স্বপ্নজয়ের পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

আগের সংবাদ

হাওর জনপদে স্বাস্থ্যসেবা ‘নেই’

পরের সংবাদ

প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি ও সেবনে বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা : নীরব মহামারির আরেক নাম ‘এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধে দেশে নানারকম নির্দেশনা থাকলেও অধিকাংশ ফার্মেসিই তা অনুসরণ করে না। ফার্মেসিতে গিয়ে যে কেউ জ¦র, সর্দি, কাশি, গ্যাস্ট্রিক, ব্যথানাশক এমনকি এন্টিবায়োটিক ওষুধ চাইলেও তা মিলছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ খেয়ে সাময়িক আরোগ্য মিললেও ভবিষ্যতে এর প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ তা ভাবছেন না কেউই। এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি সেই পরিবর্তিত ব্যাকটেরিয়া অন্যদের শরীরে ঢুকে একইভাবে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যমান না হলেও এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যে মহামারি রূপ নিচ্ছে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৯ সালে ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের ওপর কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশের বেশি নাগরিক নিজেরা দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়ে থাকেন।
কোন ওষুধে কী ক্ষতি : চলতি বছরে ২২ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় বলা হয়, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের বড় অংশ বিক্রি হচ্ছে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া। অথচ মাত্রাতিরিক্ত গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবনে ৪৫ শতাংশ গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়। এছাড়া শরীরে নানা ধরনের জটিলতা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার, স্মৃতিভ্রম হতে পারে। ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম কমে আসতে পারে। জ্বর বা শরীর ব্যথার কারণে অনেক সময় চিকিৎসকরা এসিটামিনোফেন বা প্যারাসিটামল লিখে থাকেন। বিভিন্ন কোম্পানি এটি নানা নামে বিক্রি করে থাকে। কীভাবে, কতদিন খেতে হবে, সেটা চিকিৎসকরা উল্লেখ করে দেন। কিন্তু পরে রোগীরা জ্বর বা গা ব্যথা হলেই এটা কিনে খেতে থাকেন। ফলে একসময় এটা কার্যক্ষমতা হারায়। প্যারাসিটামল দীর্ঘদিন খেলে যকৃতের ক্ষতি হতে পারে। আরেকটি খুব প্রয়োজনীয় ওষুধ হচ্ছে অ্যাসপিরিন। যাদের হার্টের ওষুধ ও ডায়াবেটিস আছে- তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেন। কিন্তু ইচ্ছেমতো এই ওষুধটি খাওয়া হলে একপর্যায়ে খাদ্য থলি ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। গা ব্যথা, হাত-পা ব্যথা বা মাথা ব্যথার জন্য অনেকে আইবুপ্রোফেন অথবা ডাইক্লোফিনাক জাতীয় ওষুধ খান। এসব ওষুধ দীর্ঘদিন খেলে হজম শক্তি কমে যায়, আলসার হয়, পাকস্থলির ক্ষতি ও রক্তক্ষরণ হতে পারে। অনেকের হাতে-পায়েও পানি চলে আসতে পারে। এলার্জি বা সর্দি-কাশির জন্য অনেকে জেনেরিক নাম ক্লোরফেনিরামিন ট্যাবলেট বা হিস্টাসিন খেয়ে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই ওষুধ খেলে এটার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। পেট খারাপ হলেই সেবন করা হয় মেট্রোনিডাজল গ্রুপের ওষুধ। যা

এক ধরনের এন্টিবায়োটিক। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় র?্যাশ ওঠা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তক্ষরণ, পেটে ব্যথা, মলদ্বার ফেটে যাওয়ার সমস্যাও হতে পারে। আবার অনেকে পায়খানা নরম করার জন্য ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ খান। যা বেশি খেলে শরীরের ইলেট্রোলাইট ইমব্যালান্স হতে পারে।
নীরব মহামারির আরেক নাম এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স : চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে যে সমস্যাটি হচ্ছে সেটিকে নীরব মহামারি বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এন্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যেসব এন্টিবায়োটিক সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত বলে সংস্থাটি বলছে, সেগুলো বাংলাদেশে অনেক বেশি ব্যবহার হচ্ছে। যে সব ওষুধের ব্যবহার ৪০ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা উচিত বলে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে তা প্রায় ৭০ থেকে ৮৮ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে বাজারে প্রচলিত ২০ থেকে ২৫ ধরনের এন্টিবায়োটিক বিক্রি হয়, যা আইসিইউতে অধিকাংশ রোগীর শরীরে রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রতি ১ হাজার জনে এন্টিবায়োটিক ডোজের ব্যবহার ছিল ১৬ দশমিক ৬৫। ২০২০ সালে তা দেড় গুণ বেড়ে হয়েছে ২৫ দশমিক ৩৭। জরুরি এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা যে কমে গেছে তা সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত আরেক রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট। চলতি বছরের ১৮ মে প্রকাশিত দক্ষিণ কোরিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ডায়রিয়া ও মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণে দেশে ব্যবহৃত ১৪টি এন্টিবায়োটিক কোনো না কোনো মাত্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে এম্পিসিলিন ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে আর ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ইমিপেনেম।
এদিকে কোন বয়সে বেশি এন্টিবায়োটিক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সে বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী-পুরুষরা সবচেয়ে বেশি এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার ২২ শতাংশ। এদের মধ্যে পুরুষ ৫৩ শতাংশ এবং নারী ৪৭ শতাংশ। এর পরই আছে ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা। তাদের মধ্যে এই হার ১৬ শতাংশ। জীবাণুর বিরুদ্ধে অকার্যকর প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ এন্টিবায়োটিক। ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সি পুরুষের তুলনায় নারীর মধ্যে রেজিস্ট্যান্স বেশি।
আরেকটি ঝুঁকি নিয়েও শঙ্কিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর ওপরেও এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়, যা কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, মাটিতে রয়ে যায়। এর ফলে আমরা যা খাই, সবজি, ফল বা মাছ-মাংসের মধ্যে থেকে যাওয়া এন্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীরে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে থাকে।
গবেষণায় ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এই ১০ বছরে ৪২টি এন্টিবায়োটিক এলেও ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মাত্র এসেছে ২১টি। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এসেছে মাত্র ৬টি এবং ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মাত্র ৯টি নতুন এন্টিবায়োটিক এসেছে। শিগগিরই নতুন কোনো এন্টিবায়োটিক আসার সম্ভাবনাও কম। সতর্ক না হলে বিপদ আরো বাড়বে বলে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা।
এন্টিবায়োটিক সম্পর্কে জ্ঞান নেই বিক্রেতাদের; হচ্ছে লাল মোড়ক : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশেরও বেশি খুচরা ওষুধ বিক্রেতার এন্টিবায়োটিক ওষুধ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। এমনকি তারা সহজে এই ওষুধ শনাক্ত করতে পারে না। এন্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার রোধ এবং এই ওষুধ যাতে সহজে চেনা যায় সে জন্য এ ওষুধের মোড়কে সরকার পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এ জাতীয় ওষুধের মোড়কের বড় অংশজুড়ে লাল রঙে লেখা থাকবে এন্টিবায়োটিক। এছাড়া মোড়কে লেখা থাকবে ‘চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করবেন না’। আগামী ৬ মাসের মধ্যেই ওষুধ কোম্পানিগুলোকে এই নির্দেশনা কার্যকর করতে বলেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। শুধু তাই নয় ওষুধ আইনে প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত করা হয়েছে। এই অপরাধের জন্য ২০ হাজার টাকা জরিমানারও বিধান রাখা হচ্ছে।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা : বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসকরা ওষুধ লিখবেন। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় অতিমাত্রায় ওষুধ ব্যবহার বড় বিপর্যয় ডেকে আনছে। একটা সময় মনে করা হতো এন্টিবায়োটিক যে কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে অব্যর্থ। অথচ জীবনরক্ষাকারী এই ওষুধও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এই ওষুধও কাজ করছে না। যত্রতত্র এবং অতিরিক্ত ওষুধ ব্যবহার কমাতে নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমাদের প্রথমদিকের কিছু ওষুধ কাজ করছে না, যে ওষুধগুলো রিজার্ভ থাকার কথা সেগুলোও থাকছে না। সে জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সুপার বিশেষজ্ঞ কী ওষুধ লিখতে পারবে তা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। সেই সঙ্গে প্রেসক্রিপশন পরীক্ষা হবে, কোনো অযৌক্তিক ওষুধ লেখা হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিএসএমএমইউ ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি এখন নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে আছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে পরবর্তী যে মহামারিটি হবে সেটি হবে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্রেন্স বা রেজিস্ট্রেন্স ব্যাক্টেরিয়া মহামারি। এর জন্য আমরাই দায়ী। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করে ওই ওষুধের সঙ্গে আমরাই ব্যাক্টেরিয়ার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। ২ লাখের বেশি ফার্মেসি থেকে গড়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ জনের কাছে প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক বিক্রি করা হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কারণে কিছু ব্যাকটেরিয়ার পরিবর্তন ঘটে। যেগুলোর বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে নতুন কোনো এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার হচ্ছে না। নতুন এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতে না পারলে ওষুধ থাকার পরও সেগুলো প্রয়োগ করেও রোগীর জীবন বাঁচানো যাবে না। চিকিৎসকসহ সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বিপণন ব্যবস্থা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়