পদ্মা সেতু উদ্বোধন : বুয়েটে ক্লাস বন্ধ থাকবে ২৫ জুন

আগের সংবাদ

বর্ণিল উৎসবে খুলল দখিন দুয়ার

পরের সংবাদ

যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে তারা আমাকে টার্গেট করেছিল : সৈয়দ আবুল হোসেন

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পদ্মার বুকে নির্মিত হয়েছে স্বপ্নের সেতু। বাঙালির আবেগে বাধা পড়েছে প্রমত্ত নদীর এপাড়-ওপাড়। পদ্মা সেতু নির্মাণের সূচনালগ্নে বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। সে সময় পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। সেই অভিযোগের চাপ সামাল দিতে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় সৈয়দ আবুল হোসেনকে। যদিও পরে প্রমাণ হয়, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। পুরো অভিযোগটি ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। তবে দমে যায়নি বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসম সাহসিকতা ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে অবশেষে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয় বাঙালির গর্বের সেতু। কিন্তু তত দিনে পদ্মার বুকে জল গড়িয়েছে অনেক। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এই সময়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের অনুভূতি কী। সেই সময়ের ঘটনাবলি কীভাবে বিশ্লেষণ করেন তিনি। এ বিষয়ে কথা বলেছেন ভোরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের সিনিয়র রিপোর্টার কামরুজ্জামান খান। প্রশ্নোত্তর আকারে তা তুলে ধরা হলো পাঠকের সামনে।
ভোরের কাগজ : পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে, আপনার অনুভূতি কী?
আবুল হোসেন : আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটা খুশির খবর। আমার জন্যও আনন্দের খবর। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রোপণ ও জাগ্রত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব বাধা মোকাবিলা করেছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ করে নিজেদের সক্ষমতা, আন্তরিকতা, জন-অঙ্গীকার ও সততার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আমার ভালো লাগছে এই ভেবে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণ করে ষড়যন্ত্রকারীদের অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ করে সব ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছেন।
আপনারা জানেন, আমি পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি পর্যায়ে যোগাযোগমন্ত্রী ছিলাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং অপমানের তীর সরাসরি আমাকে আঘাত করেছিল। আমার কাজকে বিতর্কিত এবং আমার আন্তরিকতা ও সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তী সময়ে দুদকের তদন্ত ও কানাডার আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হই। ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র ও অপবাদ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আসলে ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতুর নির্মাণ বিলম্বিত করা। দেশের মানুষের আকাক্সক্ষাকে বিনষ্ট করা এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা। প্রধানমন্ত্রী তাদের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করেই সরকারের সততা ও আন্তরিকতা প্রদর্শনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তুতিপর্বে সরকার এবং যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আমার যে কোনো অনিয়ম ছিল না, তা প্রমাণ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে সরকার ও যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আমাদের সততা, আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে তাই আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। পদ্মা সেতুর এ সাফল্য এককভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও ভিত্তিহীন অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত করে আজকের পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। এই সেতু দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রাক্কালে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
ভোরের কাগজ : আপনার বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল- এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য কী?
সৈয়দ আবুল হোসেন : আমার বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছিল- তা ছিল ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যমূলক ও সম্পূর্ণ অসত্য। উদ্দেশ্য ছিল- পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সময় দীর্ঘায়িত করা এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। সরকারের জন-অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করা এবং সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। আপনারা জানেন, দুই বছরে আমি পদ্মা সেতুর প্রস্তুতিকাজ শেষ করে এনেছিলাম। ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনসহ যাবতীয় আনুষঙ্গিক কাজ এবং মূল সেতুর দরদাতা প্রাক-যোগ্য নির্বাচন যথানিয়মে, বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনে এগিয়ে এনেছিলাম। নিজস্ব অর্থায়নে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কাজে দাতাসহ সব মহল সন্তুষ্ট ছিল। শুধু মূল সেতুর প্রাক-যোগ্য দরদাতা নির্বাচনে বিশ্বব্যাংকের একটি তদবির অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটি কার্যকর করতে অপারগতা প্রকাশ করার পরই বিশ্বব্যাংকের ধীরগতি পরিলক্ষিত হয় এবং আমার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপিত হয়। বিশ্বব্যাংক টিইসি নির্বাচিত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে প্রাক-যোগ্য দরদাতা চায়না কনস্ট্রাকশন কমিউনিকেশন কোম্পানিকে (সিসিসি) বিশ্বব্যাংকের কালোতালিকাভুক্তির কারণে বাদ দিতে বলে এবং একটি প্রাক-যোগ্যতায় অযোগ্য দরদাতা চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে কোয়ালিফাই করতে বলে। কারিগরি কমিটি প্রাক-যোগ্য কোয়ালিফাইড দরদাতাকে বিশ্বব্যাংকের তালিকাভুক্তির কারণে বাদ দেয়। কিন্তু প্রাক-যোগ্য ডিসকোয়ালিফাইড দরদাতাকে অভিজ্ঞতার জাল সার্টিফিকেট দেয়ায় কোয়ালিফাই করতে অস্বীকৃতি জানায়। ডিসকোয়ালিফাইড দরদাতাকে কোয়ালিফাই করার জন্য বিশ্বব্যাংক একাধিকবার তদবির করে। কিন্তু টিইসি তাকে যোগ্য করতে শেষ পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়ার আশঙ্কায় সিআরসিসি দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয় এবং সিআরসিসিকে যোগ্য করতে ব্যর্থ হওয়ার পরই বিশ্বব্যাংক ও সিআরসিসির স্থানীয় প্রতিনিধি আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে এবং স্থানীয় মিডিয়ায় প্রচারের মাধ্যমে একটি অশুভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ শুধু ভিত্তিহীন ও বানোয়াটই ছিল না, তা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত। যার ভিত্তি ছিল গালগল্প আর গুজব। এখানে বিন্দুমাত্র সত্য ছিল না, ছিল না কোনো বিবেচনাবোধ আর নৈতিকতা। পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনো ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি, কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি কিংবা কোনো অর্থও ছাড় হয়নি, এই পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল বিশ্বব্যাংকের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের একটি কূটকৌশল মাত্র। পরবর্তী সময়ে দুদকের তদন্ত এবং কানাডার আদালতের রায়ে আমাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলা হলে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ যে মনগড়া ও অসত্য তা প্রমাণ হয়।
ভোরের কাগজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে। আপনাকে যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপরই শুরু হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। প্রথম দিকে কীভাবে কাজ এগিয়ে নিয়েছিলেন?
সৈয়দ আবুল হোসেন : পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তাই যোগাযোগমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার প্রথম দিন থেকে আমি পদ্মা সেতু নির্মাণে মনোযোগী হই। পরামর্শ নিয়োগ প্রক্রিয়া, পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র আহ্বান, মূল সেতুর প্রাক-যোগ্য দরপত্র আহ্বান এবং সেতুর অর্থায়ন সংস্থা- বিশ্বব্যাংক, জাপানের জাইকা, ইসলামী উন্নয়ন সংস্থা এবং এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিই। স্বল্প সময়ে ভূমি অধিগ্রহণ করি। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ যাবতীয় কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসি। এমনকি প্রাকযোগ্য দরদাতা নির্বাচন প্রক্রিয়াও শেষ করি। যেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রস্তুতি কাজ করতে ১০ বছর লেগেছে, সেখানে মাত্র দুই বছরে আমরা পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি কাজ শেষ করেছি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সেতুর কাজ শেষ হবে, এটাই ছিল আমার মূল টার্গেট। এ টার্গেট নিয়েই দ্রুততার সঙ্গে আমি কাজ এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলাম। এ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও আইডিবির কাছে পদ্মা সেতুর পুনর্বাসন প্রকল্প ও কাজের অগ্রগতি প্রশংসিত হয়। কাজের দ্রুত অগ্রগতি, গুণগতমান ও স্বচ্ছতা দেখে সবাই মুগ্ধ হয়।
ভোরের কাগজ : বিশ্বব্যাংক সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ আনে, আপনাকেও অভিযুক্ত করা হয়। মন্ত্রিত্ব থেকে আপনি সরে দাঁড়ান। যদিও বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হয়নি। এসব বিষয়ে কিছু বলবেন কি?
সৈয়দ আবুল হোসেন : সব ডোনার এজেন্সির কো-অর্ডিনেটরের ভূমিকায় ছিল বিশ্বব্যাংক। তাই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি কাজের প্রত্যেক পর্যায় অবলোকন ও অনুমোদন করে। পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগের প্রতিটি পর্যায় বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনে অগ্রসর হয়। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি কমিটি ঠিকাদার নিয়োগ ও কনসালট্যান্ট নিয়োগের কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছিল। আমি আগেই বলেছি, প্রাক-যোগ্য ঠিকাদার নির্বাচনের একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর কারিগরি কমিটিকে একটি প্রাক-যোগ্য কোয়ালিফায়েড ঠিকাদারকে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত থাকার কারণে বাদ দিতে বলে এবং একটি প্রাক-যোগ্যতায় ডিসকোয়ালিফায়েড ঠিকাদারকে কোয়ালিফাই করতে বলে। কারিগরি কমিটি প্রাক-যোগ্য কোয়ালিফায়েড দরদাতাকে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্তির কারণে বাদ দেয়। কিন্তু প্রাক-যোগ্য ডিসকোয়ালিফায়েড দরদাতাকে যোগ্য করার বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও দরদাতা কোম্পানির অভিজ্ঞতার জাল সার্টিফিকেট দেয়ায় কোয়ালিফাই করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপরই তারা পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে বাধা দিতে থাকে এবং নানা কর্নার থেকে অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করে। উদ্দেশ্য, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা। বিশ্বব্যাংক সোজাপথে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে না পেরে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার নানামুখী অসৎ কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নেয়। আমার বিরুদ্ধে দেশে নানা প্রপাগান্ডা শুরু করে। প্রাক-যোগ্য দরদাতা প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট দিয়ে, স্থানীয় পত্রিকাকে প্রভাবিত করে, ভুয়া অভিযোগ দাঁড় করায় এবং পত্রিকায় প্রকাশ করে। যোগাযোগমন্ত্রীর অফিস মেরামত ও গাড়ি ক্রয়, কালকিনিতে ট্যাক্স প্রদত্ত অর্থে নির্মিত বাড়ি নিয়ে, সড়ক দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে, ১/১১-এর বিভীষিকাময় দিনে অন্যায়ভাবে দুর্নীতিবাজ বানানোর কথা একাধারে নিউজ করায়। এসব পত্রিকার পেপার কাটিং বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয় ইংরেজি অনুবাদ করে। এভাবে বিশ্বব্যাংক পত্রিকার তথাকথিত অসত্য ও ভিত্তিহীন রিপোর্টের ভিত্তিতে আমার ব্যক্তিগত ইন্টিগ্রিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং সে আলোকে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের প্রতিনিধি মিস গোল্ড স্টেইন আমাকে সেতু নির্মাণ কার্যক্রম ধীরগতিতে এগিয়ে নেয়ার অনুরোধ করেন। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতুর সমন্বয়ক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনৈক বিহারি এই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।
আমি যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সরে আসার পরও বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে এগিয়ে আসেনি। বিশ্বব্যাংক আমাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ার জন্য সরকারের ওপর অন্যায় চাপ দেয়। এবং পদ্মা সেতুতে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এনে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান আইনজ্ঞ লুইস মোরেনো ওকাম্পোকে ঢাকায় পাঠায়। ওকাম্পো ঢাকায় এসে প্রথমেই কাদের সঙ্গে, কোন কোন সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তা গণমাধ্যম জানে। দুদকের সঙ্গে বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি ওকাম্পো আমার বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে কোনো দুর্নীতি প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব এবং আমাকে অ্যারেস্ট করার কথা বলে। আমাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে বারবার অনুরোধ করেন। সার্বিক বিবেচনায় দেশের স্বার্থে, পদ্মা সেতুর স্বার্থে আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করি। তারপরও বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।
ভোরের কাগজ : আপনি যে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলেন, আপনার অনুপস্থিতিতে একইভাবে সে কাজ এগিয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণে আপনার সার্বিক মূল্যায়ন কী?
সৈয়দ আবুল হোসেন : আমি যে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলাম, তাতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালু হতো। এখন ৯ বছর পর পদ্মা সেতু চালু হলো। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হবে, প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পরও অহেতুক মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ নিয়ে অনেক সময় ক্ষেপণ করা হয়েছে। এছাড়া মূল সেতুর দরদাতা নির্বাচনে আমার রেখে আসা প্রাক-যোগ্য একজন বিডারকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর ঠিকাদার আমার রেখে যাওয়া প্রি-কোয়ালিফাইড বিডারদের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হলো। কিন্তু সুপারভিশন কনসালট্যান্ট নিয়োগে নতুনভাবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন আহ্বান করা হলো। অথচ এসএনসি-লাভালিনকে বাদ দিয়ে অন্যদের মধ্য থেকে সুপারভিশন কনসালট্যান্ট নির্বাচন করা সমীচীন ছিল। কারণ এর জন্যও সময় ক্ষেপণ করেছে। নতুনভাবে প্রি-কোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বানের ফলে কোরিয়ার মতো তুলনামূলকভাবে অনভিজ্ঞ সুপারভিশন কনসালট্যান্ট নিয়োগ পেল। যদি নতুন প্রি-কোয়ালিফাইড টেন্ডার আহ্বান না করে পূর্বের দ্বিতীয় সর্বনি¤œ প্রি-কোয়ালিফাইড বিডার মনসেল-এইকম নির্বাচিত হতো, তাহলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এক্ষেত্রে ঠিকাদার নিয়োগে এক নীতি এবং সুপারভিশন কনসালট্যান্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্য নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে সময়ক্ষেপণ ও নির্মাণ ব্যয় দুটোই বেড়ে গেছে। যখন নির্মাণ পর্যায়ে দেখা গেল নদীর তলদেশে শক্ত মাটি নেই, আছে তরল কাদা যা পাইলিংয়ের উপযুক্ত নয়। তখন বর্তমান ঠিকাদার, যারা নির্মাণ কাজে অভিজ্ঞ, তারা কেমিক্যাল ব্যবহার করে মাটি শক্ত করে পাইলিং করার পরামর্শ দেয়। তাদের এ পরামর্শ আমার আগের পরামর্শের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু অনভিজ্ঞ কনসালট্যান্ট সে পথে না গিয়ে গবেষণার নামে দুই বছর সময়ক্ষেপণ করল। ঠিকাদারের সেই পরামর্শ অনুযায়ীই বর্তমানে স্ক্রিন গ্রাউটিং পদ্ধতিতে কেমিক্যাল ব্যবহারের পথ বেছে নিল। ফলে সেতু নির্মাণে আরো দুই বছর সময়ক্ষেপণ হলো। ব্যয়ও বেড়ে গেল অনেক। নিজের টাকায় আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি- এটা গর্বের। তবে আমাদের যে এত অর্থ নেই, তাও ঠিক। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য আমাদের অনেক বিনিয়োগ রিশিডিউল করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে গেলে আমার পরিকল্পনা ছিল- ডিজাইন বিল্ট ফাইন্যান্সিংয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার। এ সম্পর্কিত সারসংক্ষেপ প্রধানন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করি। তিনি অনুমোদন দেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেন। সে সময় পদ্মা সেতুতে ডিজাইন বিল্ট ফাইন্যান্সিং করা সম্ভব হলে সরকারি অর্থের ওপর চাপ পড়ত না। ডিজাইন বিল্ট ফাইন্যান্সিংয়ে গেলে খরচ কম হতো। কারণ এক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব অর্থ বিনিয়োগ করতে হতো না। আমরা বিডারস ফাইন্যান্সিং বা পিপিপিতে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে পারতাম।
ভোরের কাগজ : আপনার নেতৃত্বেই পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার কথা। কানাডার আদালত ও দুদকে আপনার প্রতি অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। বিষয়টি খোলাসা করে বলুন?
সৈয়দ আবুল হোসেন : দেশের গণমাধ্যম পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অসত্য ও ভুয়া খবরকে উপজীব্য করে আমার বিরুদ্ধে ঢালাও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বেনামি চিঠির ভিত্তিতে বারবার একই বিষয়ে প্রতিবেদন করেছে। চ্যানেলগুলোয় খবরের কাগজগুলোর রিপোর্টকে উপজীব্য করে টকশোতে বুদ্ধিজীবীরা অবিবেচকের মতো অশোভন কথা বলেছে। শোনা কথার ওপর নির্ভর করে বিবেচনাহীনের মতো অসত্য কথাকে ছড়িয়ে দিয়েছে। পত্রিকা প্রতিবেদন তৈরির সময় সত্য-মিথ্যা যাচাই করেনি। কীভাবে, সঠিক পথে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়েছে, তা তারা জানারও চেষ্টা করেনি। এ বিষয়ে তাদের ন্যূনতম জ্ঞানও ছিল না। তবু এমনভাবে কথা বলেছে যেন তারা বিশেষজ্ঞ।
আবার পত্রিকাগুলো কারিগরি কমিটির মূল্যায়নে কোন অনিয়ম হয়েছে- এ বিষয়ও কিছু বলেনি। প্রাক-যোগ্য ঠিকাদার নিয়োগে কারিগরি কমিটিই- এনটিটি। আমি শুধু কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্তকে বিশ্বব্যাংকে অগ্রায়ন করেছি। বাতাসের ওপর ভর করে আমার বিরুদ্ধে নানা অসত্য রিপোর্টকে পুঁজি করে পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেছে। নানা কারণে প্রভাবিত হয়ে বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রে হাত মেলাতে গিয়ে একবারও ভাবেনি পদ্মা সেতু দেশীয় সম্পদ। এর বাস্তবায়ন অসত্য ও ভিত্তিহীন অজুহাতে বাধাগ্রস্ত হলে দেশের ক্ষতি হবে। অনেক সময় ভাবি, দেশের পত্রিকাগুলো কি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আপস করে, কিন্তু কেন? তারা এদেশের সন্তান। তাহলে আমাকে অসত্য ও ভিত্তিহীন অজুহাতে নাজেহাল করতে গিয়ে দেশের ক্ষতি হচ্ছে, এটা কি তারা বুঝতে অক্ষম ছিলেন? ষড়যন্ত্রকারীরা ২০১৩ সালে ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার যাতে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ করতে না পারে এবং পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ‘বিজয় নিশান’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে না ওড়ে, সে ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করেছিল।
আমি প্রায় তিন বছর যোগাযোগমন্ত্রী ছিলাম। তিন বছর আমি প্রচুর পরিশ্রম করেছি। সরকারি প্রকল্পের জন্য প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য মোবিলাইজ করেছি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ এবং বর্তমান রেল মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নে নানা কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছি। আমি যখন দায়িত্ব নিই, তখন সেতু বিভাগের বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায় করা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। আমি দায়িত্বে এসে সেতু বিভাগের কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করি। মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণ, ঢাকা-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে টানেল নির্মাণ, গুলিস্তান লেচু শাহের মাজার হতে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণসহ ১১টি প্রকল্প গ্রহণ ও কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন শুরু করি। আমি যোগাযোগমন্ত্রী থাকলে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টেও দ্বিতীয় পদ্মা সেতু এতদিনে বাস্তবায়িত হতো। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বিডারস ফাইন্যান্সিংয়ে সেতু নির্মাণের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছিলেন। সড়ক বিভাগের অধীনে ১৬০টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়, যার মধ্যে ৪৪টি অগ্রাধিকার প্রকল্প। অনুরূপভাবে রেলওয়ের উন্নয়নে ৪৪টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর অনেকগুলোর কাজ বাস্তবায়নাধীন ছিল। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আমি তিন বছরে যে কাজ করে দিয়ে এসেছি, যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছি, সেসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে, সে কাজ ১০০ বছরের ভেতরে পাঁচ বছর মেয়াদি কোনো সরকার উদ্যোগ নিতে পারেনি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আমি সেসব প্রকল্প গ্রহণ করেছি, বাস্তবায়ন করেছি, তা হবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক এবং একটি ঐতিহাসিক দলিল।
ভোরের কাগজ : বিশ্বব্যাংক আপনাকে কেন টার্গেট করেছিল?
সৈয়দ আবুল হোসেন : আওয়ামী লীগের আমলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়ে যাতে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন না হয়, এটাই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেট। তাই যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে তারা আমাকে টার্গেট করেছিল। আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করে সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রী যদি পর পর তিনবার নির্বাচিত না হতেন, তাহলে এ পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হতো না।
ভোরের কাগজ : যারা পদ্মা সেতু নিয়ে বিরোধিতা করে আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন, তাদের উদ্দেশে আপনার বক্তব্য কী?
সৈয়দ আবুল হোসেন : পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন। আর বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নপূরণের এই পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রীর শ্রেষ্ঠ উপহার। এ স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে শতভাগ সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে আমি প্রস্তুতিপর্বে দিন-রাত কাজ করেছি। এতে আমি কোনো অনিয়ম করিনি। এর পরও বিশ্বব্যাংক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা যে অপবাদ আমাকে দিয়েছে, তা ছিল অসত্য। আজ সব অপবাদ ও অপমানের জবাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। পদ্মার দুই পাড়কে যুক্ত করে পদ্মা সেতু শুধু সমগ্র বাংলাদেশ নয়, এশিয়াসহ ইউরোপে যাওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতীক। আমাদের গর্ব ও অহংকারের প্রতীক। সক্ষমতার প্রতীক। পদ্মা সেতু আমাদের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। বিশ্বব্যাংকের প্রতি সমুচিত জবাবের প্রতীক। পদ্মা সেতু সততার প্রতীক। আসুন, আমরা জাতি-ধর্ম ও দলমতনির্বিশেষে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের হাতকে শক্তিশালী করি এবং সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও আন্তরিকতার সঙ্গে দেশের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়