বহু করুণ ঘটনার জন্ম দিয়েছে এবারের বন্যা।
ভয়াল বন্যার ঢেউ ভেঙে দিয়েছে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুড়িগ্রামের মো. সুহেল মিয়ার মাটির ঘর। বর্তমানে তিনি স্ত্রী, তিন মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে আছেন স্থানীয় একটি স্কুলের আশ্রয় কেন্দ্রে। প্রতিদিন ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন কেউ না কেউ। আর সেই ত্রাণই এখন তিনবেলার ভরসা। সোহেল মিয়া বলেন, কেউ কেউ বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কোথায় যাব? আমার সন্তানদের নিয়ে থাকার মাটির ঘরটি তছনছ করে দিয়েছে বন্যা।
বন্যায় সিলেট বিভাগের বেশ কয়েকটি জেলার বহু পরিবার পথে বসেছে। অন্যের হাতের দিকে চেয়ে দিন পার করছেন। কেউ উপোস থাকছেন একবেলা-দুইবেলা। বাড়ি থাকা সত্ত্বেও অন্যের বাড়িতে থাকছেন। শহরউল্লা তাদের একজন। তিনি একটি মসজিদে ইমামতি করেন। কিন্তু বন্যার পানি তার কাঁচা ঘরটি একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এখন মাসহ পরিবারের বেশ কয়েকজন থাকছেন অন্যের বাড়িতে। কয়েকটি নতুন টিন আর বেড়ার জন্য তিনি ঘরে ফিরতে পারছেন না।
বন্যার পানি নামার পর সিলেটের নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন বহুমুখী সমস্যায়। বাড়ি ফেরার পর পড়েছেন রীতিমতো বেকায়দায়। এখন কেবল নেই আর নেই। ঘর নেই। টিন নেই। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন গরু নেই, ফসল নেই। কোথাও কাজ নেই।
এদিকে সিলেট বিভাগের সাধারণ মানুষের সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্যার পানি ঢুকে নষ্ট করে দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি। এমআরআই, সিটিস্ক্যান, রেডিও থেরাপির মতো মেশিনারিজে পানি ঢুকে গেছে। ফলে বন্ধ রয়েছে এই সেবা কার্যক্রম। সেই মেশিনগুলো পুনরায় চালু হবে কিনা- এখনো নিশ্চিত নয় কর্তৃপক্ষ। শুধু ওসমানী হাসপাতাল নয়- সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাথমিক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ১১টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই বন্যাকবলিত। এতে নষ্ট হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগবালাই নিয়ে আসছেন রোগীরা।
সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, চলমান বন্যা স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। অবকাঠামো এমনকি, যন্ত্রপাতি নষ্ট করে দিয়েছে। অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখনো পানি রয়েছে। তবুও চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, পানি নামছে। কিন্তু বাড়ছে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ। বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পানিবাহিত রোগ নিয়ে লোকজন আসতে শুরু করেছেন। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, ডক্সিসাইক্লিন ওষুধের সংকট হতে পারে। সাধারণত জুনে ওষুধ কেনা হয়। এখন ওষুধের স্বল্পতা সব জায়গায়ই রয়েছে।
সিলেট বিভাগের বন্যায় আক্রান্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিভাগের মোট ৪০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ২৪টি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। ৮৫টি ইউনিয়ন সাব-সেন্টারের মধ্যে আক্রান্ত ৩১টি। সুনামগঞ্জের ৯২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৪১৪টি নিমিজ্জিত হয়। বন্যাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন ৪৭ জন। আর ৪৫ লাখ ৫৫ হাজার ৭০১ জন মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছেন।
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, পুরো বিভাগে ৪৫ লাখ পানিবন্দি। এর মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে ৪ লাখ ১৪ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা তাদের বন্যার্ত হিসেবে চিহ্নিত করে ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছি। বাকিরা কীভাবে সরকারি ত্রাণ পাবেন তার ব্যাখা তিনি দিতে পারেননি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়