দৈনিক ওঠানামার মধ্যেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী

আগের সংবাদ

জনগণের সাহসেই পদ্মা সেতু : বন্যার দুর্ভোগ ও ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার > বিএনপির নেতা কে? সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

প্রশাসনকে কাজের নির্দেশনা দিলেন প্রধানমন্ত্রী : ঘাবড়ানোর কিছু নেই, সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে

প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও জাহিদুল ইসলাম, সিলেট থেকে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বন্যায় ঘাবড়ানোর কিছু নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে এ দেশের মানুষ বসবাস করে। সরকার আপনাদের পাশে আছে। সব সময় আপনাদের পাশে থাকবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে সহায়তা দেয়া হবে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিলেট সার্কিট হাউসে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
বন্যা পরিস্থিতি এবং স্থানীয়ভাবে করণীয় সম্পর্কে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে একে একে বক্তব্য রাখেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের (ভারপ্রাপ্ত) সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, সহসভাপতি আশফাক আহমদ, মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার, জেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম আহমদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুব্রত পুরকায়স্থ, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিম প্রমুখ। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী সিলেট, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের হাতে তার পক্ষ থেকে সিলেট ও সুনামগঞ্জবাসীর জন্য ত্রাণ সহায়তা তুলে দেন।
নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করতে গতকাল সকাল ৮টায় তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারযোগে রওনা হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ‘লো-ফ্লাইং মুডে’ হেলিকপ্টার থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার নজিরবিহীন বন্যার রূপ দেখে গতকাল সকাল ১০টার দিকে হেলিকপ্টারযোগে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। পরে সেখান থেকে সিলেট সার্কিট হাউজে এসে প্রধানমন্ত্রী বন্যা পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও বন্যাদুর্গতদের পুনর্বাসন বিষয়ে এক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। মতবিনিময় সভায় স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বন্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন তিনি। সেখানে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করে দুপুর ২টার দিকে হেলিকপ্টারে ঢাকা ফেরার আগে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করেন। এই সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি আগে থেকেই আমার কার্যালয়ে বন্যার বিষয়ে প্রস্তুতির জন্য বলে রেখেছিলাম। প্রায় এক-দেড় মাস আগে থেকেই সবাইকে বলতাম, এবার খুব বড় একটা বন্যা আসবে, প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রাকৃতিক একটা পরিস্থিতি দেখে আন্দাজ করা যায়। সেটা দেখেই আমি সবসময় বলেছি এবার বড় বন্যা আসবে। এ সময় ৯৮ ও ৮৮ সালের দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। ১০ বছর ১২ বছরের মধ্যে এমন বন্যা আসে। তিনি বলেন, খাদ্যমন্ত্রীকে আগেই বলেছিলাম, এবার কিন্তু বন্যা

আসবে। বন্যায় খাদ্যগুদামে পানি ঢুকতে পারে। সেজন্য পানি সেচের ব্যবস্থা রাখতে হবে, পাম্প রাখতে হবে। বিশেষ করে খাদ্যগুদাম এবং সারের গুদাম রক্ষা করতে হবে। আবার খাদ্যগুদাম থেকে খাদ্য যাতে বের করা যায়, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। এগুলো আমাদের সব সময় করে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, এই বন্যায় আমাদের কষ্ট-ক্ষতি হচ্ছে। এটা ঠিক, আবার আমাদের লাভও আছে। বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এখানে যদি আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ পানি কমে যায়, তাহলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার যদি ঠিক থাকে, ভূমিকম্প আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। এই বন্যায় আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড রিচার্জ হবে। পাশাপাশি যে পলি আসবে, তাতে জমির উর্বরতা বাড়বে। এগুলো সবসময় মাথায় আছে আমাদের।
শেখ হাসিনা বলেন, পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা যাতে চাষবাস করতে পারে, তার ব্যবস্থা আমরা নেব। যদি বন্যা একটু দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে ধানের যে চারা তৈরি করা, তার জন্য বীজ সংরক্ষণ করে রাখা আছে, সার রাখা আছে, সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেব এবং কৃষক যেন আবার ফসল ফলাতে পারে, সে ব্যবস্থাও আমরা নেব।
তিনি বলেন, মাছের কিছু অসুবিধা। মাছ চাষীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এটাও যেমন সত্যি, আবার এই বন্যায় কিন্তু পুকুরে মাছের পোনাও আসে। এটাও মাথায় রাখবেন। আগে তো আর মাছ চাষ করত না, বন্যার সময় আমাদের বাড়িতেই দেখেছি, পুকুরের এক পাশ কেটেই দিত, যাতে বন্যার পানি ঢোকে এবং বন্যার পানির সঙ্গে মাছের পোনা ঢোকে। দু-দিকটাই আছে, ক্ষতিও হচ্ছে, যারা মাছ চাষ করে তাদের ক্ষতি হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা ব্যবস্থা নেব। জুলাই থেকে আবার আমরা মাছের পোনা দেব, পোনা ছাড়ব।
প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা সম্পর্কে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় ভোরের কাগজকে বলেন, তিনি মূলত ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বলেছেন। পাশাপাশি ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত বন্যার্তদের খাবার দিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। বন্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ করতে বলেছেন। এছাড়াও তিনি সিলেটের প্রধান নদীগুলোকে ড্রেজিং করার নির্দেশ দিয়েছেন। সভা শেষে তিনি অনুদানও দিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য গতকাল মঙ্গলবার বিকালেই জেলার সব ইউএনওকে নিয়ে বৈঠকে বসেছেন জেলা প্রশাসক। তারপর কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবেন।
মেয়র আরিফের কাছে প্রধানমন্ত্রীর জিজ্ঞাসা : মতবিনিময় সভায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বক্তব্য দেয়ার প্রতিযোগিতা লেগে যায়। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে বক্তব্য দেয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মেয়র আরিফের উদ্দেশে বলেন, তার দলের কেউ (বন্যা উপদ্রুতদের সহযোগিতায়) আসে নাই। তার দলের সবাই ঘরে বইস্যা ফাটাইয়া ফেলতেছে। উনিই (মেয়র আরিফ) বলুক তার দলের কাছ থেকে কী পাইছেন, আমরা শুনি।
বন্যাদুর্গত এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি অসহায় মানুষদের মধ্যে আশার আলো দেখিয়েছে মন্তব্য করে সিসিক মেয়র আরিফ বলেন, আপনার উপস্থিতির পর এখানকার মানুষ আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পেরেছেন। আপনার এখানে আসার খবরের পর থেকেই মানুষ অনেক আশায় ছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু আসছেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই কোনো ব্যবস্থা নেবেন।
সিলেট নগরীর ৮০ ভাগ বন্যাকবলিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, সিলেটের কয়েকটি এলাকা দিয়ে আকস্মিক পানি ঢুকে নগর ডুবে যায়। এজন্য শহর রক্ষা বাঁধের প্রয়োজন। সুরমা নদীর তীরে যেসব এলাকায় উঁচু ওয়াকওয়ে নির্মাণ করেছি, সেসব এলাকা দিয়ে পানি প্রবেশ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, আমাদের একটি ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি রিপোর্ট অনুযায়ী, সুরমা নদীর সিলেট মহানগর এলাকায় প্রায় ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ কাম ওয়াকওয়ে এবং হলদি ছড়া, গোয়ালি ছড়া, মালনী ছড়া, বৈঠা খালের সঙ্গে সুরমা নদী সংযোগ স্থলে স্লুইস গেট এবং পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করলে আকস্মিক বন্যা এবং পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যা থেকে সিলেট মহানগরী রক্ষা পাবে। আর বন্যা পরবর্তী সময়েও আমাদের শুকনো খাবারের প্রয়োজন। সামর্থ্য থাকলেও আমরা সিলেটের শুকনো খাবার পাচ্ছি না। আমার শ্রীমঙ্গল থেকে আনার চেষ্টা করছি, তাও খুবই অল্প সংখ্যক। ঢাকা থেকে যদি খাবার না যায়, তবে এখানে শিশুখাদ্যের অভাব দেখা দেবে। আর এখন কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী অহেতুক চিড়া, মুড়ি ও গুড়ের দাম বাড়িয়ে ফেলেছেন।
তিনি বলেন, এবারের বন্যায় মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিলে ভালো হয়। কারণ কিছু কিছু জায়গা খুবই দুর্গম। সাধারণের যাওয়া সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিলে সবাই ত্রাণ পাবে।
পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে নানা বক্তব্য দেন। এর মধ্যে সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ বলেন, আমরা ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালে বন্যায় কাজ করেছি। কিন্তু এবার পর পর তিনবারের বন্যা আমাদের অসহায় করে দিয়েছি। আমরা কোনো জায়গায় পৌঁছাতে পারছি না। মানুষ সাঁতরে আসছে, ভেসে আসছে। তাদের অসহায়ত্ব দেখেছি। এত অসহায় আমরা তাদের জন্য কিছু করতে পারছিলাম না। তারপর যখন সেনাবাহিনী নামল, তখন মানুষের মধ্যে এবং আমাদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসে। যে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো আমরা করেছি, সেগুলোও ডুবে গেছে, কোনো কাজ হয়নি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়