পদ্মা সেতু উদ্বোধন : বুয়েটে ক্লাস বন্ধ থাকবে ২৫ জুন

আগের সংবাদ

বর্ণিল উৎসবে খুলল দখিন দুয়ার

পরের সংবাদ

সর্বস্বান্ত মানুষের বাঁচার লড়াই

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও জয়ন্ত কুমার সরকার, সুনামগঞ্জের দুর্গত এলাকা থেকে : মহাপ্লাবনে নিজের সংসারের সব তছনছ। যন্ত্রজীবনের জরুরি পণ্য কম্পিউটার, ক্যামেরা, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল চার দিন ডুবে থেকে প্রায় শেষ। গত ২০ বছরের সংগৃহীত প্রায় দুই হাজার বইও ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। যা আর কখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। সার্টিফিকেট, জরুরি কাগজতো

আছেই। মজুতকৃত খাবার বাদে সংসারের নিত্য সব উপকরণ নষ্ট হয়ে গেছে। বিছানা, বালিশ, লেপ-তোষক থেকে এখনো চুইয়ে পড়ছে পানি। উড ফার্নিচারের জিনিসপত্র ব্যবহারের আশা বাদ দিয়ে দিয়েছি। বানভাসি হিসেবে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে যে সপরিবারে বেঁচে আছি এটাই বড় বিস্ময়। গতকাল শুক্রবার ঠিক এভাবেই সুনামগঞ্জের সংবাদকর্মী শামস শামীম বন্যায় সবকিছু হারানোর বর্ণনা দিলেন।
গত ১৭ জুন শুক্রবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিপাতের সঙ্গে আশঙ্কাজনকভাবে পানি বাড়তে শুরু করে। ওই রাতে চলে যায় বিদ্যুৎ। বন্ধ হয়ে যায় মোবাইলসহ সব ধরনের নেটওয়ার্ক। শনিবারের মধ্যে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা সদরসহ সব কিছু পানিতে তলিয়ে যায়। প্রধান প্রধান সড়কে কোমর ও পেট সমান পানি হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল। ৮ দিন পরও সব জায়গায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। নজিরবিহীন এই বন্যার জেরে মানুষ বিপর্যস্ত। ঘরবাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবেন? ভেবে পাচ্ছেন না। তাদের কাছে খাবারও নেই। বিদ্যুৎহীন হয়ে আছে বহু এলাকা। ফলে পানির মধ্যেই অন্ধকারে চলছে মানুষের জীবনযাপন। অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতি চতুর্দিকে। ওই জেলার কমপক্ষে ২৫ লাখ মানুষ এখনো ‘জলের তলায়’। বানের পানির তোড়ে ডুবে গেছে ঘরবাড়ি। হারিয়ে গিয়েছে শেষ সম্বলটুকুও। না আছে আশ্রয়, না আছে অন্ন। প্রতি মুহূর্তে পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। অনির্বাচনীয় ‘জলসন্ত্রাসের’ শিকার সুনামগঞ্জের অধিবাসীরা।
সাধারণের এই দুঃখ-দুর্দশার দিকে খুব একটা ভ্রæক্ষেপ নেই স্থানীয় রাজনীতিকদের। দুর্গমের দুর্গতদের পাশে প্রশাসনও সক্রিয়ভাবে দাঁড়াচ্ছে না। গাফিলতির নজির চারদিকে। খামখেয়ালিপনার কারণে ‘কর্তা ব্যক্তিদের’ ওপর চরম বিরক্ত বন্যার্তরা। বৃহত্তর সিলেট বিভাগে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ। সেখানে গত কয়েক দিন ধরে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ত্রাণের নৌকা দেখলেই তীরে দাঁড়িয়ে নৌকা ভেড়ানোর জন্য বন্যার্তরা কাতরভাবে ডাকছেন। নারী-পুরুষ হাতজোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে আহ্বান জানাচ্ছেন। নৌকা ভিড়লেই বানের মতো ছুটে আসছেন মানুষ- একমুঠো ত্রাণ নিতে। কিন্তু বিপত্তি হলো, পানিতে তীরও ডুবে আছে, সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। জড়ো হওয়া বন্যার্তরা মনে করছেন ত্রাণ পাবেন না। তাই অন্যদের সরিয়ে নিজে এগিয়ে যেতে চান, আগে থাকতে চান। চরম হুড়োহুড়ি, কাড়াকাড়ি, মারামারি অবস্থা। নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার অবস্থা। আমার আগে চাই- এই মানসিকতা সবার। ত্রাণ দিতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় কিছু ত্রাণ দেবার পর সঙ্গত কারণেই ফিরে আসতে হচ্ছে। এতে বহু মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ শহরে ঢোকার মুখে শান্তিগঞ্জ থানা পুলিশের এসআই পার্ডন কুমার সিংহের সঙ্গে দেখা হয়। বন্যা নিয়ে কথার জবাবে তিনি বলেন, বন্যায় সুনামগঞ্জের ভয়াবহ অবস্থা। বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাড়িঘরের মানুষ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে ছুটাছুটি করেন। কেউ কাউকে সহযোগিতা করার মতো অবস্থায় ছিল না। কারো দিকে কারোর তাকানোর সুযোগ নেই। নেটওয়ার্ক না থাকায় কেউ কারো খবরও নিতে পারেননি।
একটু মাথাগুজার ঠাঁই পাওয়ার আশায় নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধবণিতা পানিতে হেঁটে, বৃষ্টিতে ভিজে ছুটে চলেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। আশ্রয় নেয়া সেই উঁচু স্থানটিও একপর্যায়ে তলিয়ে যায়। এরপর আবারো আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলে মানুষ। এক কথায় দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। এ সময় তাদের সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় কাপড়সহ অল্প জিনিসপত্র নিয়ে এলেও সব মালামাল পানিতে ডুবে যাওয়ায় বাড়ি তালাবদ্ধ করে রেখে আসেন।
গবাদিপশু নিয়ে মানুষ ছিলেন দিশাহারা। অনেকে প্রধান সড়কে গবাদিপশু বেঁধে রাখেন। তবে ঘরে থাকা ধানসহ অন্যান্য মালামাল ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। তখন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানহীন মানুষের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। যা নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারেন না। কার্যত অচল ছিল সবকিছু।
গতকাল শুক্রবার জেলা শহরটি ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এখনো জেলার অনেক এলাকার রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে পানি রয়েছে। ফলে বানভাসিদের বাড়ছে দুর্ভোগ।
এদিকে সুনামগঞ্জ পৌর শহর থেকে বন্যার পানি কমলেও দুর্ভোগ বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় ময়লা আবর্জনা আটকা পড়ে পানিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানিবন্দি মানুষ ও পৌর শহরের বাসিন্দারা জানান, শহর থেকে পানি কমলেও এখন দুর্গন্ধের কারণে চলা ফেরা করা যাচ্ছে না। এ ময়লা আবর্জনাগুলো দ্রুত অপসারণ দরকার। উত্তর আরপিন নগর এলাকার বাসিন্দা রুহুল আমিন বলেন, শহর থেকে বন্যার পানি কমলেও নতুন করে আমাদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। শহরের চারদিকে এত গন্ধ, বাসা থেকে বের হতে পারছি না।
জেলার সুরমা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। তবে কুশিয়ারার তীরবর্তী এলাকা বানের পানিতে নতুন করে ডুবছে। সবমিলিয়ে পুরোপুরি পানি না কমার কারণে দুর্ভোগে রয়েছেন ছাতকের নি¤œাঞ্চলের মানুষজন। এর ফলে আশ্রয় কেন্দ্রে এখনো রয়েছেন বহু মানুষ।
স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যার পানিতে ডুবে কেবল ছাতকেরই বিভিন্ন এলাকায় এক শিশুসহ আটজনের মৃত্যু ঘটেছে। সারাদেশের সঙ্গে এখনো ছাতকের সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি। ছাতকের প্রধান রাস্তাসহ গ্রামীণ রাস্তাগুলো ভেঙে গেছে। রেললাইনের নিচের মাটি সরে গেছে। ভয়াবহ বন্যায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কয়েক হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি। ঘর হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়েছেন অনেক মানুষ।
বন্যার পানিতে ভেসে গেছে হাজার হাজার গবাদিপশু। উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় নৌকা ও সড়ক যোগাযোগ না থাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে পারছে না বিভিন্ন দাতা সংস্থা। ভয়াবহ বন্যায় এ অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। বন্যায় প্লাবিত হয়েছিলো পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন। খাদ্যের জন্য এখন মানুষ হাহাকার করছে।
দিরাইয়ের চান্দপুর গ্রামের সরকারি ঘর পাওয়া কিরণ বর্মন জানান, এখনো বন্যায় ঘরের চালা অব্দি পানি। পরিবার নিয়ে উঠেছেন দিরাই বিএডিসি ভবনে। তিনি বলেন, নরম মাটিতে সরকারি ঘরটি নির্মিত হয়েছে। পানি সরে যাওয়াতে বাড়ি গিয়ে দেখি দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটল দেয়া ঘরে পরিবারের কেউই উঠতে চাইছে না। যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। পরিবার নিয়ে কোথায় থাকব? সে চিন্তায় আছি। গতকাল উপজেলার রফিনগরের সাদিরপুর আশ্রয় কেন্দ্রের সামনে পানিতে ডুবে ১১ মাস বয়সি এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
একজন স্বেচ্ছাসেবী জানান, বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে যারা পাচ্ছে তারা প্রচুর পরিমাণে পাচ্ছে। আবার অনেকে একেবারেই পাচ্ছে না। তারা খুব সংকটে রয়েছে। এ চিত্র সিলেট বিভাগের সব জায়গায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়