পদ্মা সেতু উদ্বোধন : বুয়েটে ক্লাস বন্ধ থাকবে ২৫ জুন

আগের সংবাদ

বর্ণিল উৎসবে খুলল দখিন দুয়ার

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের গর্ব, বিশ্বের বিস্ময় : জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে যেভাবে ডানা মেলল স্বপ্নের পদ্মা

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : প্রমত্তা পদ্মা। উন্মাতাল। চিরযৌবনা। কখনো আগ্রাসী। কখনো বানভাসি। কোটি কোটি মানুষের ষোলোআনা সুখ-দুঃখের চিরসাথী হয়ে ছুটে চলছে হাজার বছর ধরে। এপার-ওপার জুড়ে হাজারো সংগ্রামগাথা রূপকথাকে হার মানলেও বিদ্রোহী পদ্মাকে এক সুতোয় গেঁথে সেতু করার অবান্তর কল্পনা কেউ করেননি দুঃস্বপ্নেও। তবে হ্যাঁ, একজন, একজনই দেখেছিলেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তরুণ মুজিব তখন জাতির পিতা হননি। সত্তরের নির্বাচন প্রচারে অনুভব করেন যমুনা ও পদ্মা সেতুর। প্রতিশ্রæতিও দেন। নির্বাচনের আগে বেতার ভাষণেও বলেছিলেন এ অঙ্গীকারের কথা। কিন্তু প্রতিশ্রæতি পূরণের আগেই ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নেয় তার অবিনাশী প্রাণ। এরপর প্রমত্তা পদ্মার ঢেউয়ে কোটি কোটি গ্যালন জল গড়ালেও সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখার প্রস্তুত ছিল না বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালে পদ্মায় সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক স্বপ্নের বীজ বপনে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দুচোখে পিতার স্বপ্ন, হৃদয়ে ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয়, সাহস আর দেশপ্রেম। সঙ্গে জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল হিমালয়সম। আজ ২৯৪টি স্টিলের পাইল মিলে চারটি মাউন্ট এভারেস্টের সমান উচ্চতা নিয়ে পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে সারা বিশ্বকে জানান দিচ্ছে, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ/ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ¡াসে/ সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়:/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
মাথা নোয়ায়নি বাংলাদেশ। কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করে দিলেও নিজস্ব টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে আবারো প্রমাণ করেন শেখ হাসিনা, আমরাও পারি। সেসঙ্গে ভেঙেছে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীলতার ‘অচলায়তন’। নিজেরা পদ্মা সেতু করার ফলে আজকে বাংলাদেশের সম্মান শিখর ছুঁয়েছে। আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছে বাঙালি। গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের সাহস ও পাশে দাঁড়ানোর কারণেই সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে দেশের মানুষের মাথা উঁচু করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের গর্ব, বিশ্বের বিস্ময় : বিয়াল্লিশ তলা ভবনের সমান পাইলিং, দশ হাজার টনের বেশি ধারণক্ষমতার বেয়ারিং আর নদী শাসনে এ মেগা স্ট্র্যাকচার গড়েছে বিশ্ব রেকর্ড। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৫০ মিটার। আর পদ্মা সেতুর ২৯৪টি স্টিলের পাইলের উচ্চতা মাপলে চারটি এভারেস্টের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে যাবে। পাইলগুলোর একেকটির ব্যস ৩ মিটার। মোট স্প্যান ৪১টি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, একটি আদর্শ ক্রিকেট মাঠের আয়তন সাড়ে ১ দশমিক ২৫ হেক্টর। পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২ হাজার ১৫৫টি ক্রিকেট মাঠের সমান ভূমি।

এদিকে পদ্মা সেতুর নদীশাসনে প্রায় ২ কোটি ১৭ লাখ জিও ব্যাগ ব্যবহার হয়েছে। এর কোনো কোনোটির ওজন ৮০০ কেজি। কিছু আবার ১২৫ কেজির। এসব জিও ব্যাগে বালু ভরে নদীর তলদেশে ফেলা হয়েছে। নদীতে পাথর ফেলা হয়েছে প্রায় সোয়া ১০ লাখ ঘনমিটার। এই পরিমাণ পাথরকে ১৩ হাজার বর্গফুট জুড়ে স্তূপ করে রাখলে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত কেওক্রাডংয়ের থেকেও উঁচু দেখাবে। বিশ্বের অন্যতম উঁচু ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফার আয়তন ৩৩ লাখ ৩১ হাজার বর্গফুট। আর পদ্মায় মূল সেতু, নদীশাসন ও সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজে ব্যবহৃত মোট বালু প্রায় ৬৫ লাখ ঘনমিটার, যা দিয়ে ১৯ কোটি ১২ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবন তৈরি করা যাবে। এই আয়তন প্রায় ৫৭টি বুর্জ খলিফার সমান। মূল সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে রডের ব্যবহার হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার টন। এসব রডের সবই দেশীয়। এক টন করে এই রড যদি লম্বালম্বি রাখা হয়, তাহলে পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত রডের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১ হাজার ২৯৬ কিলোমিটার। দেশের সর্ব উত্তরের স্থান তেঁতুলিয়া থেকে দক্ষিণের আরেক প্রান্ত টেকনাফের দূরত্ব ৯৩১ কিলোমিটার। অর্থাৎ পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত রডের দৈর্ঘ্য টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার দূরত্বের চেয়েও বেশি। পদ্মা সেতুতে জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশসহ ২০ রাষ্ট্রের মেধা।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিভিন্ন দিক দিয়ে পদ্মা সেতু বিশ্বে রেকর্ড করেছে। ভূমিকম্প বেয়ারিং টেস্টিং করার জন্য চীন থেকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে এবং আসতে শুধু প্লেন ভাড়াই খরচ হয়েছে ২ কোটি টাকা। এ সেতু নির্মাণে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে। সেতুর পাইল ১২২ মিটার লম্বা ও এর ডায়ামিটারের আয়তন তিন মিটার। বিশ্বের কোনো সেতুতে এ ধরনের পাইল ব্যবহার করা হয়নি।
যেভাবে ডানা মেলল স্বপ্নের পদ্মা সেতু : ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রস্তাব দিতে বলেন। অর্থের সংস্থান না হলেও প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র ১১ দিন আগে ২০০১ সালের ৪ জুলাই তিনি পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরের পাঁচ বছর চলে যায়, পদ্মা সেতু মাওয়া না আরিচায় হবে- এ বিতর্কে। ২০০৪ সালে জাপানের জাইকার সহায়তায় সমীক্ষা করা হয়। ২০০৮ সালে নকশা প্রণয়নে চুক্তি হয়। ২০০৯ সালের জুনে নকশা অনুমোদন পায়। ২০১০ সালে দরপত্রও আহ্বান করা হয়। অর্থায়নের আগ্রহ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নœয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাইকা। ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলার, ১৮ মে জাইকার সঙ্গে ৪১ কোটি ডলার, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে ১৪ কোটি ডলার এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ৬২ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়। তবে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ জুন ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল, সেতু নির্মাণের কাজ পাইয়ে দিতে বাংলাদেশের কয়েকজন রাজনীতিক কমিশনবাণিজ্যে জড়িত। এ পরিস্থিতিতে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও অভিযোগ করতে থাকে, পদ্মা সেতুর দুর্নীতিতে জড়িত সরকারি দলের নেতারা। এ অভিযোগে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে। কারাগারে যেতে হয় সরকারের দুই সচিবকে। পশ্চিমা দেশগুলোও পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সরকার শুরু থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও প্রমাণ মেলেনি পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির। প্রমাণ মেলেনি কানাডিয়ান আদালতেও। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মা সেতু। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতু ও নদীশাসন কাজ উদ্বোধন করেন। এ যেন এক যুদ্ধ। তাদের কোনো রাত-দিন নেই। শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম এমনকি রোদ-বৃষ্টিকে থোড়াই কেয়ার। নেই করোনা অতিমারিতে আতঙ্কনীল হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেতুতে পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। এভাবে সময়ের গতিতে ক্রমান্বয়ে একের পর এক স্প্যান বসানো এগিয়ে যেতে থাকে। ৪১তম স্প্যান বসানোর পরই পদ্মা সেতুর দৃষ্টিনন্দন অবয়ব আপামর জনগোষ্ঠীকে মুগ্ধতার বিস্ময়ে ভাসিয়ে নেয়।
বদলে যাবে অর্থনৈতিক চেহারা : ৫০ বছরের ইতিহাসে এই প্রকল্পে বদলে যাবে দেশের অর্থনৈতিক চেহারা। সর্বনাশা পদ্মা নদী আজ থেকে আশার আলো। সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে আজ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে। সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হবে, যা অর্থনীতিকে নতুন মাত্রা দেবে। এই বৃহৎ অঞ্চলে গড়ে উঠবে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ইপিজেড। জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত উভয় দিকেই। ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বির্তক তৈরি হয়েছে এই সেতু ঘিরে। যে সময়টিতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন প্রত্যাহার করে রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ ছিল আওয়ামী লীগের জন্য। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, অন্যদিকে ২০১৪ সালের নির্বাচন সামনে ছিল। তবে আওয়ামী লীগ উতরে গেছে। শেষ পর্যন্ত নিজস্ব টাকায় সেতু নির্মাণ করে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, আওয়ামী লীগ স্বপ্ন দেখায় এবং বাস্তবায়ন করে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়