মাদকবিরোধী অভিযানে রাজধানীতে গ্রেপ্তার ৪৪

আগের সংবাদ

উদ্ধারের অপেক্ষা আর ত্রাণের আকুতি : পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ > ভেসে উঠছে বানভাসি মানুষের লাশ > এখনই সচল হচ্ছে না ওসমানী বিমানবন্দর

পরের সংবাদ

মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবাদ এবং সাধারণ জনগণ

প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এ যুগের বিকল্প সংবাদ মাধ্যম। এ মাধ্যমে ব্যক্তিগত ভালোবাসার প্রকাশ আছে, আছে প্রতিবাদ, এমনকি আছে সম্মিলিত বিদ্রোহের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। পশ্চিমের দেশগুলোতে সংবাদ মাধ্যম এখনো স্বাধীন, তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদ মাধ্যমের বিকল্প হয়ে ওঠেনি এখনো দেশগুলোতে। মানুষ এখনো আস্থা রাখে সংবাদ মাধ্যমের ওপর। কিন্তু যে দেশগুলোতে সংবাদ মাধ্যম বিশেষত পত্রিকা-টিভি এক ধরনের সরকারের মদতেই চলে কিংবা চলতে হয় সে দেশগুলোতে এই যোগাযোগ মাধ্যম এক ধরনের বিপ্লব কিংবা বিদ্রোহ তৈরি করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে এ প্রতিবাদ আমরা দেখছি ভিন্ন সময়ে। ২০১০ সালের মধ্যপ্রাচ্যের ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত মিসর দিয়ে শুরু হওয়া এ বিদ্রোহের রাজনৈতিক বিতর্ক আছে যদিও, তবুও বলতে হয় গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই এ এক জাগরণ।
আর এ রকমই একটা সম্মিলিত প্রতিবাদ সারা বিশ্বেই বলতে গেলে চমক লাগিয়েছে। সম্পদে শক্ত অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষত পশ্চিমের ক্ষমতাসম্পন্ন দেশগুলোর ধামাধরা হিসেবেই চলে। আমেরিকা এমনকি ইসরায়েলের কাছেও যেন এদেশগুলো থাকে নতজানু। ফিলিস্তিন নিয়েও খুব একটা মাথাব্যথা নেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর। কিন্তু এবারে একটা বিদ্রোহ যেন করে বসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, যা গোটা ভারতের রাজনীতিতে এমনকি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একটা প্রভাব ফেলেছে।
হাজার হাজার বছর থেকে ধর্ম মানুষকে প্রভাবিত করছে। এই ধর্মের নাম নিয়েই পৃথিবীর দেশে দেশে উসকে দেয়া হয় জনমানস। বর্ণবিদ্বেষ বৈশ্বিক রাজনীতিতে আরেকটা প্রভাবক। ধর্ম-বর্ণ নিয়ে রাজনীতি কোনো সময়ই সাধারণ মানুষকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। ধর্মের নাম নিয়ে ১২-১৩ লাখ মানুষকে উদ্বান্তু করেছে মিয়ানমার, বাংলাদেশ এদের জায়গা দিয়েছে। চীনেও আছে সেই একই ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকার অগণিত মানুষ। ইসরায়েলের মুসলিমরা নিগৃহীত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে ইহুদিবাদ ছড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশুদের। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মকে ইস্যু হিসেবে নিয়ে উগ্রবাদ সারা বিশ্বে জঙ্গিত্ব ছড়ায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। আইএস, বোকো হারাম, আল কায়দা প্রভৃতি সংগঠনের কর্মীদের দ্বারা প্রাণহানির সংখ্যা অগণন। ধর্ম নিয়ে ভারত-পাকিস্তান রাজনীতির রক্তাক্ত ইতিহাস সে এক ভিন্ন অধ্যায়। হিন্দু ধর্মের নাম নিয়েও ভারতের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত চলছে উগ্রতা, নৃশংসতা এবং হত্যাযজ্ঞ। বিশেষত ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর হিন্দুত্ব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে এবং এর রেশ ধরেই বিভিন্ন ধর্মীয় আন্দোলন ডানা বিস্তার করেছে। হাল আমলের রাজনীতির ইতিহাসে বাবরি মসজিদ, গরু রক্ষা, নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ইত্যাদিতে এখন পর্যন্ত বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে, অথচ ভারত মূলত একটা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বেই পরিচিত ছিল। এখনো সে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় এ রকম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু এদের প্রতিবাদ দেশটাতে ঝড় তুলতে পারছে না, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না ধর্মীয় বিদ্বেষ।
ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির দুজন নেতা ইসলামের নবীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন সম্প্রতি। সেখানেও নারীদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তারা। বাল্যবিয়ের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে, অথচ হিন্দু ধর্মের অনেক ধর্মীয় ঋষিরও বহুগামিতা কিংবা অধিক বিয়ে ইতিহাসের পাতায় পাতায় জ্বলজ্বল করছে। এমনকি অনেক জ্ঞানী পণ্ডিত মানুষও এ রকম বাল্যবিয়ে করেছেন। অথচ সমাজ সংস্কারে এদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রেখেছেন। তবুও ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে উসকে দিচ্ছে বিজেপি। এবারে ইসলাম ধর্মের নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্বক মন্তব্য করার পর থেকে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রসারিত হতে থাকে এবং তা ক্রমেই বিদ্রোহে রূপ নেয়। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই ক্ষোভই যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব শক্তিশালী দেশগুলোকে। এর রেশ ধরেই আরব দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের টানাপড়েন চলছে। নবীকে নিয়ে টিভি বিতর্কে করা মন্তব্য ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ার পর এর কড়া সমালোচনা এবং প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইনসহ বিভিন্ন উপসাগরীয় এবং আরব দেশগুলোর কাছ থেকে। এর আগে এমন প্রতিক্রিয়া এ দেশগুলো থেকে পরিলক্ষিত হয়নি।
ভারতের মোট আমদানির অর্ধেক আসে উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের সদস্য ৬টি দেশ থেকে। ইরান এবং ইরাককে যোগ করলে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকেই আসে ভারতের পেট্রলের ৮০ শতাংশ। এখন দাবি উঠেছে ভারতীয় পণ্য বয়কটের। এছাড়া ভারতীয় দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা এ দেশগুলোতে এক কোটির কম না। পররাষ্ট্র নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনলে কিংবা উপসাগরীয় দেশগুলো এ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রমিকবিষয়ক কড়াকড়ি আরোপ করলে আরো বিপর্যয় ডেকে আনবে দেশটাতে, যা সাধারণ নাগরিকদের মাঝে সরাসরি একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। এবং সেখানে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে সরাসরি জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সব মিলিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলো একই সুরে কথা বলায় দেশটির অর্থনৈতিক প্রবাহে একটা ধাক্কা হিসেবে কাজ করেছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর এই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বের একটা শক্তিরই প্রকাশ ঘটেছে। এতে ভারতসহ সারা বিশ্বেই একটা বার্তা পৌঁছেছে যে, আরবরা এক হলে তাদের নিজেদের অনেক জটিল পরিস্থিতিই তারা উতরে যেতে পারবে। এমনকি ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের জ্বলন্ত ইস্যুতেও চাইলে তারা নাক গলাতে পারবে। অন্যদিকে তাদেরও বিভিন্নভাবে সতর্ক থাকার একটা দিক এখানে বিবেচনায় নিতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভারতকে দেয়া এ সতর্কবার্তাকে সহজভাবে নেবে না। কারণ এ দেশগুলো সম্মিলিত রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকাকে শাসন করার পক্ষে অন্তরায় হিসেবেই বিবেচনা করবে। আর সেজন্যই ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি অসম্মানে উপসাগরীয় অঞ্চলে যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে তা অটুট থাকুক, এটি চাইবে না পশ্চিমের প্রভাবশালী দেশগুলো।
মহানবী (সা.)-কে কটূক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন কুয়েত প্রবাসীরা। গত শুক্রবার তারা এ বিক্ষোভে অংশ নেন। দেশটির নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু বিক্ষোভ করা আইনবিরোধী গুরুতর অপরাধ, অতএব যারা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন, তাদের গ্রেপ্তার করে ভিসা বাতিল করে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কুয়েত সরকার। আসলে এখানেই বাংলাদেশিরা অতি বাঙালি। তারা কখনো অতি মুসলিম অর্থাৎ সহজ ভাষায় হয় বিদ্রোহী না হয় আবেগী এবং কোনোটাই হওয়া উচিত নয়। কুয়েত সরকার যদি এ বিক্ষোভকারী প্রবাসীদের নিজ দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তবে বাংলাদেশ সরকারেরও এতে কোনো দায় থাকবে না। কারণ যে কেউ যে কোনো দেশে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের আইন মেনেই চলতে হয়। প্রবাসীদের এ ব্যাপারটা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। তাছাড়া যেখানে আরব বিশ্বই একাট্টা হয়েছে, সেখানে বিক্ষোভ দেখানোর প্রয়োজনই বা কি?
রাজনীতি এ রকমই। রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনার অর্থই হলো মানুষের বিশ্বাস এবং আবেগের জায়গাটাতে স্পর্শ করা। রাজনীতিবিদরা অত্যন্ত সচেতনভাবেই তা করে। নিজে প্রকৃত ধার্মিক না হয়েও ধর্মের কথা বলে। আর যার বলি হতে হয় সাধারণ জনগণকে। শুধু বাংলাদেশ-ভারত নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে তা-ই হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ধর্মীয় জোশে নূপুর শর্মা তার জিত ঠিকই হয়তো পেয়েছিলেন, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কোটি ভারতীয়কে শঙ্কায় ফেলেছিলেন। তেল আমদানি ব্যাহত হলে জাতীয়ভাবে কোনো অর্থনৈতিক ধাক্কা এলে তাও শ্রমজীবী কিংবা মধ্যবিত্ত মানুষদের আঘাত করে প্রথম। কুয়েত থেকে যদি ফিরে আসেন বাংলাদেশিরা তাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শ্রমজীবী বাংলাদেশিরাই। ধর্মীয় আবেগের কাছে এভাবেই হেরেছে সাধারণ মানুষ যুগে যুগে, হারছে এখনো।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়