র‌্যাব মহাপরিচালক : নাশকতার তথ্য নেই তবুও সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছি

আগের সংবাদ

বাংলাদেশের গর্ব, বিশ্বের বিস্ময় : জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে যেভাবে ডানা মেলল স্বপ্নের পদ্মা

পরের সংবাদ

পদ্মার ঢেউ রে

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় মাধ্যমে আমরা ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় একটি সংযোজন এই পদ্মা সেতু। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধানতম নদী হিসেবে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্যে, গানে কবিতায় নানাভাবে বারবার এসেছে এই পদ্মা নদী। বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক ঔপন্যাসিক শিল্পীর কর্মে কতভাবে চিত্রিত হয়েছে এই প্রমত্তা পদ্মার বিচিত্ররূপ। পদ্মা পাড়ের মানুষ, জনজীবন, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে কবি, লেখক, ঔপন্যাসিকদের লেখায়। চিত্রকরের আঁকা শিল্পকর্মে, বিভিন্ন কণ্ঠশিল্পীর গানে চলচ্চিত্রকারের চলচ্চিত্রে। পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করে অসংখ্য গান কবিতা গল্প উপন্যাস রচিত হয়েছে। সিনেমা নাটক নির্মিত হয়েছে। বিচিত্র রূপের পদ্মা নদী নিয়ে জন্ম নিয়েছে বহু রচনা, বাংলা সাহিত্যে পড়েছে স্রোতের ছায়া। এ লেখায় উঠে এসেছে বাংলা সাহিত্যে পদ্মা নদীর পথচলা নিয়ে কিছু কথা। সেসব উপন্যাসে কখনো পদ্মা নদীকে দেখা হয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে, কখনোবা মানবমনের বহুমুখী আবেগ প্রকাশের মাধ্যম করে, কখনোবা পদ্মা নদী হয়ে উঠেছে এর পার্শ্ববর্তী জনজীবনের নিত্যকার সঙ্গী। নদীপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের বুক চিরে বয়ে যায় নদী। পাড়ে পাড়ে জনবসতি, নদীর ভাঙাগড়ার মতো মানুষের সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ধর্ম-বর্ণ গোত্র ও রাজনৈতিক অবস্থা নদীপ্রসঙ্গকে ধারণ করে কখনো কখনো পরিবতির্ত হয়। পরিবতর্নের হাওয়ায় গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। জীবনচক্রে জীবিকার পথগুলো সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে থাকে একটু ভিন্নতর। জল গড়ায় জীবন গড়ায়, জল থেকে উবর্র মাটির বুকে সর্বস্বহারা মানুষ বসতি স্থাপন করে। নদীর সঙ্গে জল মাটি মানুষের সঙ্গমে চিত্ররূপায়নে সময়ের বার্তা সুধায় শিল্পীমন। বাংলাসাহিত্য বৃক্ষের প্রধানতম শাখা উপন্যাস। যেখানে থাকে বিশাল জনগোষ্ঠী জীবনযাপনের স্থির বা চলমান বিষয়। নদীও সাহিত্যের অনন্য অনুষঙ্গ, ভেতরের সামূহিক চিত্রগুলো তুলে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। গড়ে ওঠে নদীভিত্তিক উপন্যাস। অনুষঙ্গ নদী, ঔপন্যাসিকের মননে জল খেলা করে বাদ পড়েনি সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য ও অর্থনীতি। বঙ্গোপসাগরের জল ভিড়ে শ্যামলিমা পথে। নদীর নামকরণে বাঁক বদলে বদলে রিপুগুচ্ছকে নাড়িয়ে পাঠকপ্রিয়তা পায় উপন্যাস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ এই নদীর তীরের মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করেই লেখা। পদ্মার নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নানাভাবে প্রভাবিত করেছে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। তার বিখ্যাত কিছু গানে পদ্মার হারানো ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক রচিত ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসটির উপজীব্য পদ্মার পাড়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা।
একেক ঔপন্যাসিক পদ্মা নদীকে তর্জমা করেছেন তাঁর নিজস্ববোধ এবং বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। এদের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নামের এই উপন্যাসটি অনেক বছর ধরে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যবই হিসেবে সুপরিচিত। উপন্যাসটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এখানে পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকার লোকেদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, সভ্যতা- সবকিছুর কেন্দ্র এই নদী। নদীর মেজাজ-মর্জির ওপর ভরসা করেই তাদের জীবন মোড় বদলায়। ঠিক এমনটা দেখা যায় কালকূট সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ উপন্যাসে। জেলেদের জীবন যে নদীর থেকে কখনোই আলাদা হতে পারে না, সে অবিচ্ছেদ্যতার পরশ এখানে পাওয়া যায়। আর গঙ্গা আর পদ্মা তো একই অঙ্গে দুই নাম ছাড়া আর কিছুই নয়, দেশান্তরে গিয়ে নাম বদলালেও তার পরিচয় কি বদলায়। দিন কাটিয়া যায়। জীবন অতিবাহিত হয়। ঋতুচক্রে সময় পাক খায়, পদ্মার ভাঙন ধরা তীরে মাটি ধসিতে থাকে, পদ্মার বুকে জল ভেদ করিয়া জাগিয়া উঠে চর, অর্ধ শতাব্দীর বিস্তীর্ণ চর পদ্মার জলে আবার বিলীন হইয়া যায়। নদী নামভিত্তিক প্রথম উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি পদ্মার মূল উৎস হিমালয়। এই পদ্মাপাড়ের সংকীর্ণ পল্লী, জেলে পাড়া, মাছ শিকার বিক্রি, দরদামে হঠকারিতা, পূজা, মেলার দ্রব্যাদি, রথের বৃষ্টি, প্রেম, ছন্নছাড়া জীবন, মাদকতা, পাশবিকতা, সরলতা, নীচতা বিশ্বাস চিন্তা বলা চলে সামগ্রিক জীবনের নিখুঁত বিষয়াদি উপন্যাসে পরতে পরতে চিত্রিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে নিজস্বশৈলীগুণ দেখিয়েছেন। রূপকথা, বিভক্তসংস্কৃতি, নদীসংস্কৃতি, লোকবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। হোসেন মিঞার দৌরাত্ম্য, শীতলের ফন্দি, পীতম মাঝির নীরবতা এসব যেন মানিক নিঙড়ে নিঙড়ে উপস্থাপন করেছেন। প্রেম আনয়নে নতুনত্ব এসেছে। পরান ভরে দুজনের মনের বাসনা প্রকাশ করে, কুবের কপিলাকে পরান ভরে ভালোবাসে চরডাঙায় কপিলাকে একান্ত পেয়ে কুবের বলে তর লাইগা দিবারাত্র পরানডা পোড়ায় কপিলা। কপিলা কয়-আমারে ভুইলো মাঝি- পুরুষের পরান পোড়ে কয়দিন? গাঙের জলে নাও ভাসাইয়া দূর দ্যাশে যাইও মাঝি, ভুইলো আমারে। জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের হিসাব-নিকাশ চলে। মনে গাঁথে জীবনযুদ্ধের ইতিকথা, চরিত্রগুলো জল ও মাটির মতো নিবিড় কেমন করে তিনি মানুষের মনের কথাগুলো আপন যতেœ আঞ্চলিক ভাষায় পেশ করেন। কুবের মালা কপিলা, রাসু পীতম প্রভৃতিজনের ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্নভাষা। আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাস পদ্মাপাড়ের জনজীবন শ্রেণি, পেশা, জাতিবর্ণ কৃষিভিত্তিক ও কৃষিবহির্ভূত পেশা, হিন্দু-মুসলমানের মাছ ধরা গ্রামীণ ক্ষমতা-কাঠামোর সন্ধান মেলে। চর দখলের চিত্র মামলা হামলা পুলিশি শাসন ভূমি মালিকদের চর দখলের ক্ষেত্রে দ্ব›দ্ব হিংসা বিদ্বেষ কলহ বিরোধ জগুরুল্লার চরিত্রের আদলে ঔপন্যাসিক গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া সহজ-সরল মানুষ যারা কুচক্রী মাতব্বরের হাতে বন্দি নিরুপায়ের দৃশ্য উঠেছে। দখল ও প্রতিরোধের চিত্র। চরভাঙে চর জাগে চরবাসী দখলের জন্য লাঠিকাঁধে হাঁক দেয়। পদ্মা অজগর স্রোত গিলে খায় সব জমি উন্মাদিনী পদ্মা গুণগাঁ, নমকান্দি বিদগাঁও, কাউনিয়াকান্দা, ডিঙ্গাখোলা ল²ীচর বুকে টেনে নিচ্ছে। স¤প্রতি টেনে নিচ্ছে নড়িয়ার অঞ্চল। ইতিহাসের ভয়াবহ ভাঙন বুঝে ওঠার আগে দালান-কোঠা, মসজিদ-মন্দির, খেলার মাঠ অজান্তেই প্রতিনিয়ত তলিয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে; নদী হলো ভাঙা-গড়ার খেলা। সে সময়ের বর্ণনা এরকম ‘চরের বসত আজ আছে কাল নেই। নদীর খেয়াল-খুশির ওপর নির্ভর করে চরের আয়ু। তার খুশিতে চর জাগে। তার খেয়ালে ভেঙে যায় আবার। এ যেন পানি আর মাটির চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ, দশ, বিশ বছরের মেয়াদে বুকের ওপর ঠাঁই দেয় পানি। মেয়াদ ফুরালেই আবার ভেঙে-রে নিজের জঠরে টেনে নেয়। চরবাসীরা তাই স্থায়ী হয়ে বসতে পারে না কোনোদিন। তাদের বাপ-দাদার ভিটে বলতে কিছু নেই। বাপ-দাদার কবরে চেরাগ জ্বালাবার প্রয়োজন হয় না তাদের কোনো দিন।’ সামাজিক অসামাজিক চিত্র উপন্যাসকে গতিময় করেছে। ফজল ও রূপজানের মহব্বত সব বাধাকে টেনে ভালোবাসার বন্ধনকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। শ্বশুরের কবল জগুরুল্লার ফাঁদ তার সবল বাহুডোরে বন্দি করেছে। সে যখন পরম মমতায় বলে ওঠে- ‘আমার জোড়া বান্দা কইতর-কইতরি। এই দুনিয়া জাহানের কেউ আমাগো জোড়া ভাঙতে পারব না, কোনো দিন পারব না।’ উত্তরাধিকার বাংলা একাডেমি মাসিক পত্রিকা ১৯৮৭-তে প্রকাশিত ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে পদ্মার চরাঞ্চলের জীবন, এই জীবনের সঙ্গে আবু ইসহাক ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত।… তিনি একটি জটিল জীবনের চিত্র এঁকেছেন, এই জটিলতা সূর্যদীঘল বাড়িতে নেই। আবু ইসহাক পল্লীজীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন। পদ্মার পলিদ্বীপে পল্লীজীবনের একটা বিশেষ দিক চরাঞ্চলের সংঘাতময় জীবনের কথা নিয়ে লিখেছেন।
তেরো শত নদীর এই বাংলাদেশ। নদীমাতৃক দেশ। মঙ্গলকাব্যে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যের কথা আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্য হাজারো নদী এ দেশের ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। নদীগুলো এ দেশকে করেছে সৌন্দর্যময়, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। শ্যামল মাটির অঙ্গে এ নদীগুলো এ দেশের প্রাণ। নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক তার আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে এ দেশের নদীর কথা বলেছেন কবিতায়-
আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।
চলি পলি মাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরো শত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?
পদ্মার উর্বর ভূমিখণ্ডে একে একে ফলেছে রবীন্দ্রসৃষ্ট ফসল। রবীন্দ্রজীবনের এই উর্বর বাঁকে পদ্মার দান অতুলনীয়। প্রমথনাথ বিশী ‘শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ’ গ্রন্থে বলেন, পদ্মাকে যে দেখেনি বাংলাদেশকে দেখেনি সে, পদ্মাকে যে জানে না বাংলাদেশকে জানে না সে, পদ্মাকে যে বোঝেনি, বাংলাদেশকে বোঝেনি সে; যা কিছু দেখা জানা বোঝা সমস্ত সংহত এই নদীটির মধ্যে। আরো বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ পদ্মাকে দেখেছিলেন, বাংলাদেশকে বুঝেছিলেন আর তাঁর সেই দেখা আর বোঝা বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রবাহে যোগ করেছে কিছু অমর সৃষ্টি। বাংলাদেশের এই পর্বটিকে বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিমানস ও সাহিত্যমানসকে বোঝা যায় না, অসম্পূর্ণ রয়ে যায় রবীন্দ্রনাথকে জানা। কলকাতার অট্টালিকার ভিড়ে, পারিবারিক আভিজাত্যের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে থাকতে কবির দেখা হয়নি বাংলার প্রকৃতিকে আর মেশা হয়নি বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে। জমিদারির দায়িত্ব কবিকে পরিচিত করালো অসীম সবুজ আদিগন্ত প্রান্তরের সঙ্গে, খোলা আকাশের সঙ্গে, সদা আপন গতিতে প্রবাহিত নদ-নদীর সঙ্গে আর ছোট ছোট সুখ-দুঃখ চাওয়া-পাওয়া নিয়ে বেঁচে থাকা বাংলার মানুষের সঙ্গে। পদ্মাতীরে বসে কবি তাঁর অন্তর্নিহিত কবি ধর্মকে যেমন আবিষ্কার করলেন, তেমনি পদ্মার কলধ্বনিতে শুনলেন বাংলার জনজীবনের কোলাহল। জমিদারির প্রয়োজনে বা প্রাণের টানে বারে বারে রবীন্দ্রনাথ গেছেন শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে। পদ্মার পাশাপাশি তাঁর পরিচয় হয়েছে আত্রাই, গড়াই প্রভৃতি নদীর সঙ্গে। এই তিন জায়গার প্রকৃতি ও মানুষ রবীন্দ্রনাথকে ঋদ্ধ করেছে। তবে রবীন্দ্রনাথ শুধু গ্রহণই করেছেন এমনটা নয়, ফিরিয়েও দিয়েছেন তাঁর যথাসাধ্য। পদ্মাতীরে বসবাসকালে রবীন্দ্র-কর্মপ্রবাহকে স্রোতের মিলন হিসেবে দেখা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের রচনায়, চিঠিপত্রে যেসব নদী রয়েছে সেগুলো হলো পদ্মা, যমুনা, গড়াই, ইছামতী, বড়াল, নাগর, বলেশ্বরী, আত্রাই, হুড়োসাগর ইত্যাদি। শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুর ও পতিসরের যাত্রাপথের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, ‘বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মা থেকে কোলের ইছামতীতে, ইছামতী থেকে বড়লে, হুড়ো সাগরে, চলনবিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে খাল বেয়ে শাহজাদপুরে। রবীন্দ্রনাথের চিত্তকে অধিকার করেছিল পদ্মা নদী। পদ্মার নদীর বিচিত্র চরিত্র ও বিচিত্র প্রবাহ তাঁর রচনায় বিভিন্নভাবে এসেছে। স্বীকার করেছেন, বাস্তবিক, পদ্মা নদীকে আমি ভালোবাসি;… আমি যখন শিলাইদহ বোটে থাকি, তখন পদ্মা আমার কাছে স্বতন্ত্র মানুষের মতো। ‘পদ্মা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হে পদ্মা আমার/তোমায় আমায় দেখা শত শত বার’। রবীন্দ্রনাথ নদীকে দেখেছিলেন নদীর তীরের মানুষের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে? এই দেখার মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছেছিলেন মাটির কাছাকাছি।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় পদ্মা এসেছে এভাবে :
পদ্মার ঢেউ রে-
মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙ্গা পা
আমি হারায়েছি তা’রে \
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় পদ্মা নদীকে ঘিরে দুই পাড়ের মানুষের সহজসরল জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে কয়েকটি পঙ্ক্তির মাধ্যমে।
জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়,
পদ্মা নদীর উজান বাঁকে ছোট্ট ডিঙি নায়।
ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘পদ্মার প্রতি’ কবিতায় প্রমত্তা নদীর বাস্তব রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। যা যে কাউকে আলোড়িত করে মুহূর্তেই।
হে পদ্মা! প্রলয়ংকরী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী!
হে প্রগলভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী
তুমি শুধু, নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে
একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুবিনীতে!
দিগন্ত বিস্তৃত তোমার হাস্যের কল্লোল তারি মত
চলিয়াছে তরঙ্গিয়া,- চির দৃপ্ত, চির অব্যাহত।
বাংলাদেশের পল্লী সংগীতের সম্রাট আবদুল আলিম তাঁর বিখ্যাত গানে পদ্মা নদীকে নিয়ে হৃদয়ের একান্ত অনুভবের দারুণ প্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে।
সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই
বল আমারে তোর কি রে আর
কূল কিনারা নাই, কূল কিনারা নাই
ও নদীর কূল কিনারা নাই \
নদীর কথা বলতে গেলে নদী নিয়ে গানের কথা উঠে আসে। হাজারো গানের উপজীব্য নদী। ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে/আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়/এ আমার দেশ/ এ আমার প্রেম/আনন্দ বেদনা মিলন বিরহ সংকটে…’। নদীকে কেন্দ্র করে এমন সমৃদ্ধ গানের সংখ্যা অনেক। কবিতার সংখ্যাও অগণিত। চিত্রশিল্পে নদী, নদীর বুকে পাল তোলা নাও, নদীর ঢেউ, নদী ও নারীর ছবি এঁকেছেন চিত্রশিল্পীরা। এ দেশের নদীর পাড়ের দৃশ্য পর্যটকদের মন কাড়ে। পদ্মা নদী নিয়ে বিখ্যাত গান রচনা করলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম- ‘পদ্মার ঢেউ রে/মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা রে…’। বিখ্যাত গানের শিল্পী আবদুল আলীম গাইলেন- ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী/তোর কাছে শুধাই/ বল আমারে তোর কিরে আর/কূলকিনারা নাই।’ পদ্মা নদী নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের আর আবদুল আলীমের গান পর্যালোচনা করলে পদ্মা নদীর সেই রূপ আর বর্তমানের রূপ এক নয়। মাঝে মাঝে পদ্মার বিনুনি বৈশিষ্ট্য। ব্যথিত নারীর মতো শুষ্ক মৌসুমে কাঁদতে থাকে জলবিহীন চোখে পদ্মা। তার বুকে জমা পড়েছে বালু আর পলি। কোথাও কোথাও হারিয়েছে নাব্য। নদী বয়ে চলে অবিরাম। এর গতি থামানো যায় না। নদীর স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা, শাসন-শোষণ জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মানুষের শৈশব-কৈশোরে, জীবন-যৌবনে। নদীর চোখের সামনেই বেড়ে উঠেছে অসংখ্য মানুষ। এমনকি জীবন-জীবিকার সম্পর্ক বিদ্যমান নদীর। পদ্মা উত্তাল হয় কখনও, আবার কখনও শান্ত হয়। বিখ্যাত লালনগীতির শিল্পী ফরিদা পারভীন তার স্বামী কবি আবু জাফরের লেখা ও সুরে গাইলেন, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’। অর্থাৎ পদ্মা নদী তার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে।
পদ্মা নদী ছিল বলেই এত গান, কবিতা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস অবলম্বনে জাগো হুয়া সাভেরা ছবিটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। আখতার জং কারদার পরিচালিত চলচ্চিত্রটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনিস, তৃপ্তি মিত্র, কাজী খালেক, জুরাইন ল²ী ও মীনা লতিফ। চলচ্চিত্রটি ১৯৫৯ সালের ৮ মে মুক্তি পায়। ছবিটি সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমি পুরস্কারের জন্য জমা দেয়া হলেও মনোনীত হয়নি। ছবিটি মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে স্বর্ণপদক অর্জন করে। একই উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন ১৯৯৩ সালে। এতে অভিনয় করেন- রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত প্রমুখ। বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথভাবে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল। কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্রটি দেশে-বিদেশে বেশ খ্যাতির শিখড়ে পৌঁছায়। আরো এক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক, ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। এই ছবিটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়। ভারতের আরেক বিখ্যাত শিল্পী ভূপেন হাজারিকা এই পদ্মাকে তাদের গঙ্গা নদীর সঙ্গে তুলনা করে দুটি নদীকে সমান চোখে দেখেছেন। কিশোর কবি সুকান্ত ‘বোধন’ কবিতায় লিখেছিলেন ‘কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ¦াসে’। তবে নদীর ধর্ম পাড় ভাঙা আর গড়া। আর যে কারণে মরমি শিল্পী আবদুল আলীম গেয়েছিলেন, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’। পদ্মার নদীর সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুলনা করেছিলেন অন্নদা শংকর রায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছিলেন, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়