দৈনিক ওঠানামার মধ্যেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী

আগের সংবাদ

জনগণের সাহসেই পদ্মা সেতু : বন্যার দুর্ভোগ ও ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার > বিএনপির নেতা কে? সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

অরুণ রবির সোনার আলো

প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমন তার দাদিকে ডাকে বুজি। দাদিকে বুজি বলে ডাকতে তাকে কেউ শেখায়নি। সে শুনে শুনেই ডাকতে শিখেছে। এ বাড়িতে আরো একজন তার দাদিকে বুজি বলে ডাকে। তিনি হলেন ইমনের বুবু। দাদির ছোট বোন। বুজি আর বুবু দুজনেই একই বাড়ির বড় বউ আর ছোট বউ। ইমনের দুই বান্ধবী। এই দুজন মানুষ আছে বলে ইমন বাবা-মাকে ছাড়াও থাকতে পারে। ইমনের মা নেই। বাবা সরকারি চাকরি করেন। ঢাকার বাইরে পোস্টিং। ইমন সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকে বৃহস্পতিবারের জন্য। এই দিন বাবা ঢাকায় আসেন। শুক্র আর শনিবার- এই দুটি দিন বাবা ইমনের সঙ্গে থাকে। ইমন ঢাকার একটি নামকরা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তার লেখাপড়ায় যাতে বিঘœ না ঘটে তাই সে তার বুবু-বুজির কাছে থাকে। তাদের কোলেপিঠেই সে মানুষ হয়েছে।
ইমন জিজ্ঞেস করল, বুজি, তোমার সূর্যোদয় বেশি ভালো লাগে, নাকি সূর্যাস্ত?
– সূর্যাস্ত, বুজি উত্তর দেয়।
– কেন?
– সূর্যোদয়তো দেখি না বহুদিন।
– তুমি কখনো সূর্যোদয় দেখেছ?
– কত দেখেছি। আমার বাবার বাড়িতো সিলেটে। পাহাড়ি এলাকা। আর আমাদের বাড়িটাও ছিল টিলার ওপরে।
– টিলা কী বুজি?
– টিলা হলো ছোট পাহাড়। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন বেলা পর্যন্ত ঘুমালে বাবা খুব রাগ করতেন। বাবাকে খুব ভয় পেতাম আমরা। বাবার ভয়েই ভোর বেলা উঠে পড়তাম। আমাদের কলতলাটা উঠোনের পাশে ছিল। তাই রোজই সূর্যোদয় দেখেছি।
– কলতলাটা আবার কী?
– শহরের মতো ঘরের ভেতর বাথরুম আমাদের ছিল না। আমরা হাতমুখ ধুতাম টিউবওয়েলে। ওটাই কলতলা। তুমি টিউবওয়েল দেখেছ কখনো?
– হুম দেখেছি। কিন্তু আমি কখনো সূর্যোদয় দেখিনি। শহরেতো আমরা সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকেই উঠতে পারি না। তাছাড়া আমাদের বাসার চারপাশে এত বড় বড় বিল্ডিং যে আকাশই দেখা যায় না। আমাকে সূর্যোদয় দেখাবে বুজি?
– এখনতো স্কুল খোলা। পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষ হলে যখন গ্রীষ্মের ছুটি হবে তখন তোমাকে নিয়ে যাব আমাদের বাড়িতে।
– জানো বুজি, আমাদের রানু খালা গ্রীষ্মের ছুটিকে বলে আম-কাঁঠালের ছুটি। হি…হি…হি…।
ইমনের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। স্কুল এক সপ্তাহের জন্য ছুটি। বুবু-বুজির ছোট ভাই তাদের নিয়ে যেতে এসেছে। তার ওজন প্রায় একশ কেজি বলে ইমন তাকে মোটা ভাই বলে ডাকে। এই ডাকটা অবশ্য বুজিই শিখিয়ে দিয়েছে। ট্রেনে চড়ে তারা ছুটলো সিলেটের উদ্দেশে। ইমনের ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। সে এই প্রথম সিলেটে যাচ্ছে। সে জানে সিলেটে চা বাগান আছে। কিন্তু কোনোদিন সামনে থেকে দেখেনি। পাহাড়ি মেয়েরা কত সুন্দর করে চা পাতা তোলে। ইমন একবার স্কুলে ‘যেমন খুশি তেমন সাজ’তে চা বাগানের মেয়ে সেজেছিল। সাজটা ভালোই হয়েছিল। কিন্তু অভিনয় করতে পারেনি বলে কোনো পুরস্কার পায়নি। এবার সে ঠিক করেছে চা বাগানের মেয়েগুলোকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করবে। তাছাড়া ট্রেনে চড়াটাও ইমনের আনন্দের আরো একটি কারণ। শিশু পার্কের ট্রেন ছাড়া ইমন আগে কখনো সত্যিকার ট্রেনে চড়েনি। আনন্দে সে গান ধরল, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে…।
ইমন তার বাবার নানাবাড়িতে এসে যখন পৌঁছালো তখন ভরদুপুর। বাবার মুখে শুনেছে সে, তার বাবার জন্ম নাকি এ বাড়িতেই। তাই বাড়িটাতে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন একটা আপন আপন গন্ধ পেল ইমন। এদিকে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এ বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। বিশাল বাড়িটার সবগুলো ঘর তালাবন্ধই থাকে। শুধু একটা ঘরে জোনাকি খালা তার পনেরো বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে থাকে। তারাই বাড়িটাকে দেখেশুনে রাখে। বুবু আর বুজি প্রায় পাঁচ বছর পর এলো এখানে। মোটা ভাই মাঝে মাঝেই আসে। কিন্তু রাতে থাকে না। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে আবার চলে যায়। আজ ইমনরা আসবে বলে সবগুলো ঘর খুলে পরিষ্কার করা হয়েছে। জোনাকি খালাকে চিংড়ি মাছ আর মুরগির মাংস রাঁধতে বলা হয়েছে। বাড়িতে ঢুকেই চিংড়ি মাছের গন্ধ পেয়ে ইমনের খিদেটা যেন আরো বেড়ে গেল। হাতমুখ ধুয়ে সবাই দুপুরের খাওয়া শেষ করল। ইমন ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখতে লাগল। চারদিকটা ঘন সবুজে ঢাকা। সামনের পথটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। দূরের পাহাড়গুলো কেমন নীলচে রঙের। সেই দিকে তাকিয়ে ইমন মনে মনে বলল, বাবা তুমি কত দূরে আছ। এখান থেকে আমি বাবা বলে ডাকলে তুমি শুনতে পাবে বাবা? ইমন মনের অজান্তেই ডেকে উঠল ‘বাবা’। তখনই বুবুর ডাক শোনা গেল, ইমুমনি তোমার বাবা ফোন করেছে। এসো কথা বলো।
এই এলাকায় জনবসতি অনেক কমে গেছে। তাই সন্ধ্যার পর জায়গাটা খুব সুনসান আর ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। বুজি তাই সন্ধ্যার পরে ইমনকে আর ঘর থেকে বের হতে দিল না। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে তারা শুয়ে পড়ল। কাল খুব সকালে উঠতে হবে। সূর্যোদয় দেখতে হবে। কিন্তু নতুন জায়গায় ইমনের কিছুতেই ঘুম আসছে না। তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি সে ঘুমায়ও না। তার দুই পাশে দুই বান্ধবী বুবু আর বুজি অনেকক্ষণ হলো ঘুমিয়ে পড়েছে। লাইট বন্ধ করে দেয়ায় কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। জানালাগুলো কাঠের হওয়ায় বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরের কোনো আলোই ঘরে আসছে না। ইমন অনুমান করার চেষ্টা করল রাত কতটা গভীর হয়েছে। তারপর উঠে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে জানালার কাছে চলে এলো। জানালাটা খুলতেই ফকফকা জোছনা ঝুপ করে ঘরে ঢুকে গেল। অন্ধকার রাস্তায় গাড়ির হেডলাইট জ্বললে যেমন লাগে তেমন লাগছে চারদিকটা। কী অপূর্ব দেখতে লাগছে বাইরের দৃশ্যটা। হঠাৎ কয়েক গজ দূরে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল ইমনের। ভয় পেয়ে সরে এলো সে। তারপর খুব কৌতূহল হতে লাগল কী নড়ছে সেটা দেখার জন্য। ভূত নয়তো? জানালার পাল্লার আড়ালে দাঁড়িয়ে ইমন দেখল একটা কালো শরীর গাছ থেকে কাঁঠাল কেটে নিচে জমা করছে। পরনের লুঙ্গিটা হাফপ্যান্টের মতো করে কাছা দেয়া। ইমন তাড়াতাড়ি গিয়ে তার বুবুকে ডেকে তুলল। বুজিও জেগে উঠেছে। বুবু গিয়ে মোটা ভাইকে ডেকে নিয়ে এলো। মোটা ভাই লোকটাকে ধরে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। এই কাজটুকু করতে তাদের মধ্যে বেশ ধস্তাধস্তি হলো। ইমন দূর থেকে লক্ষ্য করল মোটা ভাইয়ের সঙ্গে শার্ট-প্যান্ট পরা আরো একজন মানুষ চোরটাকে গাছের সঙ্গে বাঁধতে সাহায্য করছে। মানুষটাকে তার খুব চেনা লাগছে। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তিনি এখন এখানে থাকতে পারেন। জোনাকি খালা জানাল চোরটার নাম দিলু চোর। প্রায় ছয়-সাতটা কাঁঠাল সে গাছ থেকে পেড়ে ফেলেছে। আর অল্প কয়েকটা আছে গাছে। দশটার মতো নারকেল আগেই পেড়ে রেখে দিয়েছে গাছের নিচে। দিলু চোর আসলে জানত না আজ এই বাড়িতে এত মানুষ থাকবে। সে বারবারই মাফ চাইতে লাগল। বলল, আর কোনোদিন এ বাড়িতে চুরি করতে আসবে না। তাকে যেন পুলিশে দেয়া না হয়। দিলু চোরকে পুলিশে দেয়া হলো না। কিন্তু তাকে ছাড়াও হলো না। এবারে শার্ট-প্যান্ট পরা মানুষটা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোয় এসে দাঁড়াল। ইমন খুশিতে চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা’। রাত পোহালেই বাবা দিবস। ইমন তার বাবাকে খুব মিস করছিল। ভেবেছিল এবার বাবা দিবসে বাবার সঙ্গে বুঝি দেখাই হবে না। কিন্তু বাবা যে মেয়ের মুখে হাসি দেখার জন্য সব করতে পারে। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে আসতে পারে। ইমন খুশিতে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মোটা ভাই জোনাকি খালাকে বলল ভালো করে মুড়ি মেখে আনতে। সঙ্গে চা। আজ আর ঘুমিয়ে কাজ নেই। জোছনা রাতে উঠানে মাদুর পেতে চা আর মুড়ি মাখা খেতে খেতে বুবু-বুজি সবাই ছোটবেলায় ফিরে গেল। কত পুরনো দিনের গল্প যে বলল। বিশেষ করে বাবার ছোটবেলার গল্পগুলো শুনেতো ইমন হেসেই ফেলল। সে ঠিক করল ঢাকায় ফিরে বাবার গল্পগুলো সে ডায়রিতে লিখে রাখবে। আর মাঝে মাঝে পড়বে।
ধীরে ধীরে পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। অন্ধকার কেটে গিয়ে সবুজ প্রকৃতি রঙিন হয়ে উঠছে। টকটকে লাল সূর্যটাকে দেখে মনে হচ্ছে মায়ের কপালের টিপ। পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। গাছের পাতাগুলো বাতাসে দুলে দুলে বলছে সুপ্রভাত সূর্যিমামা। এমন সুন্দর করে প্রতিটা দিন শুরু হয়! অথচ ইমন না জেনে এতদিন ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল।
বুবু বলল, ইমুমনি আমি যে তোমাকে একটি গান শিখিয়েছিলাম মনে আছে তোমার?
– মনে আছে বুবু। বাবা বলেছিল ওই গানটা নাকি তুমি বাবাকেও শিখিয়েছিলে।
– হ্যাঁ, তাহলে চলো সবাই মিলে আমরা সেই গানটা গাই।
বাবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইমন গাইতে শুরু করলো। বুবু ও বুজিও তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলাল- এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার…।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়