পদ্মা সেতু উদ্বোধন : বুয়েটে ক্লাস বন্ধ থাকবে ২৫ জুন

আগের সংবাদ

বর্ণিল উৎসবে খুলল দখিন দুয়ার

পরের সংবাদ

পদ্মা সেতু বদলে দেবে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আনোয়ার হোসেন আনু, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) থেকে : আগামীকাল উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আর এই পদ্মা সেতুকে ঘিরে বদলে যাবে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা। ফেরিবিহীন নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে কুয়াকাটার সঙ্গে সারাদেশের পণ্য পরিবহনসহ সহজে আসা যাওয়ার সুযোগ দেশের এবং দক্ষিণাঞ্চলবাসীর বড় প্রাপ্তির প্রতিফলন। পদ্মা সেতুকে ঘিরে কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মধ্যে রোমাঞ্চ কাজ করছে। পর্যটননির্ভর ব্যবসায়ীসহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষসহ সবার মুখেই এখন একটিই নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মুহূর্ত উপভোগ করতে আগামীকাল কুয়াকাটাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে কয়েক লাখ মানুষ যাবে পদ্মার পাড়ে। ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকতে চায় তারা। এমনই প্রত্যাশা নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন উৎফুল্ল মানুষ। স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে চান তারা। দেশের এমন অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নিজেদের সশরীরে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে অনেকেই আগে থেকেই বাস, মাইক্রোবাস ও অন্যান্য পরিবহন ঠিক করে রেখেছেন। উপকূলবাসীর এমন প্রত্যাশাকে ঘিরে কুয়াকাটা-মাওয়া সড়ক-মহাসড়কজুড়ে থাকবে জনসমুদ্র।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াকাটায় পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। গড়ে উঠবে অভিজাতমানের ফাইভ স্টার হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও বিনোদনকেন্দ্র। বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। গড়ে উঠবে শিল্প কলকারখানা। মৎস্য, কৃষিপণ্য পরিবহনসহ যাতায়াতে দুর্ভোগ লাগব হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন কুয়াকাটাকে আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন নগরী গড়ে তোলার। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের আদলে সাজানো হবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরী বিনির্মাণে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে কুয়াকাটা। ফেরি পারাপারে বিলম্বের জন্য লোকসান গুনতে হবে না ব্যবসায়ীদের। ন্যায্যমূল্য পাবেন জেলে ও কৃষকরা। পরিবহন সেক্টরেও ফিরে আসবে সুদিন। চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও অকল্পনীয় পরিবর্তন আনবে। বেকারত্ব দূর হবে। কর্মসংস্থান হবে এখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষের এমনটাই মনে করেন রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্টজনরা। অন্যদিকে পায়রাবন্দর থেকে পণ্য ও পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জামাদি পরিবহন সহজ হবে। বাড়বে রন্দরকেন্দ্রিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। ঢাকা থেকে আগে যেখানে কুয়াকাটায় আসতে যেতে ১৩টি ফেরি পার হতে হতো। সময় লাগত ১৪-১৫ ঘণ্টা। সেখানে এখন ৫-৬ ঘণ্টায় কুয়াকাটা আসা যাওয়া করা সম্ভব। ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন অভাবনীয় সুযোগ আসবে তা কখনো ভাবেনি কুয়াকাটা তথা পটুয়াখালী উপকূলীয় এলাকাবাসী।
সরজমিন দেখা গেছে, পর্যটন খাতে বড় বড় বিনিয়োগকারী ইউনিক গ্রুপ ও ইউ এস বাংলাসহ একাধিক আন্তর্জাতিকমানের চেইন হোটেল গড়ে তুলতে ক্রয়কৃত জমিতে কাজ চলছে। সেতুকেন্দ্রিক পর্যটকদের চাপ সামাল দিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা তাদের নির্মাণাধীন অবকাঠামোর উন্নয়ন করছেন। নতুন করে বিনিয়োগের পরিকল্পনায় রয়েছে অগণিত আবাসন ব্যবসায়ীর। কুয়াকাটায় সর্ব্বোচ্চ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেঞ্চুরি রিয়েল এস্ট্রেট কোম্পানি থেমে নেই। আগাম প্রস্তুতি নিতে তাদের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। হুহু করে জমির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই বছর আগে যে জমি তিন লাখ টাকায় শতাংশ কেনা যেত। পায়রা সেতু উদ্বোধনের পর সেই জমির মূল্য কয়েক ধাপ বেড়ে গেছে। পদ্মা সেতু চালুর খবরে শতাংশ প্রতি বেড়ে গেছে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। আন্ধারমানিক ট্যুরিজমের পরিচালক কে এম বাচ্চু জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বারো মাসই পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকবে কুয়াকাটা সৈকত। তখন পর্যটক মৌসুম ও অমৌসুম বলতে কিছুই থাকবে না। কারণ হিসেবে ফেরিবিহীন নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ এ আমূল পরিবর্তন এনে দিবে। বাচ্চু আরো বলেন, ঢাকা থেকে কুয়াকাটা সৈকতে আসতে যেতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না।
কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কের যাত্রীবাহী বাসচালক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, আগে মাওয়া ও কাওড়াকান্দি ফেরিঘাটে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হতো। অসুস্থ রোগীরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এখন আর দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার মধ্যদিয়ে পরিবহন সেক্টরে নতুন মাত্রা যোগ হবে। নামিদামি পরিবহন কোম্পানি কুয়াকাটা-ঢাকা রুটের রুট পারমিট নিয়ে রেখেছে।
পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব পরিবহন নতুন এই রুটে চলবে। ঢাকা ও উত্তারাঞ্চল থেকে পদ্মা সেতু এবং কুয়াকাটায় পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাবে। তিনি বলেন এখন আর যাত্রী সংকট থাকবে না। এতে পরিবহন মালিকরাও লাভবান হবেন।
কুয়াকাটা মেয়র মার্কেটের কাঁচা তরকারি ব্যবসায়ী ইয়াসিন মুসল্লি জানান, আগে ঢাকাসহ উত্তর বঙ্গের শাকসবজি, তরি-তরকারি কুয়াকাটায় আসত না। এখন দেশের যে কোনো স্থান থেকে তরি-তরকারি ও শাকসবজি আনা নেয়া সহজ হবে। ন্যায্যমূল্যে সহজেই তাজা শাকসবজি খেতে পারবে মানুষ। কুয়াকাটা আশার আলো জেলে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি ও মৎস্য আড়তদার নিজাম শেখ জানান, পদ্মা সেতু আমাদের মৎস্যজীবীদের ভাগ্যের পরিবর্তন বয়ে আনবে। আগে কুয়াকাটা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে এক থেকে দেড় দিন সময় লাগত। যে কারণে সময়মতো বাজার ধরা যেত না। মাছ পচে যেত। এতে লোকসানের মুখে পরতে হতো। দেরিতে পৌঁছানোর কারণে সঠিক বাজারমূল্য পাওয়া যেত না। এখন সহজেই মাছ বাজারজাত করা সম্ভব হবে। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ মোতালেব শরীফ বলেন, পদ্মা সেতু কুয়াকাটা পর্যটন ব্যবসায়ীদের জন্য আর্শীবাদ। কুয়াকাটায় বর্তমানে ছোট বড় মিলে প্রায় দেড় শতাধিক আবাসিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। আরো নির্মাণাধীন রয়েছে অর্থ শতাধিক আবাসিক হোটেল। পর্যটননির্ভর পাঁচ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রাণ চাঞ্চল্যতা ফিরে আসবে। ব্যবসায়িকভাবে তারা লাভবান হবেন। আগে কুয়াকাটায় আসতে পর্যটকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। এখন আর কোনো পর্যটককে ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না। কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় পর্যটকরা ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় আসতে পারবেন। তিনি বলেন, এখন কুয়াকাটা বারো মাস পর্যটকদের আগমনে মুখর থাকবে। কক্সবাজার যেতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। যার ফলে পর্যটকরা কুয়াকাটাকেই বেছে নিবে। তার মতে পর্যটন ব্যবসায়ীদের সুদিন ফিরে আসছে। আর সে সুদিনের সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ. বারেক মোল্লা বলেন, বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু আমাদের কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে আনবে। পর্যটন নগরী কুয়াকাটার সঙ্গে সারাদেশের সেতু বন্ধন তৈরি হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনচিত্র পাল্টে যাবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এই এলাকার মানুষ উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পাবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। শিল্প কারখানা তৈরি হবে। নতুন নতুন কর্মের সুযোগ তৈরি হবে। এখানকার মানুষ আর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে পদ্মা সেতুও হতো না, আর দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্যের চাকা কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারত না। পদ্মা সেতু আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও কুয়াকাটাবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনন্য উপহার। যার প্রতিদান আমরা কখনো শোধ করতে পারব না।
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের স্বপ্নের সেতু। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে কুয়াকাটা তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্য পাল্টে যাবে। পর্যটন নগরী কুয়াকাটাসহ উপকূলবাসী গ্রামে থেকে শহরের সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। স্বাবলম্বী হবে এখানকার মানুষ। দারিদ্র্যতা থাকবে না। উপকূলীয় এলাকার কৃষক, জেলে, শ্রমজীবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তান উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, শুধু পদ্মা সেতুই নয়। শেখ রাসেল, শেখ কামাল, শেখ জামাল, পটুয়াখালী সেতু, পায়রা সেতু, কীর্তনখোলা নদীর সেতু এবং পায়রাবন্দরের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু তৈরির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেরিবিহীন যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এজন্য দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাকে সারা জীবন অন্তরে ধারণ করে রাখবে। মেয়র বলেন, পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের আগমন আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে যাবে। পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে কুয়াকাটা পর্যটনে বিনিয়োগে।
এদিকে কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জানান, পদ্মা সেতু চালু হলে কুয়াকাটায় অসংখ্য পর্যটকের আগমনের সম্ভাবনাকে ঘিরে জেলা পুলিশের পাশাপাশি কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ সেবা ও নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় রেখে আগে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে। কুয়াকাটা সৈকতে আসা পর্যটকরা যাতে নিরাপত্তাজনিত কারণে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে সর্তক দৃষ্টি থাকবে বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়