স্বপ্নজয়ের পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

আগের সংবাদ

হাওর জনপদে স্বাস্থ্যসেবা ‘নেই’

পরের সংবাদ

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন : দক্ষিণ জনপদে উচ্ছ¡াসের ঢেউ

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ ডেস্ক : স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে দক্ষিণ জনপদে বইছে উচ্ছ¡াসের ঢেউ। এতে করে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক দ্বার উন্মোচিত হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতা আর দৃঢ়তায় উত্তাল পদ্মায় দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা সেতু। গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করলেন। পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনে এ পদ্মা সেতু বিশাল এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করল। এ সেতু নির্মাণ বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির কারণে একটি যুগান্তকারী অর্জন। এ সেতু উদ্বোধনে মহাখুশি সর্বস্তরের মানুষ। এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট-
জাহাঙ্গীর আলম ও মিঠুন রায়, বাংলাবাজার ফেরিঘাট থেকে : সব প্রতীক্ষার অবসান শেষে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সারা জাতির বহুল আকাক্সিক্ষত পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন করা হলো। এর সঙ্গে পূরণ হলো জাতির পিতার একটি স্বপ্ন। পূরণ হলো দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানষের। অর্থনৈতিক মুক্তির এ সেতু উদ্বোধনে মহাখুশি সর্বস্তরের মানুষ।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা স্থল শিবচরের বাংলাবাজারে লাখো লাখো মানুষের ঢল নেমেছে। দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশের নেতাকর্মীরা ভোররাত থেকে জনসভা স্থলে আসতে শুরু করেন। সকাল ৭টার মধ্যে জনসভা স্থল কানায় কানায় ভরে যায় । দূর-দূরান্ত থেকে আগত সবাই উচ্ছ¡াস প্রকাশ করে বলেন, শেখের বেটিকে সামনে থেকে এক নজর দেখেতে পেরে তারা মহাখুশি। এ সময় খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী বিভাগের ২১ জেলা থেকে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ, লঞ্চ, ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনে মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে আসেন দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। পরে পাঁচ্চর এলাকায় এলে সেখান থেকে

যানবাহনগুলো অ্যাপ্রোস সড়কে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এতে পাঁচ্চর থেকে বাংলাবাজার ঘাট পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার এলাকজুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। অনেকেই এই দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে জনসভা স্থলে পৌঁছেছেন। নেতাকর্মীদের মধ্যে ছিল আনন্দ আর উল্লাস। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর নৌকার আদলে যানবাহন বানিয়ে পুরো জনসভা স্থল ঘুরছেন। এছাড়া প্রবাস থেকে অনেকেই এই সমাবেশে যোগ দিতে ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন।
এদিকে জনসভা শেষে সবাই নিরাপদে বাড়ি চলে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে প্রশাসনেরে পক্ষ থেকে। এখানে এসএসএফ, ডিজিএফআই, এনএসআই, জেলা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, নৌপুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া প্রতি মুহূর্তে আপডেট তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে শুধু জনসভা স্থলই নয়, সারদেশেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা প্রস্তুত বাহিনীর সদস্যরা।
৭০ বছরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস উদ্দিন এসেছেন খুলনা থেকে। সকাল সাড়ে ৬টায় আসেন জনসভা স্থলে। চেখেমুখে তার খুশির ঝিলিক। সারা রাত গাড়িতে অনেক কষ্ট করে এলেও তার কোনো ক্লান্তি নেই। তিনি বলেন, ‘আমার অনেক কষ্ট অইছে। তয় এহন আর কষ্ট নেই। শেখের বেটিকে সামনাসামনি দেখতে এহন আর কোনো কষ্ট মনে হয় না।’
শরীয়তপুরের কৃষক আব্দুর রহমান জানান, ‘মুই একজন কৃষক মানুষ। কষ্ট করে অনেক শাকসবজি চাষ করি কিন্তু কোনো দাম পাই না। তয় এবার ব্রিজ হওয়াতে মোরা এহন সরাসরি ঢাকায় মোগো শাকসবজি নিয়া যামু। এতে ভালো দাম পামু।’
বরিশালে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত আনিচ মিয়া জানালেন, ‘যেখানে আ.লীগের মিটিং হয় মুই আর ঘরে থাকতে পারি না। মুই লঞ্চে আইছি। শেখ হাসিনার দেইখ্যা মনটা ভরে।’
পদ্মায় পিনাক-৩ নামের লঞ্চডুবিতে স্বজন হারানো কাজি সবুজ বলেন, ‘আমার জীবনের বড় ট্র্যাজেডি পদ্মা নদী। এই নদীতে লঞ্চডুবিতে স্ত্রী-সন্তান হারিয়েছি। অনেক কষ্ট-যন্ত্রণা পেয়েছি। তারপরও অনেক কষ্ট ভুলে গেছি কেবল পদ্মা নদীতে সেতু হওয়ায়। আমার মতো স্বজন হারানোদের একমাত্র সান্ত¡না পদ্মার বুক চিরে সেতু দৃশ্যমান। আর কাউকে নৌদুর্ঘটনায় তাদের স্বজন হারাতে হবে না।’
সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে পদ্মা পাড়ে বইছে আবেগ আর উচ্ছ¡াস।
এম কে রানা, বরিশাল থেকে : বরিশালের রাজনীতিবিদ, বিশিষ্টজন ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করছেন, পদ্মা সেতুর কল্যাণে বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে বরিশাল হতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের রাজধানী। এ সেতুর শুধু শিল্প খাতেই নয়, সুফল পাওয়া যাবে কৃষি ও পর্যটন খাতে। দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন তথা জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন দুয়ার খুলে যাবে।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানান, পদ্মা সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাই পাল্টে দেবে না, দক্ষিণের সমাজকেও আমূল পাল্টে দেবে। কৃষিনির্ভর এ অঞ্চলে গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। বেকারত্বের অবসান হবে। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় অবসান হবে ভোগান্তির।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বলেন, পদ্মা সেতু বরিশাল অঞ্চলের মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে এই পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের মেগা প্রকল্প বাংলাদেশে তৈরি হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। এই সেতুর ফলে বড় বড় বিনিয়োগকারী আরো আকৃষ্ট হবেন বলে আশা করেন তিনি।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় আগামী দিনে দক্ষিণাঞ্চল হবে সবচেয়ে উন্নত এলাকা। এটি আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংযোগ, কর্মসংস্থান, পর্যটন এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সুযোগ প্রসারিত করবে। নিঃসন্দেহে এটি জাতীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে অবদান রাখবে। দক্ষিণাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন হবে।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে মহানগরীতে যারা উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে চান তাদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
বরিশাল বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিক বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের বিনিয়োগ ব্যবস্থার দ্বার খুলে দিয়েছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে এ অঞ্চলের মৎস্য, কৃষি, পর্যটন, অবকাঠামোসহ সব খাতের প্রসার ঘটবে।
সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে এক ভাগ প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে। এতে সারাদেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে শূন্য দশমিক ৬ ভাগ। তবে এ ক্ষেত্রে এখনই বৃহৎ পরিকল্পনা ও পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণের ২১ জেলার আর্থসামাজিক এবং শিক্ষা খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এতে দেশের অন্য সব অঞ্চলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সমভাবে এগিয়ে যাবে বরিশালের শিক্ষা খাত।
বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, পদ্মা সেতু একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত প্রচেষ্টা আর অসীম সাহসিকতায় নির্মিত পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন হলো। এতে করে দক্ষিণাঞ্চল তথা সমগ্র দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
ভোলা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মমিন টুলু বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় পিছিয়ে থাকা এ জেলাটি এখন পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করবে। পুরো ভোলার অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু হবে একটি নতুন মাইলফলক।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ মোতালেব শরীফ বলেন, পদ্মা সেতু কুয়াকাটা পর্যটন ব্যবসায়ীদের জন্য আশীর্বাদ। ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে এবং পর্যটন ব্যবসায়ীদের সুদিন ফিরে আসছে। আর সেই সুদিনের সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পটুয়াখালী জেলার প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াকাটায় পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। গড়ে উঠবে অভিজাত মানের ফাইভ স্টার হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও বিনোদন কেন্দ্র। বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। গড়ে উঠবে শিল্পকলকারখানা। মৎস্য, কৃষিপণ্য পরিবহনসহ যাতায়াতে দুর্ভোগ লাঘব হবে।
ঝালকাঠি শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি মো. সালেহ উদ্দিন সালেক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় আরো সহজ হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিনিয়তই গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁসহ নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তাতে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও।
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঝালকাঠিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবেন ঝালকাঠির কৃষকরা। এটির ফলে দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
পিরোজপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হাবিবুর রহমান মালেক বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হলো। বদলে যাবে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা। এখন আর আমাদের নদীপথের উপরে নির্ভর করে থাকতে হবে না। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। এ অঞ্চলের কৃষি তথা ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সূচনা হলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়